শিরোনাম
'শিক্ষিত' হলেই সভ্য হয় না
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৪০
'শিক্ষিত' হলেই সভ্য হয় না
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আমি প্রায় দশ বছর ধরে একটা বিষয় ক্রমাগত লিখে চলেছি - আমরা প্রতিটা বাংলাদেশি অন্যকে ছোট করার এক অদ্ভুত মনোবৃত্তি ও ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি!


জন্মানোর পর থেকে জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে অন্যকে ছোট করে পরমানন্দ লাভ করা!


জগতের মানুষজন আনন্দ পাওয়ার জন্য কেউ দেশভ্রমণে বের হয়, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে কিংবা খেলাধুলা করে বেড়ায় বা অন্য কিছু! আর আমরা অন্যকে ইচ্ছেমতো ছোট করে আনন্দ পাই!


আমাদের মাঝে কেউ যদি একটু ভালো করতে থাকে, তাহলে তাকে দুই কদম বেশি এগিয়ে ছোট করার চেষ্টা করি!


ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ বাবা হয়েছে। ছেলেটা আনন্দের সঙ্গে সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চা আর তার মা'র সঙ্গে একটা ছবি ফেসবুকে দিয়েছে; সেখানে লোকজন এমন-সব মন্তব্য করেছে, যেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করাও লজ্জার ব্যাপার।


কেউ লিখেছে, এটা আপনার সন্তান না! আপনি তো সেদিন বিয়ে করলেন! এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা হয় কিভাবে!


অন্য একজন লিখেছে, ও বুঝেছি বিয়ের আগেই কাজ সারা ছিল!


আরেকজন তো লিখেছে, আপনারা খাটে যেমন পারফর্ম করছেন, এমন পারফর্ম যদি মাঠে করতেন, তাহলে আমরা অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকার সঙ্গে সহজেই জিতে যেতাম!


এই রকম আরও হাজারটা মন্তব্য আছে সেখানে। রুচিহীন লোকজন যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমালোচনা করার জন্য!


শেষমেশ বাধ্য হয়ে তাসকিন আহমেদ একটা কমেন্ট লিখেছে- সে ১২ মাস আগে বিয়ে করেছে। শুধু তাই না, তাকে শেষ পর্যন্ত হিসেব করে দেখিয়ে দিতে হয়েছে- বিয়ের পরই তাদের সন্তান হয়েছে, বিয়ের আগে নয়।


এটাই আমাদের স্বভাব! আমরা কারো ভালো দেখতে পারি না। কেউ একটু ভালো অবস্থানে চলে গেলে তো কথাই নেই! তাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোকে আমরা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করি।


অথচ ছেলেটা যখন বাবা হওয়ার ছবিটা আপলোড করেছে, দেখে আমার মনে হয়েছে, কী চমৎকার একটা ছবি! দেখেই মনে হচ্ছিলো, ছেলেটা বাবা হয়ে নিজেকে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ ভাবছে।


আর আমরা কিনা ঝাঁপিয়ে পড়ালাম- এটা কি আদৌ তার সন্তান কিনা কিংবা সন্তান হলেও বিয়ের আগেই মনে হয় সন্তান হয়ে যাচ্ছিলো ইত্যাদি!


প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এমন করি কেন? করি কারণ ছোটবেলা থেকেই পরিবার, সমাজ কিংবা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের আমরা এমনটাই করতে দেখেছি, বলতে শুনেছি।


বেশি দূর যেতে হবে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের প্র্যাকটিসগুলো ভালো করে খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। খুব বেশি দূরে আর যেতে হবে না।


''বুয়েট ছাড়া দেশে আবার অন্য কোথাও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয় নাকি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আদৌ পড়াশুনা হয় নাকি!'' এরা নিয়মিত এসব বলে বেড়ায়!


এরা যে ভালো, সেটা তো আমরা জানিই! কিন্তু নিজেদের বড় করে দেখানোর জন্য অন্যদের ছোট করে দেখতে হবে কেন? দেশের অন্য কোথাও কি তাহলে পড়াশুনা হচ্ছে না?


"পাত্তা" দেবার ব্যাপারটাই দেখুন! যদিও "পাত্তা" শব্দটা নিয়েই আমার আপত্তি আছে।


আরও বড় পরিসরে দেখুন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাত্তা দেয় না! আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তো আপনি পাত্তাই পাবেন না!


শুধু তাই না, সরকারি চাকরী করলে আপনি এক ধরনের মানুষ, না করলে আরেক ধরনের মানুষ কিংবা হয়ত মানুষই না!


একবার গেলাম আমার এক সহকর্মীর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তখন আমি নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছি। আমার সহকর্মী আমাকে তাদের এক গ্রামের বাজারে নিয়ে গেলেন। গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর এক লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করেন?


-আমি শিক্ষকতা করি।


-সরকারি না বেসরকারি?
-বেসরকারি।


''ভদ্রলোক'' এরপর আমার সঙ্গে আর কথাই বললেন না! ভাবখানা এমন, তোমার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করার সময় আমার নাই!


তো, সেই লোক নিজেও কিন্তু সরকারি চাকরী করে না। তাহলে সে কেন সরকারি চাকরীকে এতো মূল্য দিচ্ছে? কারণ সে জীবনভর দেখে এসেছে, সরকারি চাকরী করা মানেই বিশাল ক্ষমতা!


ওহ, এখানেও আবার ব্যাপার আছে। আপনি ধরুন সরকারি চাকরী করেন, কিন্তু বিসিএস ক্যাডার না; তাহলেও আবার সমস্যা! বিসিএস ক্যাডাররা আবার আপনাকে পাত্তা দিবে না!


আবার ধরুন আপনি বিসিএস ক্যাডার, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডার কিংবা এই ধরনের কোনো ক্যাডারে। দেখবেন পুলিশ কিংবা এডমিন ক্যাডারের লোকজন আপনাকে পাত্তা দিচ্ছে না!


ধরুন, আপনি শিক্ষা ক্যাডারে চাকরী করছেন, অন্য ক্যাডারের লোকজন বলে বসতে পারে, আরে ওরা আবার কিসের বিসিএস ক্যাডার। মাস্টার মানুষের আবার ক্যাডার কিসের!


এ-ই হচ্ছে আমাদের অবস্থা! কেউ কাউকে "পাত্তা" দিতে চাই না! অন্যকে ছোট করেই জগতের সমুদয় আনন্দ আমরা পেয়ে বেড়াচ্ছি!


যারা ভাবছেন, তাসকিনের ফেসবুক পেজে অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত মানুষজন এসব লিখেছে; তাঁদের জানিয়ে রাখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কিংবা বিসিএস ক্যাডার, এরা কেউই কিন্তু অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত না!


তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আর সভ্য হবার মাঝে একটা পার্থক্য আছে। আমরা সেই পার্থক্যটা এখনো নির্ণয় করতে পারিনি। আমরা ভেবে বসে আছি, শিক্ষিত মানেই সভ্য! যার কারণে সভ্যতা এখনো আমাদের কাছ থেকে হাজারো মাইল দূরে!


আমিনুল ইসলামের ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com