শিরোনাম
যেভাবে এলো বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩৩
যেভাবে এলো বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটউটের একদল উৎসাহী শিক্ষার্থীর উদ্যোগে শুরু করা ১লা বৈশাখের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ পরবর্তীতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে বাঙ্গালির জাতীয় উৎসব হিসাবে অনেক আগেই গৌরবের সাথে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বলা যায়, আত্মপ্রকাশের পর থেকেই গোটা জাতির নববর্ষ বরণের প্রধান আকর্ষণ ও সংবাদমাধ্যমের প্রধান খবর হিসাবে স্থান পেয়ে এসেছে এই শোভাযাত্রা। এর উদ্দেশ্য, দর্শন ও শিল্পরূপ নিয়ে বহুবিধ আলোচনা, প্রশংসা চলেএসেছে প্রতিনিয়ত।


কিন্তু গত বছর ইউনেস্কোর ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমিনিটি’র তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে মিডিয়াতে শুরু হয়েছে এর ইতিহাস নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ। এটাও খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমরা যারা এই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রকৃত উদ্যোক্তা তারা সম্প্রতি খুব উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন রকমের ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরছে। তার মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের তথ্যবিকৃতিও ঘটছে। তাই আমরা যথার্থই শঙ্কিত যে, এসব ভুল, আংশিক সত্য ও বিকৃত তথ্যই হয়তো ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক আলামত হিসাবে সত্যরূপে গণ্য হবে। তাই এখনই এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়াটি বন্ধ হওয়া জরুরী বলে আমরা মনে করছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে আরও সচেতন ও দায়িত্ববান হওয়ার জন্যও অনুরোধ করছি।


এখানে বলে রাখা ভালো, অতীতেও কিছু ভুল তথ্যসম্বলিত প্রবন্ধ দু’একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দু'-একজন বরেণ্য ব্যক্তিও তাঁদের লেখায় কিছু স্মৃতিবিভ্রাট ঘটিয়েছেন। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র সূচনার পর থেকে প্রতি বছর এর সাথে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হয়েছেন চারুকলার নতুন ছাত্র-শিক্ষকসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রায় সকল বরেণ্য ব্যক্তি ও সংস্কৃতিকর্মী। তাঁরাও অবশ্যই এই মহৎ উদ্যোগের অন্যতম অংশীদার। কিন্ত তাঁদের অনেকেই নিজের অংশগ্রহণের সময়টাকেই শোভাযাত্রার সূচনাকাল হিসাবে গুলিয়ে ফেলেন। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির লেখা বা সাক্ষাতকারের বক্তব্য ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র খণ্ডিত বা ভুল ইতিহাস তুলে ধরে। তার মাঝে কেউ কেউ নিজের ভুমিকাটাকে বা তার পছন্দের কাউকে অধিক প্রাধান্য দিতে গিয়ে সত্য থেকে কিছুটা বিচ্যুতও হয়ে যান।


একটা কথা সুস্পষ্টভাবেই বলতে চাই যে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কোনো ব্যক্তিবিশেষের একক চিন্তার সৃষ্টি নয়, এটি সম্পূর্ণরূপেই একটি সম্মিলিত ভাবনার এবং যৌথ উদ্যোগের ফসল। এবং এই যুথবদ্ধ প্রয়াসের মাঝেই মূলত নিহিত ছিল সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপকে সফল করে তোলার গোপন প্রণশক্তি। তবে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ব্যক্তিরই মেধা, সৃজনশীল ভাবনা ও শ্রম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে যুক্ত হয়েছে এখানে। কারো কিছু বেশি, কারো একটু কম, কিন্ত সবারটাই সমান মূল্যবান।


‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র উৎপত্তি বাংলা-১৩৯৬ সালে (ইংরেজী-১৯৮৯)। শুরুর বছর এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরের বছর ১৯৯০ থেকে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই নামকরণটি করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির দুই দিকপাল, ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন এবং প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক।


শোভাযাত্রার স্বপ্নবীজটা প্রোথিত হয়েছিল মূলত ১৯৮৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মোৎব পালনের একটি ক্ষুদ্র শোভাযাত্রার আয়োজন থেকে। সময়টা ছিল তখন রাজনৈতিক-সামাজিক দিক থেকে খুবই অস্থির এক সময়। স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তখন ক্ষমতায়। বাঙালি সংস্কৃতি তথা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির উত্থান, সরকারি দমন-পীড়ন, অন্যদিকে উত্তাল ছাত্রআন্দোলন। শিক্প্রতিষ্ঠান গুলোতে চরম নৈরাজ্য। শুভ চেতনা ও মূল্যবোধ প্রায় অবদমিত। এ সময় চারুকলার ১৯৮৬-৮৭ সালের ব্যাচের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী সংঘবদ্ধভাবে অংশ নিতে থাকে চারুকলাসহ গোটা বিশ্বদিদ্যালয় এলাকার প্রায় সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, চারশিল্পী সংসদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, এ রকম যে কোনো সংগঠন যে কর্মসূচি নেয়, এই গ্রুপটিকে দেখা যায় কাজের অগ্রভাগে। মিছিল-মিটিং থেকে বন্যা ত্রাণ, বিজয় দিবসে ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা নির্মাণ, জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চ তৈরীসহ সকল শুভকর্মেই তারা ছিল অগ্রগামী। এরাই এক সময় চিন্তা করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিনে একটি শোভাযাত্রা করার। সেখানে তারা বাঁশ, কাগজ, বোর্ড, শোলা দিয়ে তৈরী করে কিছু পেন্সিল, তুলি, কালার পেলেটের বৃহৎ আকারের প্রতিকৃতি আর কিছু বিচিত্র মুখোশ। এগুলো বহন করে ঢাকঢোল, খোল-করতাল বাজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রদক্ষিণ করে একটি ছোট র‍্যালি। এই শোভাযাত্রা ব্যাপক সাড়া ফেলে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সবাই ভাবতে থাকে আরও বড় আকারে কিছু একটা করার। শুরু হয় ছোট ছোট বৈঠক। পরিকল্পনা রূপ নিতে থাকে বাস্তবে। সিদ্ধান্ত হয় ১লা বৈশাখ বড় আকারের একটি শোভাযাত্রার। শুরু হয় গবেষণা, পরামর্শ। অনুসন্ধান শুরু হয় অতীত ও বর্তমানের বাঙ্গালির লোকজ অনুষ্ঠানগুলোর, তাদের প্রকৃতির। ধামরাই মানিকগঞ্জের রথযাত্রা, যশোরের ১লা বৈশাখের মিছিল, পুরান ঢাকার ঈদ ও মোহরমের তাজিয়া মিছিল, টাঙ্গাইলের সংযাত্রা, নেত্রকোনার লাম্বাগীত, উত্তরবঙ্গের শিবের গাজন - সবকিছু থেকেই উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। স্টাডি করা হয় বিশ্বের বড় কার্নিভ্যালগুলোর। তার মাঝে ডোমিনিকা কার্নিভ্যাল, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গ্যালি, ক্যারাবিয়ান টোবাগোসহ ব্রাজিল, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার কার্নিভ্যালগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয় গভীরভাবে। তবে মূল ভিত্তি করা হয় আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে।


বাংলার দারুশিল্পীদের তৈরী কাঠের হাতি, লাম্বাগীতের ঘোড়া, সড়ার পট থেকে নেয়া মোটিফের আলপনায় মুকুট, মুখোশসহ সব উপাত্তই গ্রহণ করা হলো লোকায়ত শিল্প থেকে। শুরু হয় কাজ। এঅনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সূচনা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার।


কামাল পাশা চৌধুরীর ফেসবুক থেকে


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com