শিরোনাম
ফিজিওথেরাপি সেবাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে চান শায়লা রুমকী
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০১৯, ১৪:২১
ফিজিওথেরাপি সেবাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে চান শায়লা রুমকী
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

‘ছোটবেলায় কত কিছুই না হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কখনো ডাক্তার হওয়ার, কখনো পাইলট বা শিক্ষিকা হওয়ার। আবার যখন কারো লেখা পড়ে মনটা ভরে যেত, তখন ভাবতাম লেখক হবো। একদিন টিভিতে উদ্যোক্তা রোকেয়া আফজাল রহমানের জীবনকাহিনি দেখে কেন জানি হৃদয়ে অন্যরকম একটা তাগিদ অনুভব করি। তখন ভাবলাম, রোকেয়া আফজাল পারলে আমি পারবো না কেন? হৃদয়ের সেই তাগিদ থেকেই আমার চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া। তবে এর পেছনে স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতাও কম ছিল না। সে না থাকলে হয়তো আমার উদ্যোক্তা হয়ে উঠাই হতো না।’


বলছিলেন ‘পিটিআরসি রিহাব অ্যান্ড ফিজিওথেরাপি সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক উম্মে শায়লা রুমকী।


শিক্ষাজীবন শেষ করে শুরু করেন চাকরি। কিন্তু পরের অধীনে চাকরি তার মোটেও ভালো লাগত না। সে কারণেই চাকরি ছেড়ে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করলেন ফিজিওথেরাপি সেন্টার। মেডিক্যালের ছাত্রী হওয়ায় উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুতে তার পদে পদে পোহাতে হয় নানান বাধা-বিপত্তি। তবে দমে যাওয়ার পাত্রী নন তিনি। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা।


উম্মে শায়লা রুমকীর জন্ম রাঙামাটি জেলায়। বাবা ফরেস্ট অফিসার। সেই সুবাদে ছোটবেলাটা তার কেটেছে দেশের বিভিন্ন শহরে। পড়াশোনাও বিভিন্ন স্কুলে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রুমকী মেজ। শৈশবের বেশির ভাগ সময় রাঙামাটি শহর ও ভান্ডারিয়ায় কাটলেও এসএসসি পাস করেন চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। কলেজ জীবনের ইতি টেনে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্তজীবন। ভর্তি হন রাজধানীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদে। ২০০৮ সালে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরই মধ্যে বিয়েটাও সেরে ফেলেন।



শিক্ষাজীবন শেষ করে জীবনের প্রয়োজনে শুরু করেন চাকরি। বেশ কিছুদিন করেনও। কিন্তু পরের অধীনে চাকরি করতে তার মন চাইত না। সব সময় তিনি নিজের মতো করে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন। তবে হাতে ছিল না তার কোনো টাকাকড়ি। মনে ছিল শুধু অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন। রুমকীর স্বামী তখন নতুন চাকুরে। সীমিত আয় বিধায় স্বামীর পক্ষে তাকে আর্থিক সাপোর্ট, সাহস বা উৎসাহ দেওয়ারও সুযোগ ছিল না।


অন্যদিকে, বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছা রুমকী যেন চাকরিটাই করেন, ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু নয়। তাদের ভাষ্য, টাকা বিনিয়োগ করে মেয়েদের ব্যবসা করা উচিত নয়। তবে সবাই না করলেও, রুমকীর দৃঢ় ইচ্ছা ছিল নিজের উদ্যোগে কিছু একটা করার। ভাবনাগুলো যখন বাস্তবে রূপ দেয়ার কথা চিন্তা করতেন অনেক সময় হতাশ হয়েও পড়তেন। এ অবস্থা দেখে একদিন তার স্বামী বললেন, টাকা-পয়সা তো দিতে পারব না, তবে সহযোগিতা করতে পারি। তুমি যা করতে চাও করো। স্বামীর এমন ভরসায় মনে বেশ সাহস পান রুমকী।


২০০৯ সালের কথা। চাচা আর বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায় দুই লাখ টাকা ধার করে রাজধানীর শ্যামলীতে বাসার কাছে একটা হাসপাতালের গ্যারেজের ৫০০ বর্গফুটের জায়গা ভাড়া নেন রুমকী। আল্লাহর অশেষ রহমতে বছর খানেকের মাথায় তাদের ওই টাকা শোধ করে দেন। প্রতিষ্ঠানটা দুইবছর ভালোই চলছিল। কিন্তু মা হওয়ার সময়টায় কর্মচারীর হাতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বটা ছেড়ে দিতে হয়। আর তাতেই বিপত্তির শুরু। কর্মচারীরা ঠিক মতো না আসায় আয় কমে যায়। টাকা-পয়সার হিসেবও ঠিকমতো পাওয়া যেত না। এসব কারণে বাধ্য হয়ে তাকে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে হয়।


তারপর দু’বছর বিরতি নিয়ে চলে যান উত্তরায়। ২০১৩ সালে নতুন করে নিজ বাসার ড্রয়িংরুমে পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়েই শুরু করেন স্বপ্নের নতুন যাত্রার। এরপরে এক বন্ধুর কাছ থেকে এক লাখ আর নিজের জমানো টাকায় ধীরে ধীরে কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে থাকেন। উত্তরায় এখন প্রায় দুই হাজার বর্গফুট জায়গায় তার ফিজিওথেরাপি সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে। মিরপুরে ২০১৬ সালে চালু করেন এর আরেকটি শাখা।


রুমকীর গ্র্যাজুয়েশন ফিজিওথেরাপি বিষয়ে হলেও ব্যবসা পরিচালনা করার মতো কারিগরি জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না। তাই তাকে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয়।



রুমকী বলেন, জানতাম সেবা দিয়ে ব্যবসা করতে গেলে ব্যবসা শুরুর বিষয়গুলো জানাটা খুবই জরুরি। তাই আমি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এর মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (স্কিটি) থেকে ‘লাভজনকভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা স্থাপন এবং শুরু করার উপায়’ কোর্সটি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইজ এবং হেল্প সেন্টার (বি ইয়া) থেকেও ‘উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনা (মৌলিক)’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসিডি (আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) ডিপ্লোমা শেষ করে অটিজম নিয়ে থিসিস করছি।


ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার (পিটিআরসি) সেন্টারটি থেকে অনলাইনের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে ফিজিওথেরাপি-বিষয়ক স্বাস্থ্য পরামর্শ। চাইলে ডাক্তারদের অ্যাপয়েন্টমেন্টও নেয়া যাচ্ছে। এছাড়াও যে কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঢাকার মধ্যে হোম সার্ভিসের অনুরোধ জানাতে পারবেন। অনুরোধ অনুযায়ী ঘরে গিয়ে সেবা দেবে প্রতিষ্ঠানটি।


পিটিআরসি’র সেবা সম্পর্কে রুমকী বলেন, প্রতি শুক্রবার গরিব রোগীদের জন্য ফ্রি সেবা দিয়ে থাকে পিটিআরসি। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনে আমরা স্বাস্থ্য-বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, ফিটনেস প্রোগ্রাম, কাউন্সিলিং ও হোম সার্ভিস। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছি প্রথম আলো, দৈনিক বণিক বার্তা, ডিবিসি নিউজ চ্যানেল এবং সময় টিভিতে। ‘এনজয় প্রেগনেন্সি’ নামে প্রকল্পের মাধ্যমে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। এছাড়াও সাজেদা ফাউন্ডেশনে নিয়মিত ট্রেনিং পরিচালনা এবং তিলোত্তমা রোটারি উত্তরার সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করছি।


প্রতিদিনই রোগি দেখেন রুমকী। তাদের জীবনের আনন্দ-বেদনার গল্প শুনেন। কাজটাই তাকে দেয় স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতি। তাই দিন-রাত ক্লান্তিহীনভাবে করেন পরিশ্রম। তবে পরিশ্রমের স্বীকৃতিও পেয়েছেন এই অদম্য উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বিডিএসএন এর কাছ থেকে। প্রথম পাওয়া পুরস্কারটা তাকে কাজের গতি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ ছাড়া প্রেরণামূলক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন সম্মাননা। গত বছরই আমেরিকান সরকার কর্তৃক পেয়েছেন ইন্টারন্যশনাল ভিজিটর লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড। সিটি ব্যাংক আমেরিকার পক্ষ থেকে পান সেরা তরুণ উদ্যোক্তা ২০১৮ পুরুস্কার।


হাজারো কাজের ভীড়ে লেখালেখিটাও তাকে বেশ টানে। দিন শেষে প্রায়ই টুকটাক লেখালেখি করেন তিনি। যে বিষয়ে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন এসব কাজ নিয়েই ‘সুস্থতায় ব্যায়াম’ শিরোনামে লেখেন একটি বই। গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি বিক্রিও হয়েছে বেশ।



বর্তমান অবস্থা নিয়ে রুমকী বলেন, ২০১৬ সালে মাইডাস থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নেই। সেটা পরিশোধ করে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে আরো আট লাখ টাকা ঋণ নিয়ে উদ্যোগটার পরিসর বাড়িয়েছি। এতে অনেকের কাজের সুযোগ হয়েছে। এখন আমার দু’টি শাখায় বেতনভুক্ত আটজন নারীকর্মী ও ছয়জন পুরুষকর্মী রয়েছেন। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে আরো অন্তত ১০ জন কাজ করেন। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পেরেছি বলে ভালো লাগে। ভবিষ্যতে আরো অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বলে আমি আশাবাদী।


নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে রুমকীর ভাষ্য, প্রথমে কী করতে চান, তা ঠিক করুন। নিজের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিন। এখনই শুরু করুন। নিজের দক্ষতা ও দুর্বলতা আলাদা করুন। যা করতে চান, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিন। ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করুন। প্রথম বিনিয়োগটা সব উদ্যোক্তার নিজেই করতে হয়। তাই সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নিন। সময়, চাহিদা, দক্ষতা নানাদিক পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ নিতে পারলে আশা করছি একজন উদ্যোক্তা সফলতা পাবেন।


মানুষকে ভালোবেসে সেবার ব্রত নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান স্বপ্নবাজ রুমকী। পিটিআরসি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি সেবাকে সর্বস্তরে সহজলভ্য করে পৌঁছে দিতে চান তিনি। দু’চোখে তার স্বপ্ন একটি পূর্ণাঙ্গ ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল স্থাপন করার। এছাড়া ইচ্ছা রয়েছে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ট্রেনিং ও সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করার।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/শারমিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com