শিরোনাম
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়ে শফিউল এখন ডিজিটাল গোয়ালা
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:২০
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়ে শফিউল এখন ডিজিটাল গোয়ালা
রাজধানীর নিকেতনে গোয়ালার প্রধান কার্যালয়ে মো. শফিউল আলম
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

প্রত্যেক তরুণের জীবনেই স্বপ্ন থাকে পড়াশোনা করে ভালো একটি চাকরি পাওয়া। কিন্তু তার ইচ্ছাটা ছিল ভিন্ন ধরনের। চাকরি নয় নিজ থেকে কিছু করা। সেই ইচ্ছা পূরণে পেরোতে হয়েছে অনেক কঠিন পথ। নানা বাধার মুখেও পিছপা হননি। আজ তিনি ডিজিটাল গোয়ালা।


বলছিলাম ই-কমার্স উদ্যোক্তা এবং গোয়ালার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সহপ্রতিষ্ঠাতা মো. শফিউল আলমের কথা।


একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়া শেষে শফিউল আলম ফ্রিল্যান্সিংয়ে শুরু করেন পেশাজীবন। ২০১৬ সালের শেষদিকের কথা। একদিন নিজের শিশুসন্তানের জন্য নিরাপদ খাবার খুঁজতে গিয়ে শফিউলের মাথায় আসে নতুন আইডিয়া।


বাড়ি বগুড়ায় হওয়ায় এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে দই বিক্রির চিন্তা করেন তিনি। বগুড়ায় দইয়ের জনপ্রিয়তার কথা জানতেন। কিন্তু বাজারে খাঁটি বগুড়ার দই খুঁজে বের করা কঠিন। এ চিন্তা থেকেই ঢাকার পান্থপথে ছোট একটি ঘর থেকে সেই আইডিয়ার বাস্তবায়ন শুরু হয়।


২০১৬ সালের ২১ নভেম্বরে বন্ধু রুবাইয়াত হোসেন ও রুহুল আমিনকে নিয়ে তিন বন্ধু একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। ছয় মাসে ছয় হাজারের মধ্যে লাইক পায় পেজটি। শেরপুরের একটি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে দই বিক্রি শুরু করেন। তিন মাসের মধ্যে ক্রেতাদের কাছ থেকে বগুড়ার অন্য পণ্যের চাহিদাও পেতে শুরু করেন। দইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় ঘি। কিছুদিন পর দুধের চাহিদাও আসতে শুরু করে। তারা ২০১৭ সালে খাঁটি দুধ বিক্রি শুরু করেন।


এভাবে একটা কোম্পানির সাথে বগুড়ার দই, ঘি বিক্রি করতে থাকলে তো ঢাকায় ওই কোম্পানিরই ব্র্যান্ডিং হবে। আমরা থেকে যাচ্ছি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। একটা নাম ঠিক করে নিজেদের নামে এসব পণ্য ব্র্যান্ডিং করলে একটা সময় তো সেটা আমাদেরই প্রতিষ্ঠান হতে পারে। এ ভাবনা থেকেই শুরু হয় নাম ঠিক করা। কী নাম দেয়া যায়? ৫০টি নামের তালিকা করেন তিন বন্ধু। একটাও পছন্দ হলো না শফিউলের। হঠাৎ তার মাথায় আসে গোয়ালা শব্দটা। কেননা দুধ, গরু ও গোয়ালঘর এ তিনটি শব্দের সাথে গোয়ালা নামটা মন্দ নয়। শেষে এটাই চূড়ান্ত করা হয়। এ নামেই শুরু হয় তাদের ব্যবসার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।


ব্যবসায় নেমে পড়লেই তো আর সফল হওয়া যায় না। শুরুতে ভালো সাড়া পাওয়া গেলেও গোয়ালার সুসময় বেশিদিন টেকেনি।


প্রধান কার্যালয়ে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত গোয়ালার কর্মীরা


উদ্যোগ বাস্তবায়নে তাদের তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমত, এ ব্যবসা সম্পর্কে কারো কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া ছিল না। দ্বিতীয়ত, কারো হাতেই টাকা-পয়সা ছিল না। তৃতীয়ত, ফুড ইন্ডাস্ট্রির এমন একটি সেগমেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, যেটার কোনো সোস্যাল ইকোনমির স্ট্যাটাস ছিল না। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার ছাত্র হিসেবে আইটি ব্যবসা ভালো করে বুঝতেন শফিউল। কিন্তু ই-কমার্সে ফুড নিয়ে ব্যবসায় অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।


ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় নিজেদের যে জ্ঞান, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা ছিল, তা দিয়ে গোয়ালার কাজ চালাতে থাকেন। এক সময় তিন বন্ধুর পকেটের টাকায় টানপড়া শুরু হয়। লাভও হচ্ছিল না। বাড়তি বিনিয়োগ দরকার হয়। উপায় না দেখে একজনের ভবিষ্যৎ তহবিলের (প্রভিডেন্ট ফান্ড) টাকা গোয়ালায় খাটানো হয়। তারপরও সংকট কাটেনি। গোয়ালার অবস্থা খারাপ হওয়ায় সহপ্রতিষ্ঠাতা রুহুল আমিন গোয়ালা ছেড়ে দেন।


পুঁজির অভাবে যখন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন শফিউল। ফলও হয় শুভ। গোয়ালার দুঃসময়ে বিনিয়োগকারী হিসেবে পাশে এসে দাঁড়ায় দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা গোয়ালার সঙ্গে যুক্ত হন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি বিনিয়োগকারী হিসেবে। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা আর নিজেদের কঠোর পরিশ্রমে ঘুরে দাঁড়ায় গোয়ালা।


একসময় নিরাপদ খাবারের পাশাপাশি দইয়ের ঐতিহ্য ও স্বাদ অক্ষুণ্ন রেখে মানসম্মত প্যাকেজিংয়ের বিষয়টি মাথায় আসে শফিউলের। গোয়ালার লগোতে তৈরি করা হয় মিষ্টির প্যাকেট। মিষ্টির পাশাপাশি সবাই যাতে দইকে উপহার হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন, সে লক্ষ্য নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে গোয়ালার কার্যক্রম।


ঢাকার ১০-১২ হাজারের মতো ক্রেতাকে এখন নিয়মিত সেবা দিচ্ছে গোয়ালা। এর বাইরে চালডাল, হারারু, অথবাসহ অন্যান্য ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গোয়ালার পণ্য কিনছেন ক্রেতারা। প্রতি মাসে চার থেকে সাড়ে চার হাজার সরাসরি ফরমাশ পাচ্ছেন তারা। সুপারশপের মধ্যে ইউনিমার্ট, মীনাবাজার, আস্থা, লাজ ফার্মা, হাইপারমার্টে গোয়ালার পণ্য পাওয়া যায়।


গোয়ালা মূলত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ই-কমার্স বা অনলাইনে সেবার মাধ্যমে ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি দুধ ও দুধজাত পণ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে এখন আছে সরা দই, কাপ দই, ক্ষীরশা। পাশাপাশি ঘি, সন্দেশ, রসমালাইও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সরিষার তেল পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন করতে শুরু করেছেন তারা।


রাজধানীর নিকেতনে গোয়ালার প্রধান কার্যালয়। নিজস্ব বাহক দিয়ে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়া হয়। গোয়ালার গ্রাহক সেবা বা পণ্যের গুণগত মান নিয়ে অভিযোগ কম বলে দাবি করেন শফিউল।


বর্তমানে ৩০ জনের মতো কর্মী রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সম্প্রতি ইউনিভার্সাল ফিন্যান্সিয়াল সলিউশনস লিমিটেডের (ইউএফএস) কাছ থেকে তহবিল পেয়েছে গোয়ালা। এটা দিয়ে পাবনার চাটমোহর উপজেলায় পাস্তুরিত দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তারা। ইতোমধ্যে সেখানে কার্যক্রম শুরুও করা হয়েছে।


ফেসবুকের মাধ্যমে শুরু হলেও এখন গোয়ালা পণ্য পেতে ওয়েবভত্তিক ফরমাশ দেয়া যায়। শিগগিরই অ্যাপেও এ সুযোগ আসবে।


বাজারে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এত ব্র্যান্ডের পণ্য রেখেও মানুষ গোয়ালায় আসবেন পণ্য নিতে। কেন আসবেন?


শফিউলের ভাষ্য, অন্য পাঁচটি ব্র্যান্ডের পণ্য থেকে আমি যদি গোয়ালার পণ্যের গুণগত মান শতভাগ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে একজন ক্রেতা গোয়ালার পণ্য নিয়মিত নেবেন। কারণ আমি অন্যদের থেকে একটু ভিন্নভাবে আমার দুগ্ধপণ্য তৈরি করার চেষ্টা করি। ক্রেতাদের সাইকোলজিটা বুঝে, তাদের পছন্দ, রুচি, চাহিদার কথা মাথায় রেখে পণ্যে গুণগত মানটা নিশ্চিত করি। কত বেশি ক্রেতা দই কিনল, সেটা আমার টার্গেট না। যারাই পণ্য কিনবে তারা যেন খেয়ে তৃপ্ত হতে পারেন। খুশি থাকেন। গোয়ালার পণ্য যেন ক্রেতাদের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে সেটাই আমার মূল টার্গেট।


শফিউল আলমের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বিবার্তার স্টাফ রিপোর্টার উজ্জ্বল এ গমেজ


সুস্থ থাকার জন্য খাঁটি দুধের ভূমিকা অনেক। গ্রামে খাঁটি দুধ সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু শহরের মানুষের জন্য এটা অধরা। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি দুধ নিয়ে নানা কথা ওঠায় মানুষের বিশ্বাসও নড়বড়ে হয়ে গেছে। দুই কোটি মানুষের বাস এ শহরে। সবারই খাঁটি দুধের প্রয়োজন রয়েছে। গোয়ালার পক্ষে তো আর সবার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। তবে বাজারে খাঁটি দুধের যে চাহিদা রয়েছে, সেটা ধরতেই কাজ করছে গোয়ালা। বললেন শফিউল।


গোয়ালাকে নিয়ে শফিউলের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে ডেইরি খাতে বড় কোম্পানি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে কাজ করছে গোয়ালা। দেশের দুগ্ধজাত পণ্য খাতে বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। দুধের নিয়মিত গ্রাহকভিত্তিক সরবরাহ বা সাবস্ক্রিপশন মডেলও প্রথম চালু করতে যাচ্ছে গোয়ালা।


প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শফিউলের ভাষ্য, আমরা কাজ করছি মূলত ডেইরি টেক নিয়ে। খাঁটি দুধ ও দুধজাত পণ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করাই আমাদের কাজ। বাংলাদেশে এটা একটা নতুন উদ্যোগ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখি ডেইরিতে গুণগত মানসম্পন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য বাংলাদেশে দক্ষ ব্যক্তি নেই। ভারত থেকে দুজনকে হায়ার করে আনার চুক্তি করেছি। তাদের দিয়ে আমাদের কার্যক্রম চালাতে হবে। আমাদের দেশে ডেইরি টেক নিয়ে শিক্ষার জন্য ডিপ্লোমা কোর্স চালু করাটা সময়ের দাবি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com