শিরোনাম
জটিল রোগের কাছেও হার মানেননি উদ্যোক্তা সালমা রহমান আঁখি
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৫২
জটিল রোগের কাছেও হার মানেননি উদ্যোক্তা সালমা রহমান আঁখি
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’ জনপ্রিয় সংগীত প্রতিযোগিতার আসর ক্লোজ আপ ওয়ান তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ-এর থিম সংটির সাথে মিলে গেছে ফ্যাশন ডিজাইনার উদ্যোক্তা অনলাইন বেইজ ফ্যাশন হাউস আঁখিস কালেকশনের স্বত্বাধিকারী সালমা রহমান আঁখির জীবন।


অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো আঁখিও স্বপ্ন দেখতেন একদিন নিজে কিছু করার। ছোটবেলা থেকেই নিজের পোশাকে নিজে নকশা করতে ভালোবাসতেন। আর এই ভালোবাসাই এক সময় তাকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের পথে হাঁটতে প্রেরণা জুগিয়েছে। অদম্য মনোবল আর ডিজাইনিংয়ের প্রতি ভালোবাসা ব্রেইন টিউমারের মতো জটিল রোগও তাকে আটকে রাখতে পারেনি বিছানায়। বিছানায় বসে সুঁই-সুতার ফোঁড়ে বুনেছেন নান্দনিক নকশা। তার লক্ষ্য ছিল অটুট আর বিশ্বাস ছিল হৃদয়ে। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি হয়েছেন বিজয়ীনী।



উদ্যোক্তা সালমা রহমান আঁখি


রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত শহরে বেড়ে ওঠা আঁখির শেখার প্রতি ছিল অদম্য নেশা। ভাললাগার বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ তাকে ব্যাকুল করে তুলতো। কিশোরী মনের জানার সেই কৌতূহল মেটাতেই ছুটে যান ট্রেনিং সেন্টারে। ১৯৯৮ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে পরিচালিত কারিগরি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ব্লগিং, আইটি, টেক্সটাইল ডিজাইন বিশেষ করে জুটের নক্সার উপরে ট্রেনিং নেন।


কলেজে পড়াশোনার পাশিাপাশি ট্রেনিংয়ের শিক্ষাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন আঁখি। শুরু করেন নিজের পোশাক ডিজাইনিংয়ের কাজ দিয়ে। একদিন একটা পোশাক বানিয়ে পরে স্কুলে গেলে বান্ধবীরা বেশ প্রশংসা করেন। বলেন, আঁখি পোশাকটা দারুণ হয়েছে তো! পোশাকটাতে তোকে মানিয়েছে বেশ। এটার মতো করে আমাকে একটা বানিয়ে দিবি? অন্য একজন বলেন, ডিজাইনটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। চালিয়ে যা। একদিন তুই অনেক বড় ডিজাইনার হবি। এসব বিষয়গুলো এনজয় করতেন আঁখি। সবার এতো বেশি প্রশংসা তার কিশোরী মনে কখন যে ফ্যাশন ডিজাইনের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা জন্মে যায় সেটা তিনি বুঝতেও পারেননি। একসময় তার মনে হলো, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে আলাদা করে নিজের জন্য কিছু একটা করলে মন্দ হয় না। সেই ভাবনা থেকে কলেজে পড়ার সময়ে নিজের উপরে আত্মবিশ্বাস, কাজের নেশা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে চালু করেন বুটিক শপ। তখন সব কিছু একাই করতেন। পরিচিতজন ছাড়াও আশপাশের অনেকের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলেন।


সব সময় তিনি চেষ্টা করতেন কীভাবে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে করা নকশা ও ডিজাইনগুলো আরো নান্দনিকভাবে পোশাকের ক্যানভাসে তুলে ধরা যায়। এভাবে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল আঁখির বুটিক শপের কাজ। বেশ ব্যস্ত সময় কাটছিল তার।


পারিবারিক কারণে গ্র্যাজুয়েশনের পর বিয়েটাও সেরে ফেলেন আঁখি। তাকে দেশের বাইরে যেতে হয়। থেমে যায় তার ব্যবসার কাজ। সংসার জীবনে এলো নতুন অতিথি। ছেলের মা হলেন আঁখি। অনেক দিন থাকেন সেখানে। এরপর দেশে ফিরে আসেন।



ফ্যাশন ডিজাইনার আঁখি


হঠাৎই জানতে পারেন নিজের ব্রেইন টিউমারের কথা। প্রথমে বুঝতে পারেননি। ভাবছিলেন, ছেলেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁটাহাটির ফলে মাথা ব্যথা করছিল। পরীক্ষা করে জানতে পারেন ব্রেইন টিউমারের কথা। স্বামীর ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে নিয়ে অপারেশন করানোর। কিন্তু হাতে সময় ছিল অল্প। আর যাওয়া হলো না দেশের বাইরে। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালেই সফলভাবে ব্রেইন টিউমারের অপারেশন করানো হয় আঁখির। অদম্য সাহসিকতা দিয়ে ব্রেইন টিউমারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন। চিকিৎসক দীর্ঘ বিশ্রাম দেন। বিছানাতে শুয়েই কাটতো তার দিনরাত। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগতো না আঁখির। তার মা ও বড় বোন সুঁই-সুতার ফোঁড়ে বুনতেন হরেক রকমের হ্যান্ড স্ক্র্যাচ। তার নেশা যেহেতু ছিল ডিজাইন করা, তাই বিছানায় শুয়ে প্রতিনিয়ত শেখেন ডিজাইনের নানা দিক। তারা কোথা দিয়ে, কীভাবে সুঁইটা ঢুকাচ্ছে, কীভাবে বের করছে, এভাবে তাদের কাজ দেখে হ্যান্ড স্ক্র্যাচ শেখেন। যখন ভাল লাগতো তখন বিছানায় বসে বসে পোশাকের হ্যান্ড স্ক্র্যাচ করতেন। যখন মনে নতুন যা আইডিয়া আসতো তখনই সেটা স্ক্র্যাচ করে জমিয়ে রাখতেন। মনের জোর ছিল। আমি তো একদিন ভাল হবোই। তখন এ ডিজাইনগুলো দিয়ে আবার পুরোদমে ব্যবসাটা শুরু করবো।


২০০১ সাল। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে দুইজন কর্মী নিয়ে আবার পুরোদমে ব্যবসার শুরু করেন অদম্য এই উদ্যোক্তা। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবসাটা এবার তারা শুরু করেন অনলাইন ও অফ লাইনে। তবে তেমন মার্কেটিং করতে হয়নি তাদের। তাদের সুন্দর কাজ মুগ্ধ করেছে ক্রেতাদের। প্রথমে পরিচিত জনদের মাঝে, এর পরে ধীরে ধীরে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের কাস্টমারদের মন জয় করেছে আঁখির কাজ। ব্যবসার পরিচিতি বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে বিক্রি। বিক্রি বাড়ার ফলে তাদের আয় বাড়তে থাকে। সুযোগ হচ্ছে অনেকের কর্মসংস্থানের। এখন তার সঙ্গে কাজ করছেন অনেক নারী ও পুরুষ।


বিভিন্ন বিশেষ দিবস উপলক্ষে পোশাকের চাহিদা এত বেশি হতো যে, সারা রাত ধরে কাপড় কাটতেন আর ভোরে কারখানায় নিয়ে যেতেন। বাসায় এনে সুঁই-সুতার কাজ করতেন। একটা পোশাক বিক্রির টাকা হাতে পেয়ে ছুটে যেতেন মার্কেটে। আবার দুটি পোশাকের জন্য কাপড় কিনে নকশা করে বানিয়ে বিক্রির পর আস্তে আস্তে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন আঁখি।আঁখিস কালেকশন বিভিন্ন উৎসবে থিমভিত্তিক পোশাক তৈরি করে। পরিবারের ছোট-বড় সবার জন্য একই রকম পোশাক তৈরি করা যাবে এখান থেকে। হাতের কাজ, ব্লক, টাইডাই, মেশিন এমব্রয়ডারি, কারচুপিসহ নানা মাধ্যম নিয়ে কাজ করছেন ডিজাইনার আঁখি। বৈশাখ, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে বাহারি রঙ আর নকশার পোশাক মিলবে এখানে।



ছেলের সাথেফ্যাশন ডিজাইনার আঁখি


বর্তমানে রাজধানীর মালিবাগে একটি ছোট্ট শোরুম আছে। যেখানে লেডিস থ্রি-পিছ, কুর্তি, শাড়ি, সেলোয়ার, কামিজ, ওড়না, ছেলেদের পাঞ্জাবি ও ফতুয়া আছে। দেশের বাইরেই তার বেশি প্রোডাক্ট যায়। কাপল সেট থেকে শুরু করে বেবিদের ড্রেসও তিনি তৈরি করে থাকেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন কোয়ান্টিটি না বাড়িয়ে কোয়ালিটিফুল কিছু করতে। আর অনলাইন প্লাটফর্ম ‘আঁখিস কালেকশন’ তো রয়েছেই।


অনলাইন ব্যবসার প্রধান বাধাগুলোর নিয়ে আঁখির ভাষ্য, আমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। ছেলে বা মেয়ের জন্য সালোয়ার, কামিজ, থ্রি-পিছ, শাড়ি-পাঞ্জাবি যাই ডিজাইন করছি। অনলাইনে ব্যবসা করার কারণে যে কোনো কাপড়ের ডিজাইন করে অনলাইনে দিতে হয়। আর ওই শাড়ির ডিজাইনটা অনলাইনে দেয়ার সাথে সাথেই চুরি হয়ে যায়। অন্য একজন সেটা দেখে কাজ করে ব্যবসা করে নিয়ে যায়। যেমন-২০১৭ সালে পহেলা বৈশাখে একটা শাড়ির ডিজাইন করেছিলাম। সেটা অনলাইনে এতো রেকর্ড পরিমাণ বিক্রি হয়েছিল যে সেই শাড়ির ডিজাইনটা যদি চুরি না হতো তাহলে আমি পুরো ব্যবসাটা একাই করতে পারতাম। আর হয় তো এক কোটি টাকা আমার প্রোফিটে থাকতো। অনলাইন ব্যবসায়ীদের জন্য কপিরাইট আইনটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে এসব সমস্যা আর থাকবে না বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।


এখন অনলাইন ব্যবসায় অনেক প্রতিযোগিতা। প্রতি পদে পদে এই প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয় প্রত্যেকজন অনলাইন ব্যবসায়ীকে। প্রতিবেশি দেশ ভারত, পাকিস্তান থেকে প্রতিনিয়তই আসছে নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক। তবে আশার কথা হলো, যে ভাল কাজ করবেন, যার ডিজাইন ভাল হবে তিনি ব্যবসায় সফল হবেনই বলে ধারণা আঁখির।


এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আঁখিস কালেকশানের ডিজাইন করা বৈশাখি শাড়ির জন্য অপেক্ষা করেন ক্লায়েন্টরা। গত বৈশাখে একটা ডিজাইনের শাড়ির হাজার হাজার পিস সেল হওয়ার রের্কড এখন পর্যন্ত আঁখিস কালেকশানেরই। কাস্টমাররা যদি আমার উপর ভরসা না রাখতেন তাহলে এটা কখনই সম্ভব হতো না। তারাই আমার আশীর্বাদ। সব সময় আমাকে সাহস দেন পাশে থাকেন। বললেন আঁখি।



আরজে নিরবের সাথে আঁখি


তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আঁখির ভাষ্য, কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চান তাহলে তাকে বলবো যে, প্রথমে আপনাকে মার্কেট রিসার্চ করে বের করতে হবে বাজারে এখন কোন প্রোডাক্টের চাহিদা বেশি। যে জিনিসটা নিয়ে কাজ করবেন সেটা যেন হয় একটু ভিন্ন ধরণের। যেটার প্রতি ক্রেতার আগ্রহ আছে। মানুষ খুঁজে বেশি। আমি ড্রেস নিয়ে কাজ করলাম বলে আপনিও ড্রেস নিয়ে কাজ করবেন এ জিনিসটা খুব খারাপ লাগে। এখন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার অনেক সেক্টর আছে। যেমন- কেউ জুট নিয়ে, কেউ চামড়া নিয়ে, কেউ আবার অর্নামেন্ট নিয়েও কাজ করতে পারেন। যার যার পছন্দের জিনিস নিয়ে কাজ করতে পারেন। তবে কোথায় গেলে সেগুলো সেল করা যাবে। কে বা কারা এই প্রোডাক্টটার গুরুত্ব বুঝবে, কিনবে। এই ক্ষেত্রটা আগে খুঁজে বের করলে ব্যবসা করার সব কিছুই সহজ হয়ে যায়। আশার কথা হলো- আমরা যখন অনলাইন ব্যবসা শুরু করি তখন এসব বিষয়ে শেখার এতো সুযোগ ছিল না। আর এখন তো হাতে কলমে কাজ শেখার অনেক ট্রেনিং সেন্টার আছে। যে কোনো কিছু সম্পর্কে শেখার জন্য তো ইউটিউব চ্যানেল আরো ভাল।



ডিজাইনিংয়ের কাজ করছেন আঁখি


ছোট একটা টিপ নিয়েই কাজ শুরু করতে পারেন একজন উদ্যোক্তা। তবে কাজের প্রতি শতভাগ আন্তরিকতা থাকতে হবে। কাজকে ভালোবাসতে হবে। কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ হতে হবে। সময় বুঝে ব্যবসা করতে হবে। কে কি বলছে তাতে কান দেয়া যাবে না। উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে আর ধৈর্য ধরে পরিল্পিতভাবে কাজ করলে সফলতা ধরা দেবেই। বললেন আঁখি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com