শিরোনাম
রুবাইয়া জাহান রুপার ‘মা ফ্যাশন’র পেছনের গল্প
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:১১
রুবাইয়া জাহান রুপার ‘মা ফ্যাশন’র পেছনের গল্প
‘মা ফ্যাশন’ এর স্বত্বাধিকারী রুবাইয়া জাহান রুপা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

রুবাইয়া জাহান রুপা। থাকেন বগুড়াতে। নিজের হাতে তৈরি ড্রেস পরার ইচ্ছেটা ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। মূলত এই ইচ্ছা শক্তির কারণেই অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্নটাকে আরো বড় করে ভাবতে শুরু করেন। মনের জোর থাকলে মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে থেকে যেকোনো কাজেই যে জয়ী হতে পারেন রুপা তার প্রমাণ। ছোটবেলার সেই ইচ্ছেটা তার আজ পূরণ হয়েছে। তিনি এখন নিজের হাতে ড্রেস তৈরি করেন, মানুষকে দিয়ে তৈরি করান আর সেগুলো অনলাইনে বিক্রি করে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন।


রুপার ই-কমার্স উদ্যোক্তা হয়ে উঠাটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সে গল্প জানতে হলে যেতে হবে আরো অনেক পেছনে।


রুপার বেড়ে উঠা বগুড়াতেই। মা-বাবা ভাইকে নিয়ে তাদের ছোট পরিবার। ভাইয়ের বয়স যখন চার বছর আর তার মাত্র ১৩ মাস, তখন বাবা চলে যান না ফেরার দেশে। শুরু হয় তাদের সংগ্রামের জীবন।



রুপার পরিবার


বগুড়া শহরে বাবার রেখে যাওয়া দোকান আর মার অল্প কিছু জমিই ছিল তাদের চলার একমাত্র অবলম্বন। মা দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক কষ্টে তাদের তিল তিল করে বাবার অদর-যত্ন আর ভালোবাসায় ধীরে ধীরে বড় করেন।


এদিকে ভাইটা দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করবে বলে আবদার করলে তাকে অনেক কষ্টে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে বাইরে পাঠানো হয়। ভাগ্যদেবী তো সবার প্রতি প্রসন্ন হয় না। রুপার ভাইয়ের বেলাতেও তাই হয়েছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ভাইটি বেশিদিন আর দেশের বাইরে থাকতে পারলেন না। চলে আসেন দেশে। পড়াশোনা তো হলোই না। সঙ্গ দোষে ভাইটা মানুষও হলো না। অনেক চেষ্টা করেও কোনো ভাল চাকরির ব্যবস্থা হলো না তার।


২০০৮ সালে বগুড়ার মজিবুর রহমান মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন রুপা। জীবনে চরম টানাপোড়নের সময় যাচ্ছিল তার। মায়ের একার পক্ষে তখন আর সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। মায়ের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম রুপাকে ভাবাতো। কষ্টগুলো তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। তাকেও বড় হয়ে যাতে এমন কষ্ট না করতে হয় তাই তিনি জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। একদিন বড় হবেন নিজের পায়ে দাঁড়াবেন মায়ের সব কষ্টগুলো দূর হবে। সুখে কাটিয়ে দেবেন বাকিটা জীবন। কিন্তু সবার ভাগ্যে তো আর সে সুযোগ আসে না। তাই নিজে থেকেই ভাগ্য বদলের চেষ্টা শুরু করেন। বাধ্য হয়ে বেছে নেন কাপড় কাটা আর সেলাইয়ের কাজ। কিন্তু তিনি তো তখনো কিছুই জানেন না। কীভাবে কাপড় কেটে সেলাই করে সেই কাপড়ের উপরে ডিজাইন করতে হয়।


খোঁজ নিয়ে নিজের এলাকাতেই কারুচুপি, এপ্লিক এসব কারুকার্যের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে নিজের জন্য একটা কারুচুপি কাজের জামা তৈরি করেন। সেটা পরে শৈশবের নিজের হাতে তৈরি ড্রেস পরার ইচ্ছেটা পূরণ করেন। সেই থেকে শুরু। শুরুতে ছোট পরিসরে অফ লাইনে ব্যবসা করেন। যা আয় হতো তা দিয়ে তার হাত খরচটা বেশ ভালই চলতো। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে তার স্বপ্নটা।



রুপা ও তার মেয়ে


২০১৪ সাল। সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অনেকেই অনলাইনে ব্যবসা করছেন। অন্যরা করতে পারলে আমি পারবো না কেন? আমিও পারবো। যেই ভাবা সেই কাজ। ফেসবুকে একটা পেজ খুলেন রুপা। স্বপ্নের ব্যবসার পেজ। কী নাম দেয়া যায়? মা-ই জীবনের সব কিছুর অবলম্বন। মাকে ভালোবেসে পেজটা মায়ের নামেই রাখেন ‘মা ফ্যাশন’। কেননা এই ব্যবসার অনুপ্রেরণার উৎস হলেন তার মা।


‘মা ফ্যাশন’ পেজে নিয়মিত কিছু আপডেট দিতে থাকেন। সবাই জানতে থাকেন। টুকটাক বিক্রিও হয়। আস্তে আস্তে জানাজানির পরিধি বাড়ে। এক সময় লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসীদের চোখে পড়ে তার হাতের তৈরি পোশাক। কাজের গুণগত মান দেখে নিয়ে ব্যবহার করেন। ভাল লাগায় ওই কাস্টমাররা বার বার অর্ডার করতে থাকেন। তারাও নিজের পরিচিতদের মধ্যে ‘মা ফ্যাশন’ এর পোশাকের ব্র্যান্ডিং করেন। এভাবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘মা ফ্যানে’র জনপ্রিয়তা। ব্যবসাটাও জমে উঠে রুপার। এখন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়মিত কাপড়ের অর্ডার আসে।


রুবা ই-কমার্স, এফ-কমার্স বিষয়ে বেশি কিছু জানতেন না। জীবনে কঠিন বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠা অধুনিকা তরুণীর মনে সব সময় খেলা করতো কি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। ফেসবুকের কল্যাণে ই-কমার্সের বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয় তার। ই-কমার্স কী, কি করে ব্যবসা করতে হয়, কী করলে ব্যবসার প্রচার, প্রসার বিক্রি বেশি করা যায়, কোন ব্যবসা কোনো পদ্ধতিতে করলে ক্লায়েন্টদের ধরে রাখা যায় প্রয়োজনীয় সব কিছু।


২০১৬ সালে বিয়ে হয় রুপার। থেমে যায়নি তার স্বপ্নের পথ চলা। বিয়ের পরে স্বামীর আন্তরিক সহযোগিতায় ব্যবসা আরো ভাল করে চলতে শুরু করে। পরের বছরেই কোল আলো করে তাদের সংসারে আসে ভালোবাসার ফসল। মেয়ের মা হন রুপা। ব্যবসায় কাজের চাপ বাড়তে থাকে। ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে কাজের অর্ডার নেয়া, সে অনুসারে কাপড় কেনা, ক্লায়েন্টদের পছন্দের ডিজাইনে কাটা, সেগুলো কর্মীদের বুঝিয়ে দেয়া, ঠিকঠাক মতো, গুণগত মনসম্পন্ন হয়েছে কিনা সেগুলো মনিটরিং করা। কাজ শেষ হলে ওই সব ক্লায়েন্টদের আবার পাঠিয়ে দেয়া। সবই মা ও স্বামীর সহায়তায় করেছেন।


বর্তমানে দেশীয় পণ্য নিয়ে ভাল সাড়া পাচ্ছেন রুপা। এখন এপ্লিক নিয়ে কাজ করেছেন। এগুলো হলো- এপ্লিক বেডশিট, শাড়ি, ওয়ানপিস, টুপিস, থ্রিপিস, কুসন কভার, পাঞ্জাবি, কটি, বেবিদের জামা ইত্যাদি।


মায়ের আদর্শে বড় হওয়া সংগ্রামী তরুণীটি বিয়ে হয়ে তার সমস্ত ভাবনা সংসার ঘিরেই। সংসারের সব কিছু সামলিয়ে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে স্বপ্লের ব্যবসাটা চালিয়ে যাচ্ছেন।



ব্যবসার কাজে ব্যস্ত রুপা


প্রথম অবস্থায় মা ফ্যাশনে মাত্র ১০ জন কর্মী কাজ করতেন। এখন কাজ করছেন ৭০-৮০ জন কর্মী। এখানে সব ধরনের পরিবারের মেয়েরাই কাজ করছেন। তারা এখানে কাজ করে তাদের পরিবারকে সুন্দরভাবে আর্থিক সহযোগিতা করছেন।


‘মা ফ্যাশন’ রুপার সন্তানের মতো। মেয়েকে যেমন আদর যত্নে ভালোবাসায় বড় করছেন। ঠিক তেমনি ‘মা ফ্যাশন’ উদ্যোগটাও অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষা ও অনেক সাধনা করে আজ এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। এর প্রতি রয়েছে তার সন্তানতুল্য ভালোবাসা। এই উদ্যোগটাকে নিয়ে অকে দূর যাওয়া পরিকল্পনা রয়েছে রুপার। ‘মা ফ্যাশন’ এর প্লাফর্মের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যকে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি। দেশের ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ দেশীয় পণ্য কিনলে যাতে মা ফ্যাশনকে খোঁজে সে অনুসারে প্রতিটা পণ্যে গুণগত মানসম্পন্ন করে তৈরি করছেন। মা ফ্যাশন প্রোডাক্টের কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী। উদ্যোগটি একদিন অনেক বড় হবে। অনেক বেকার নারী এসে এখানে এসে কাজ করবে। সে প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছেন অদম্য এই নারী উদ্যোক্তা।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com