শিরোনাম
উদ্যোক্তা সালেহা বেগমের জীবন সংগ্রাম
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৩৬
উদ্যোক্তা সালেহা বেগমের জীবন সংগ্রাম
নাজমুন নাহার নুপুর
প্রিন্ট অ-অ+

সবাই স্বপ্ন দেখেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, বাড়ি-গাড়ি করার। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল আত্মনির্ভরশীল হওয়ার, পরিবারে, সমাজে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও সততা নিয়ে কাজ করেছেন। এখন তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।


বলছিলাম সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা ‘স্বপ্ন কথা বিডি’র স্বত্বাধিকারী সালেহা বেগমের কথা।


সালেহার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরুতে কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু কঠিন সময়গুলোতে কাউকেই তিনি পাশে পাননি। বারবার হোঁচট খেয়েছেন। পড়েও গেছেন। আবার একাই উঠে হেঁটেছেন উদ্যোক্তা জীবন পথে। এভাবে আজ তিনি নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে।



‘স্বপ্ন কথা বিডি’র স্বত্বাধিকারী সালেহা বেগম


কঠিন বাস্তবতার সাথে সংগ্রাম করে তিনি প্রমাণ করেছেন একজন উদ্যোক্তার জীবনে ব্যর্থতা বলে কোনো শব্দ নেই। হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই উদ্যোক্তা জীবন। বারবার হেরে গিয়েও হারিয়ে যাওয়া যাবে না একজন উদ্যোক্তাকে। নিজের কর্মগুণে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সাথে হতাশাগ্রস্তদের দেখিয়েছেন পথের আলো। শিখিয়েছেন নিজের ও দশের জন্য কাজে উদ্যোগী হয়ে কর্মসংস্থান করার মত আত্মপ্রত্যয়।


সালেহা ছিলেন বাবা-মায়ের বড় সন্তান। বড় হওয়াতে তার উপর দায়িত্ব ছিল একটু বেশি। ছোটবেলা থেকেই তার লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। সে স্বপ্ন নিয়ে স্কুলজীবন শুরু করেন। এরপর ধারাবিাহিকভাবে দশম শ্রেণিতে উঠলে তার জীবনের দৃশ্যপট যায় বদলে। স্কুলপড়া যে মেয়েটি বান্ধবীদের সাথে হেসে-খেলে আর পড়াশোনা করে জীবন কাটাবে। তখনই তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়েটি মেনে নেন সব কিছুই নিরবে। ‍শুরু নতুন জীবন, কঠিন সংগ্রাম। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। কোনো প্রিপারেসন নেই। সে অবস্থাতেই এসএসসি পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল তাকে একাই। শ্বশুর বাড়ি থেকে পরিক্ষা দেন সালেহা। কেউ কোনো সাহায্য করেননি তাকে। অনেক কষ্টে পাস করেন এসএসসি।


কলেজের ভর্তিযু্দ্ধটাও করেছেন একাই। কলেজে ভর্তি হন। পাস করেন। আবারো কারো সাহায্য ছাড়াই একাই ডিগ্রিতেও ভর্তি হন। এরই মধ্যে তার কোল আলো করে আসে দুই ছেলে-মেয়ে। অন্যদিকে শ্বশুর বাড়িতে থেকে ছোট ভাইও লেখাপড়া করছিল। শ্বশুর-শাশুড়ি ও জেঠা শ্বশুরের বড় সংসারের সবগুলো মানুষের দায়িত্ব পালন করে লেখা-পড়া চালিয়ে যাওয়াটা সালেহার জন্য ছিল অনেক কষ্টের। শুধু অদম্য ইচ্ছাশক্তি জন্য মানবিক থেকে ২য় বিভাগে পাস করেন তিনি। সব সময় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন সালেহা।



আত্মপ্রত্যয়ী নারী সালেহা বেগম


তিনি বলেন, আমার লক্ষ্য ছিল এমন কিছু করবো যার দ্বারা অন্তত কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সেই সাথে যেন দেশীয় কোনো কাজে নিজকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি। সব সময় এটাই আমার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছিল। আর এ জন্য হাতের কাজ ব্লক বাটিক জামদানি ও মসলিন শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করি। স্বপ্ন ছিল দেশীয় পোশাকগুলো একদিন দেশ-বিদেশে সবার মাঝে তুলে ধরার।


বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন ও জামদানি শাড়িগুলোকে কিভাবে আরো সুন্দর করে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় তাই নিয়েই কাজ শুরু করেন ‘স্বপ্ন কথা’ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সালেহা বেগম।


কাজ চলছিল। কিছুদিন পরে বাধে বিপত্তি। স্বামী সরকারি চাকরিজীবী, বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি সকলেই নিজ নিজ পদে প্রতিষ্ঠিত, ব্যবসা-বাণিজ্য করার চিন্তা কোনো পুরুষেই করেন না, সেখানে একজন নারী বা বাড়ির বৌ হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কেউ বিশ্বাস করতেই চাননি। এ বিষয়ে শ্বশুর বাড়ির কেউ সাপোর্ট করতো না। সবাই বলতো জামাই সরকারি চাকরি করেন। কি দরকার এসব কিছু করার। অবহেলা আর অবজ্ঞায় ব্যর্থতায় পর্যবাসিত করতে চেয়েছিল তার প্রাথমিক উদ্যোগকে। কিন্তু বরাবরের মত নিজের পরিচয় তুলে ধরার জন্য বাড়িতে বসে ব্যবসার পক্ষে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।


অবশেষে ২০০০ সালে স্বামীর অনুমতি নিয়ে শুরু হয় স্বপ্নপূরণের যাত্রা। বাড়িতেই স্বল্প পরিসরে ব্লক-বাটিক ও এমব্রয়ডারি কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০৪ সালেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। মেয়ের পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে আসতে হয় তাকে। লস গুণতে হয় প্রায় দুই লাখ টাকার মতো। কেননা গ্রামের ব্যবসায়ীরা কেউ আর নগদ টাকা দেয়নি। এমন কি পরবর্তী সময়ে আর পাওনা টাকাও ফেরত দেয়নি।



নারী উদ্যোক্তা সালেহাবেগম


যদি থাকে দৃঢ় প্রত্যয় তবে কোনো প্রতিবন্ধকতাই সামনে টিকতে পারে না। সালেহা একজন আত্মপ্রত্যয়ী স্বাধীনচেতা মানুষ। তাই সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ঢাকাতেই নতুন করে আবার শুরু করেন ব্যবসা।


ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে প্রাপ্ত ১২ হাজার টাকা দিয়ে নিজের জন্য দুটো শাড়ি কিনেন একটি জামদানি ও অন্যটি মসলিন। দুটো শাড়িতেই এমব্রয়ডারি করেন। বিয়ে বাড়িতে সকলেরই শাড়ি দুটো খুব পছন্দ হয়। ওই অনুষ্ঠানেই তিনি ১০টি শাড়ির প্রথম অর্ডার পান।


অর্ডারটা তাকে ফেলে দিল বিপাকে। এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার। শাড়ি ও মেশিন কিনতে হবে, কাজ করতে হবে এবং ডেলিভারি খরচও লাগবে। তাই নিজের জমানো টাকায় গড়া ডিপিএস ভেঙে গড়ে তোলেন ছোট্ট একটা কারখানা। এরপর নিজেই সোনারগাঁ থেকে জামদানি ও সপুরা থেকে মসলিন এনে নিজ হাতে এমব্রয়ডারি ডিজাইন করেন।



নিজ প্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তা সালেহা বেগম


ডেলিভারি হাতে পেয়ে ক্রেতারা সকলেই অনেক খুশি হয়েছিলেন এবং কাজের প্রশংসা করেন। এই প্রশংসা সালেহার কাজের গতিকে বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ। ফুরফুরে আমেজে শুরু করেন কাজের পরবর্তী ধাপ।


এবার জামদানিতে তাতাল, ব্লক, বাটিক, এমব্রয়ডারি করে তা হোলসেলে বিক্রি করতে শুরু করেন। কিছু দিন চলছিল বেশ ভালোই। হঠাৎ করেই তার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ভাগ্যদেবী। আবারো লোকসানে পড়েন তিনি। এক পরিচিত ক্রেতা ১০টি শাড়ি নিয়ে দাম না দিয়েই চলে যান। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে লোকসান গুণতে হয়েছে প্রায় লাখখানেক টাকা।


নিরলস পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে একটা সময়ে নিজের কাজ সম্পর্কে পরিবারের সকলকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন সালেহা। পরিবারের সকলেই ব্যবসা সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। তখন সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় আবারো ৫০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। নতুন উদ্যম নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। তার প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয় অসংখ্য মানুষের।


বর্তমানে অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও বেশ ভালো অর্ড়ার পান এই উদ্যোক্তা। অনলাইনে গ্রাহকদের সেবাকে সহজ করে দিতে ‘স্বপ্ন কথা বিডি’ নামে একটি ফেসবুক পেজ রয়েছে তার। এখানে গ্রাহকরা শাড়ি হাতে পেয়ে ও ব্যবহার করে ফিডব্যাক দিয়ে থাকেন। গ্রাহকের ফিডব্যাকে তিনি অনেক সন্তুষ্ট।


এখন সালেহার দ্বিতীয় স্বপ্ন হলো তার ‘স্বপ্ন কথা’কে বিশ্ব দরবারে পৌঁছানো। আর এ স্বপ্ন পূরণ করতেই নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইম্যান অ্যান্ড ই-কামার্স ফোরামে (উই) আসেন তিনি।



অবসরে নারী উদ্যোক্তা সালেহা বেগম


সালেহা বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জনপ্রিয় গ্রুপ উই। এখানে দেশি পণ্যকে নিয়ে কাজ করা উদ্যোক্তাদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানে অনেক বড় বড় গুণী নারী উদ্যোক্তারা রয়েছেন। তাদের ভীড়ে জানি না আমার মতো এমন ছোট মানুষের স্থান হবে কিনা, বা আমার এ স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা। তবে এই সংগঠনে এসে রাজিব আহমেদ স্যারকে প্রতিদিন একটু একটু করে জেনেছি। আমার অভিজ্ঞতায় উদ্যোক্তাদের জীবনে রাজিব স্যার অন্যতম অনুপ্রেরণার নাম। একজন উদ্যোক্তাকে তার ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, কী কী কৌশল অবলম্বন করতে হয়, উদ্যোক্তা জীবনের সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উনার গ্রুপগুলোতে বিশেষভাবে উইয়ের পেজে পেস্টের মাধ্যমে তুলে ধরছেন। আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথ আরো ‍সুগম হয়েছে। আশা করছি উইয়ের হাত ধরে একদিন আমার স্বপ্ন পূরণ হবেই।


জীবনের প্রাপ্তির বিষয়ে সালেহার ভাষ্য, কঠিন বাস্তবতার মধ্যে থেকেও আমার জীবনের প্রাপ্তিটা অনেক বেশি। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল সেটা পূরণ হয়েছে। নিজে আত্মনির্ভরশীল হতে চেয়েছি। সেটাও হয়েছি। আল্লাহর দান আমার ছেলে-মেয়ে আজ সবাই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। ছেলে ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করে গ্রামিণফোনে চাকরি করার পর স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ডিগ্রি অর্জন করেছে। আর মেয়ে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করে আহসানিয়া মিসনে লেকচারার হিসাবে কাজ করছে। আর ছোট ছেলে পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়াংয়ে।



ছেলে মেয়ের সঙ্গে উদ্যোক্তা সালেহা বেগম


নিজের ব্যবসার পাশাপাশি যুব উন্নয়নের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অদম্য এই উদ্যোক্তা। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে উদ্যোক্তা হওয়ার বীজ বপন করছেন। স্বপ্ন দেখেন ই-কমার্সের হাত ধরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে দেশি পণ্য পৌঁছে দিতে, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশি পণ্যকে ভালোবেসে আপন করে নিতে পারেন। আর সে লক্ষ্য পূরণেই অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন কথা প্রতিষ্ঠানটি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com