শিরোনাম
‘ইউটিউবে শুরুতেই যদি আয় করতে চান, মুখ থুবড়ে পড়ে যাবেন’
প্রকাশ : ১৫ মে ২০১৯, ১১:৪৯
‘ইউটিউবে শুরুতেই যদি আয় করতে চান, মুখ থুবড়ে পড়ে যাবেন’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

বড় ভাইদের দেখতেন অনলাইনে কাজ করে আয় করছেন। এটা তাকে বেশ টানতো। কিন্তু কীভাবে ইন্টারনেট থেকে আয় করা যায় সে পথটা জানা ছিল না। মনের অদম্য আগ্রহ থেকেই ২০০৭ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হন মেহেদি হাসান (ঈশান)। তবে মাঝে পড়ালেখার কারণে সেটা করা হয়ে উঠেনি।


২০১৩ সালে স্মার্টফোন দিয়েই বিভিন্ন সাইটে ঘুরে বেড়াতেন এবং ইন্টারনেট থেকে আয়ের পথ খুঁজতেন। তা করতে গিয়ে ঈশান বুঝতে পেরেছিলেন অনলাইনে আয়ের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে যেসব সাইটগুলো আলোচনা করে, সেগুলোর অনেক কিছুই ভুয়া।


তাহলে কীভাবে ইন্টারনেট থেকে আয় করবো? অনলাইনে এ নিয়ে করেন পড়াশুনা। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে প্রযুক্তি বিষয়ক ব্লগ টেক টিউনস এবং সামুতেও কিছু লেখালেখি করেন।


প্রযুক্তির প্রতি ভাললাগার টানেই পরিকল্পনা করেন অনলাইনে আয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ে একটা সাইট বানানোর। ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে নজর পরে ইউটিউবে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে জেনেছেন ইউটিউবের মাধ্যমে আয় করা যায়। বাংলাদেশেও অনেকে আয় করছেন। তবে ওই সময় বিশ্বস্ত তেমন কাউকে পাননি যার থেকে এই বিষয়ে শেখা যায়।


অনলাইনে টিউটোরিয়াল দেখে নিজেই একদিন ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলেন। পরে এ নিয়ে করেছেন প্রচুর পড়াশোনা। বড়দের সাহায্য নিয়েছেন। শুরুতে অনেক কিছুই বুঝতেন না। তাই অনেকগুলো চ্যানেল সাসপেন্ডও হয়েছে। থেমে যাননি। যে বিষয়গুলোতে বারবার ঝামেলা হচ্ছিল সেগুলো সমাধান করে ইউটিউবে বিচরণ শুরু করেন। ২০১৭ সালের ১৬ মে থেকে তার প্রফেশনালভাবে পথ চলা শুরু।



ঈশানের জন্ম ঘাটাইল সেনানিবাসে। শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে রাজবাড়ী জেলা সদরে। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। কেটে গেল প্রায় দুই দশকের বেশি সময়। এখানকার কংক্রিটের চার দেয়ালেই বেড়ে উঠেন অদম্য এই ফ্রিল্যান্সার।


শৈশব নিয়ে ঈশান বলেন, শৈশবে আমি অনেক চঞ্চল ছিলাম। প্রচুর বাইরে ঘুরে বেড়াতাম। এমনও হয়েছে বাসায় কাউকে কিছু না বলেই বন্ধুদের সাথে দূরে চলে যেতাম। আবার দুপুরে কিংবা বিকেলে ফিরে আসতাম। কখনো বাসায় ফেরার পরে আম্মু অনেক মারতো। আবার কখনো বা খেতে দিতো না। তবে বড় হওয়ার সাথে সাথেই বাইরে ঘুরে বেড়ানোর শখটা অনেক কমে গেছে।


রাজধানীর ফার্মগেটস্থ তেজগাঁও গভ. হাই স্কুল থেকে কমার্স বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন ঈশান। এরপর অনেকটা নাটকীয়ভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চলে আসেন। ইচ্ছা ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে (সিএ) পড়ার। ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিউট থেকে স্থাপত্য বিভাগে ডিপ্লোমা শেষ করে গুলশানের প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষের পথে। এখন স্ট্রাকচারের উপর থিসিস চলছে। এরপর পরিস্থিত বুঝে এমএসসি কিংবা এমবিএ করার পরিকল্পনা রয়েছে।


নানান প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে ইউটিউবের মাধ্যমে আয় করতে গিয়েও ঈশানকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার মতো অন্য ইউটিউবাররা যাতে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে না হয় তাই তিনি ‘অনলাইন হেল্প ৩৬০’ নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল চালু করেন।


এ বিষয়ে ঈশানের ভাষ্য, যখন ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে শিখতে শুরু করেছি, তখনই ভেবেছি আমি যা শিখবো, তার সবকিছুই অনলাইনের মাধ্যমেই ছড়িয়ে দেবো। অনলাইনের মাধ্যমে প্রযুক্তির যে কোনো বিষয়ে সবাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো। তাই চ্যানেলের নাম দিয়েছি ‘অনলাইন হেল্প ৩৬০’।


চ্যানেলের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ঈশান বলেন, ইউটিউবের কন্টেন্ট তৈরি করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন ইউটিউবারের ভিডিও দেখি এবং সেগুলো অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া ভিডিওর পেয়েছি। তখনই আমি আমাদের দেশের বেকার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবেছি। তারা যেন খুব সহজে অনলাইনে সঠিক সাইটের খোঁজ পেয়ে কম হোক আর বেশি হোক আয় করতে পারেন। সেই জন্যই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।


তিনি বলেন, তবে বেশিরভাগ সময় ইনকামভিত্তিক ভিডিও বানাতে গিয়ে আফসোস হয়। কারণ আমাদের দেশে পেপ্যাল নেই। যদি পেপ্যাল থাকতো তাহলে আমি আরো কয়েকগুণ মানসম্মত ইনকামভিত্তিক সাইটগুলো সবার কাছে তুলে ধরতে পারতাম।


দেশে পেপ্যাল না থাকায় ফ্রিল্যান্সারদের কষ্টের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ঈশান বলেন, দেশে ফ্রিল্যান্সারদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। তবে পেপ্যাল যদি থাকতো তাহলে ফ্রিল্যান্সারদের কষ্ট অনেক কমে যেতো। অনেক বড় বড় ক্লায়েন্ট চলে যায় কেবল পেপ্যাল না থাকার কারণে। সবাই কিন্তু আপনার নিজের সুবিধা মতো পেমেন্ট দেবে না। বেশিরভাগ ক্লায়েন্টই তাদের নিজের ইচ্ছামত মাধ্যমে পেমেন্ট দিতে পছন্দ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটাই চাওয়া যে, আমাদের অনলাইনের কাজটা আরো বেগবান করতে পেপ্যালটা খুব বেশি দরকার। আশা করি তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।



ইউটিউব চ্যানেলের নিয়ম-কানুন নিয়ে এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, আমি যখন প্রথম শুরু করেছিলাম তখন চ্যানেল খুললেই মনেটাইজ থাকতো। এরপর নতুন নিয়ম হয়েছিল যে, ১০ হাজার ভিউ হলে তারপরে মনেটাইজ দেয়া হবে। সর্বশেষ হলো আপনার চ্যানেলে শেষ ১২ মাসে এক হাজার সাবস্ক্রাইবার এবং চার হাজার ঘণ্টা ওয়াচটাইম হতে হবে। এরপর সেটা রিভিউতে যাবে। যদি চ্যানেলের কন্টেন্ট তাদের রুলস অনুযায়ী হয় তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মনেটাইজ দেয়া হবে।


তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন প্রতি হাজারে একটা নির্দিষ্ট অংক পেমেন্ট করা হয়। তবে আসল কথা হলো, ভিডিওতে যেসব বিজ্ঞাপন দেখানো হয় সেগুলোতে ক্লিক না পড়লে কোনো টাকা দেয়া হয় না। ভিডিওতে ওয়ান মিলিয়ন ভিউ হল কিন্তু অ্যাডস ক্লিক হল না, তাহলে কোনো টাকা দেয়া হয় না।


‘অনলাইন হেল্প ৩৬০’ চ্যানেল থেকে ইতোমধ্যেই ঈশানের আয় হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। চ্যানেল মনেটাইজের পর থেকে কেউ যদি নিয়মিত ভিডিও দিতে থাকে, তাহলে মাসে ১৫-৩০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। যতদিন যাবে আয় কেবল বৃদ্ধিই পাবে। স্পন্সর, বিজ্ঞাপন থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করা সম্ভব।


ইউটিউব চ্যানেলের আয়টা নির্ভর করে একজন উইটিউবার কতভাবে আয় করতে চান তার উপর। বেসিক্যালি এখানে অ্যাডসেন্স থেকে আয় হয়। এটা হচ্ছে প্রাইমারি নিয়ম। এছাড়াও অনেকে অ্যাফিলিয়েট, স্পন্সর থেকেও অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। অ্যাডসেন্স ছাড়া বাকিগুলো চ্যানেলটা কত বড় এবং কেমন কন্টেন্ট তৈরি করা হয় তার উপর নির্ভর করে।


ঈশানের অর্জনের ঝুলিতেও উঠেছে বেশি কিছু পুরস্কার। এ বিষয়ে তার ভাষ্য, ইউটিউব থেকে সিলভার প্লে-বাটন হতে পারে আমার জীবনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দামি পুরস্কার। সেটা এখনো হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে আশা করছি শিগগিরই এটা পেয়ে যাবো। এরপর ইউটিউবে ১ লাখ ৬২ হাজার সাবস্ক্রাইবারের প্রতিটা সাবস্ক্রাইবার আমার কাছে একেকটা পুরস্কারের মতো মনে হয়। তবে ছোটবেলায় স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার রয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বাংলা ও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতেও একাধিক পুরস্কার রয়েছে। এরপর কলেজ লাইফেও স্পোর্টসে পুরস্কার রয়েছে অনেকগুলো। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো এখন কেবলই স্মৃতি।


এখন থিসিস নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটে ঈশানের। মাঝে মাঝে প্রাইভেটে ইঞ্জিনিয়ারিংভিত্তিক কাজ করেন। চ্যানেলের নামে একটা ব্লগ রয়েছে, সেখানেও টুকটাক লেখেন। ‘এক টাকার ফান্ড’ নামে ছোট একটা চ্যারিটি তহবিল গঠন করেছেন। সেখানে সময় দেন। পথশিশুদের নিয়ে মাঝে মাঝে কাজ করেন। ঈশানের অবসর কাটে এভাবেই।


‘অনলাইন হেল্প ৩৬০’এর মাধ্যমে সব সময় দর্শকদের প্রয়োজন মতো সঠিক ও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করতে চান ঈশান। দেশে অসংখ্য তরুণ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তারা যেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের সকল খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তার চ্যানেল থেকে শিখতে পারেন সে চেষ্টাই করছে যাচ্ছেন। খুব শিগগিরই তার চ্যানেলে কর্মমুখী শিক্ষা নিয়ে সিরিজ শুরু হচ্ছে। আর ই-কমার্স নিয়েও কাজ করতে চান তরুণ এই ফ্রিল্যান্সার। দেশের ই-কমার্স সেক্টর ঘিরে রয়েছে নানান সমস্যা। নিজের বিজনেসকে সেসব সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে ই-কমার্স নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।


নতুন ইউটিউবারদের প্রতি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন উদীয়মান এই ফ্রিল্যান্সার। তার মতে, নতুন যারা ইউটিউবে কাজ করতে আগ্রহী তাদের জন্য প্রথম কথা হচ্ছে, ইউটিউবে কেন আসতে চাচ্ছেন সেটা আপনাকে বের করতে হবে। আপনি আয় করতে চান, নাকি আপনি যা জানেন সেগুলো সবার সাথে শেয়ার করতে চান? যদি আয় করতে চান, তাহলে বেশিদূর যেতে পারবেন না। খুব দ্রুত মুখ থুবড়ে পড়ে যাবেন। সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আপনি যা তৈরি করছেন সেগুলো থেকে যেন মানুষ কিছু শিখতে পারেন সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটে টিকে থাকতে চাইলে অবশ্যই অনেক চিন্তা করতে হবে। এমন কিছু দিতে হবে যা নিয়ে কেউ সেভাবে কাজ করেনি। কিংবা করলেও যেন আপনার ভিডিওতে আরো বেশি ইনফরমেশন থাকে সেটা নিশ্চিত করতেই হবে। শুরুতে ভিউ পাবেন না। এটা নিয়ে টেনশন করবেন না। যা কিছু বানাবেন সেটা প্রচার করতে অনলাইনে প্রচুর পরিমাণে শেয়ার করুন। ধীরে ধীরে আপনার দর্শক শ্রেণি তৈরি হবে। আর এসইও নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক ভিডিও রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করুন।


তিনি বলেন, আরেকটা কথা হচ্ছে, অন্যের ভিডিও চুরি করবেন না। এটা আপনার সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দেবে। মনে রাখবেন, দুনিয়াতে যত মানুষ রয়েছে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বিষয়ে এক্সপার্ট। আপনি কোনটা করতে পছন্দ করেন সেটা খুঁজে বের করুন এবং সেটা নিয়েই কাজ করুন। সাফল্য পেতে বেশি দেরি হবে না। আর শর্টকাট পথে কখনো সফল হওয়া যায় না। সাফল্য পেতে আপনাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে। তাহলেই কেবল আপনি হতে পারবেন আগামীর নতুন ইউটিউব স্টার।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com