শিরোনাম
চটপটি বিক্রেতা থেকে ফ্রিল্যান্সার শাওন
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:১২
চটপটি বিক্রেতা থেকে ফ্রিল্যান্সার শাওন
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

বাবা চটপটি বিক্রি করতেন। পড়ালেখার পাশাপাশি প্রতিদিন দোকানে চটপটি বিক্রিতে বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। সামান্য চটপটি দোকানদারের ছেলে বলে জীবনে বড় কোনো স্বপ্ন দেখার সুযোগও হয়নি তার। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আজ খেলে কাল দিনটা কীভাবে কাটবে সেটা নিয়েই তার টেনশনে থাকতে হতো। তাই পড়ালেখা করে মনেপ্রাণে মানুষের মতো মানুষ হতে চেয়েছিলেন তিনি। আর একটু ভালভাবে থাকাটাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। এখন তিনি ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে গড়ে আয় করছেন ২৫০০-৩০০০ মার্কিন ডলার।


বলছিলাম চাঁদপুরের তরুণ ফ্রিল্যান্সার মো. রায়হানুর রহমান (শাওন) এর কথা। বর্তমানে তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজে গণিতে মাস্টার্স করার পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। সেই সাথে নেক্সাস আইটি ইনস্টিটিউটের প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


সম্প্রতি এক আড্ডায় কথায় কথায় শাওন জানালেন তার ফ্রিল্যান্সিং জীবনের নানান ঘটনার কথা।


পড়ালেখার পাশাপাশি বাবাকে দোকানে চটপটি বিক্রি করাতে সাহায্য করাই ছিল শাওনের নিয়মিত কাজ। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একদিন বাবা অনেকটা জোর করেই এক কাজিনের প্রেসে তাকে চাকরির জন্য পাঠান। পড়ালেখা ছাড়া কম্পিউটারের উপরও কিছুটা দখল ছিল তার। তবে গ্রাফিক্স ডিজাইনে তেমন কোনো দক্ষতা ছিল না। বাবার কথা মতো নতুন চাকরি। তবে করতেই হবে। তাই শুরু করেন নতুন চ্যালেঞ্জ। ওই অফিসের গ্রাফিক্স ডিজাইনারের সাথে থেকে থেকে একটু একটু করে গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখতে শুরু করেন। তারপরে ওইখানেই অন্য এক প্রেসে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে জয়েন করেন।



চাকরি করেন আর পড়ালেখা করতে থাকেন। সব সময় ভাবতেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের ‍উপরে ভাল একটা ট্রেনিং কোর্স করতে পারলে আরো অনেক ভাল ডিজাইনার হওয়া যেতো। তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে সব সময় তিনি নজর রাখতেন কোথায় এ বিষয়ে কোর্স করানো হয়। একদিন হঠাৎ ফেসবুকে দেখেন চাঁদপুরে সরকারের লানিং অ্যান্ড আনিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে (এলইডিপি) অধীনে পরিচালিত প্রফেশনাল আউসোসিং ট্রেনিং কোর্সে জন্য ছাত্রদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কোনো আগপিছ চিন্তা না করেই তাতে অ্যাপ্লাই করেন শাওন। তার চোখে এখন একটাই স্বপ্ন একজন ভাল গ্রাফিক্স ডেজাইনার হওয়া।


শাওন বলেন, ভাইভা দিয়ে টিকে যাই। তখন ওই চাকরিটা ছেড়ে দেই। চাঁদপুরেই শুরু করি গ্রাফিক্স ডিজাইনের কোর্স। আমার ট্রেইনার ছিলেন সোহেল ইয়াহিয়া এবং জাহাদুল ইসলাম স্যার। আমি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে স্যারদের কথানুসারে ক্লাসের সব কাজগুলো করতাম। নিয়মিত বাড়ির কাজ করে বেশি কিছু কিভাবে শেখা যায় সে ভাবনায় থাকতাম সব সময়। স্যার দুজন অনেক আন্তরিক ও সাহায্যকারী ছিলেন। আমাকে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে অনেক সুন্দর করে শিখিয়েছেন কীভাবে গ্রাফিক্স ডিজাইন করতে হয়। থিউরিটিক্যাল ও প্রাকটিক্যাল দুটাই অনেক ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন। স্যারদের সহযোগিতায় আমি অনেকটা দ্রুতই ডিজাইনের কাজগুলো আয়ত্ব করে ফেলি। কোর্স চলাকালীন আমি ফ্রিলান্সারডটকমে একটা কন্সটেস্ট উইন হবার পরে আমার ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায় দ্বিগুণ। তার ৬মাস পর থেকেই শুরু হয় আমার ফ্রিল্যান্সিংয়ের ইনকাম।


শাওন এখন ফাইভার মার্কেটপ্লেসে লোগো এবং স্টেশনারী আইটেম ডিজাইন নিয়েই কাজ করছেন। পাশাপাশি নেক্সাস আইটি ইনস্টিটিউটের ইন্টার্নিদের ট্রেনিং করানো এবং প্রোডাকশান সেকশনের কাজও করছেন।



কাকে দেখে ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনুপ্রেরণা পেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শাওন জানালেন, আমার কাজের অনুপ্রেরণা ট্রেইনার জাহাদুল ইসলাম ভাই। তাকে দেখতাম ট্রেইনিংয়ের পাশাপাশি বাসায় ফ্রিল্যান্সিং করতেন। এর আগে আমি নিজের উপর আস্থাই রাখতে পারছিলাম না। আসলেই আমি এই কাজ পারবো কিনা। পরে জাহাদ স্যার আমার কাজের উন্নতি দেখে এক প্রকার জোর করেই এই পথে আনেন। মো. ইকরাম স্যারের কথাও আমাকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছে। তারপরে আস্তে আস্তে নানান চ্যালেঞ্জিং সময়ের পথ চলা। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম একনিষ্ঠ সাধনা আর অধ্যবসায়ের ফলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হতে থাকা এবং শেষে পুরোপুরি ফ্যিল্যান্সার হয়ে যাওয়া। ট্রেইনাররা সবচেয়ে বেশি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তারাই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আর তাদের দেখেই আমি মনে অনুপ্রেরণা পাই যে আমি ফ্রিলান্সিং করতে পারবো।


ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রথম যখন সফল হন তখন তার অনুভুতি ছিল বিশ্ব জয়ের। তার ভাষায়, প্রথম সফলতার অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো না। এটা যেন বিশ্ব জয় করার মতো অনুভূতি। আমি তখন অনেক কনটেস্টে অংশগ্রহণ করতাম, কিন্তু সাকসেস হচ্ছিলাম না। এক দিন রাতে হঠাৎ জাহাদ স্যার ফোন দিয়ে বললেন, আমি নাকি ১০০ ইউরোর একটা কনটেস্টে উইন করেছি। কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ ছিলাম। হতবাক ছিলাম তখন। বুঝতে পারছিলাম না স্যার কি সত্যিই বলছিলেন কিনা। সেটা ছিলো আমার ফ্রিল্যান্সিং জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর অন্যতম।


শাওনের এই সফলতার পেছনে রয়েছেন সবার আগে তার বাবা-মা। যারা তার ফ্রিল্যান্সার হয়ে উঠার পেছনে সব ধরণের সাপোর্ট দিয়েছেন। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য তারা শাওনকে একটা কম্পিউটারও কিনে দিয়েছেন। এরপরে রয়েছে তার ট্রেইনার জাহাদুল ইসলাম, সোহেল এবং গ্রেট মো. ইকরাম স্যার।



ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শাওন বলেন, ফ্রিল্যান্সিং কাজের শুরুতে ফাইভারে প্রথম দুইটা প্রজেক্টেই আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। কারণ প্রথম দুইটা ক্লায়েন্টই ছিলো ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানি। তারা একটা কাজের অনেক রিভিশন করিয়ে কাজ কমপ্লিট করানোর পরই অর্ডার ক্যান্সেল করে দেন। কিন্তু আমি থামিনি। আল্লাহর রহমতে ওই আইডি দিয়েই আমি আজকে টপ রেটেড সেলার হতে পেরেছি ফাইভারে।


মার্কেটপ্লেসে কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে শাওন জানান, যার যে মার্কেটপ্লেসে কাজ করার ইচ্ছা তার সে মার্কেটপ্লেসের নিয়ম জানা থাকতে হবে। ক্লাইন্টের সাথে পারসোনাল ইনফরমেশন শেয়ার না করতে এবং ফ্রিল্যান্সিং কাজে কোনো অনৈতিক পথ অবলম্বন না করার পরামর্শ দেন তিনি।


এই কাজে আগ্রহীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আগে প্রচুর প্র্যাকটিস ও পরিশ্রম করে নিজেকে পার্ফেক্ট করতে হবে। অবশ্যই যে কোনো একটি সেক্টরে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রফেশনাল হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কনটেস্টে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে নিজের কাজের পরিধি যাচাই করার জন্য। গ্রাফিক্স ডিজাইনার হলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে যেখানে সারা পৃথিবীর ভালো ডিজাইনাররা তাদের আপডেট কাজ শেয়ার করেন। সেখানে তাদের ফলো করা ও নতুন কনসেপ্ট সম্পর্কে আইডিয়া নেয়া। হতাশ হওয়া চলবেই না। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই আগে বা পরে।


ফ্রিল্যান্সিংকেই ফুলটাইম পেশা হিসেবে নিতে চান শাওন। পাশাপাশি নেক্সাস আইটিকে দেশের সেরা একটি আইটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য কাজ করছেন। দুইটাই তার কাছে সমান। আর ৩ বছর পর নিজেকে আরো ভালো জায়গায় দেখতে চান। তবে একাজে নিজে একা না। আরো ফ্রিলান্সারদের নিয়ে ভাল কিছু কাজ করতে চান তিনি। শাওনের ইচ্ছা যারা ফ্রিল্যান্সার হতে চান তাদেরকে সাহায্য করতে। আর এভাবেই বাংলাদেশকে ফ্রিল্যান্সিং জগতে শীর্ষে আনার ব্যপারে নূন্যতম ভূমিকা রাখতে নিজের দক্ষতাকে আরো বাড়াতে প্রতি দিন একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com