শিরোনাম
অদম্য উদ্যোক্তা সাদিয়া ইসলাম মিতুর স্বপ্নযাত্রা
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:১৬
অদম্য উদ্যোক্তা সাদিয়া ইসলাম মিতুর স্বপ্নযাত্রা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

বাবা-মার ইচ্ছে ছিল মেয়ে পড়াশোনা করে ভালো একটা চাকরি করবে। কিন্তু সাদিয়া ইসলাম মিতু চাইতেন চাকরি নয় স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করতে। বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ার সময় থেকেই চিন্তা করেছেন যেহেতু বিজনেসে পড়ছেন, তাই নিজে থেকে কোনো একটা সময়োপযোগী বিষয়ে ব্যবসা করার। এমন কিছু করতে যাতে সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। নিজের উপরে আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তার সে ইচ্ছে আজ পূরণ হয়েছে। আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা।



অনলাইন প্লাটফর্ম ‘বাহারিকা’-এর স্বত্বাধিকারী সাদিয়া ইসলাম মিতু


সাদিয়া ইসলাম মিতুর এই উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে নানান চড়াই-উতরানোর গল্প।এটি জানতে হলে যেতে হবে আরো অনেক পেছনে।


ছোটবেলা থেকেই আঁকা-আঁকি বা ডিজাইনের প্রতি একধরনের নেশা ছিল মিতুর। রাত জেগে নতুন কিছু তৈরি করতে ভালবাসতেন। এতে তার কোনো ক্লান্তি কাজ করতো না কখনোই।পেইন্টিংয়ের কাজ শেখার প্রতি ছিল অদম্য আগ্রহ।বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নামিদামি কোম্পানির ব্র্যান্ড দেখে স্বপ্ন দেখতেন একদিন তারও হবে নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড।ক্যাটস আই, সাদা কালো, লারিভ ও আড়ংয়ের মতো ব্র্যান্ড।


জীবনকে নিয়ে সবাই বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখে থাকেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্নগুলোর পরিবর্তন আসে। ঠিক একইভাবে শুধু একটি বিষয় নিয়ে কখনোই সন্তুষ্ট ছিলেন না মিতু। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষ চাইলে পর্যায়ক্রমে একসাথে অনেক কিছুই করতে পারেন।কলেজ পড়ার সময় থেকেই বিষয়গুলো মিতুকে ভাবাতো।


মিতু ছোটবেলা থেকে বয়সের তুলনায় খানিকটা লম্বা হওয়ায় সবাই তাকে মেজর সাব, কর্নেল, আর্মি এসব বলেই ডাকতেন।কানের কাছে বাজতে থাকা এই শব্দগুলো একটা সময় তার স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে এই পেশার প্রতি তিনি আত্মিক বন্ধন অনুভব করেন। শৃঙ্খলা, শ্রদ্ধাবোধ আর সবমিলিয়ে মনে হয়েছে তার জন্য এই পেশাটাই মানানসই ও সঠিক হবে।


২০০৫ সাল থেকে স্কাউটিং শুরু করেন মিতু।২০০৯ সালে সিনিয়র পেট্রল লিডার হিসেবে মনোনিত হন।পর্যায়ক্রমে তিনি বিভিন্ন জাম্বুরি প্রোগামে অংশ গ্রহণ করেন।২০০৮ সালে ১১৯টি দেশের মধ্যে জাম্বুরি প্রোগাম হয় গাজীপুরের মৌচাকে।



উদ্যোক্তা মেলায় নিজের দোকানে সাদিয়া ইসলাম মিতু


এ বিষয়ে মিতুর ভাষ্য, আমরা জাজিরা মোহর আলী মডেল হাই স্কুল গার্লস ইন স্কাউট সেখানে অংশগ্রহণ করি এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হই।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে আমাদের সকলকে উপহার দেন।তারপর ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট স্কাউটে এক্সাম দেই এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সার্টিফিকেট দেন।


স্কাউটিংয়ের পাশাপাশি বিতর্ক, ক্রাফটিং, ড্রেস ডিজাইন আর আঁকা-আঁকি ছিলো তরুণীর নেশা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পেইন্টিং ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়ছেন বহুগুণে গুণান্বিতা তরুণ মেধাবী এই শিক্ষার্থী।


বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজের বিএনসিসিতেও যুক্ত ছিলেন মিতু। এরপর জীবনের ক্যারিয়ারের সিদ্ধান্ত নেয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে প্রথম বাঁধার সম্মুখীন হন তিনি। চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতির জন্য হয়ে উঠেনি।পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান হওয়ায় সামরিক বাহিনীর স্বপ্নটাও থেমে যায় তার।


মিতু মনে করেন, পড়াশোনা কেবল শেখার জন্য, জানার জন্য, চাকরি জন্য না। চাকরিতে ডুবে থাকা হয়তো তার পক্ষে সম্ভব নয়।তিনি বলেন, বিষয়টা যখন অন্তরে অনুভব করেছি তখন থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছি, যা করে আমি তৃপ্তি পাই তা নিয়েই পরে থাকতে।



অনলাইন প্লাটফর্ম ‘বাহারিকা’-এর স্বত্বাধিকারী সাদিয়া ইসলাম মিতু


২০১০ সালে সোনালী পাতি আর পুথির সংমিশ্রণে ধুপিয়ান কাপড়ে প্রথম কারচুপির কাজ করেন সুঁই সুতো দিয়ে। ২০১৩ সালে ব্যবসার উদ্দেশে ফেসবুকে পেজ খুললেও সফল হননি। তারপর তিনি দীর্ঘদিন হন্যে হয়ে খুঁজেছেন ব্যবসার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা ও মূলধন জোগানের সহায়তার। কিন্তু তাতেও সফল হননি।


যেহেতু নিজে থেকে কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার, তাই একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন বহুদিন। ক্রাফটিং, ড্রেস ডিজাইন আর আঁকা-আঁকির কাজ জানা থাকায় সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসা করার।কিন্তু পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটতে পারে মনে করে পরিবার সম্মতি না দিলেও অনেকটা জেদের বসেই শুরু করলেন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার জীবন।২০১৭ সালে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ নিজের হাত খরচের জমানো টাকায় যাত্রা শুরু হয় স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘বাহারিকা’র।অদম্য ইচ্ছাশক্তিই ছিলো তার বড় পুঁজি। বাবা একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় ব্যবসার সাথে ভালোবাসাটা রক্তে মিশে থাকার মতোই মনে হয় মিতুর।


‘বাহারিকা’এক স্বপ্নের নাম। পোশাক ও হস্তশিল্পের অনলাইনভিত্তিক এই প্লাটফর্মে রয়েছে ফ্যাশন সম্পর্কিত সকল ধরনের পণ্য।তার নিজের ডিজাইনে তৈরি পণ্যের মধ্যে রয়েছে হ্যান্ডপেইন্ট, কারচুপি, এমব্রয়ডারি, ব্লক, বাটিক, স্ক্রিণপ্রিন্ট, হাতে তৈরি গয়না, হাতে আঁকা টিপ, সৌখিন আসবাবপত্র, ক্যানভাস, ওয়াল পেইন্ট, ক্রাফটিং, ওয়াল মেট, ওয়েস্টার্ন টপ্স, কুর্তি, বাচ্চাদের ড্রেস, ওয়েডিং গাঊন, লেহেঙ্গা, শাড়ি, পাঁটজাত দ্রব্য, লেদার, গামছা, মসলিন, জামদানি, সুতি ইত্যাদি।এসব পণ্যের মূল্য মাত্র ৩০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নানান পণ্যের বিপুল সমাহার নিয়ে বাহারিকা ধীরে ধীরে তার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।


ব্যবসায়ে শুরু থেকেই প্রতিবন্ধকতা ছিল মিতুর। মেয়ে হয়ে ব্যবসায় শুরু করা ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।এছাড়া কাস্টমার ডিলিংস, অর্ডার ক্যান্সেল হওয়া প্রতিনিয়ত এক একটা চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হতে হয়েছে তার। তারপরেও দমে যাননি বরং শক্তি ও সাহস বাড়িয়েছেন দিন দিন। ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা তৈরি করেছেন প্রতিদিন। তিনি মনে করেন উদ্যোক্তারা চ্যালেঞ্জকে সানন্দে গ্রহণ করে এটাই তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই।


ব্যবসায়িক জীবনে এসে অনেকেই তাকে ‘বাহারিকা’ আপু নামেই ডাকেন এবং চেনেন।আর এটা তার অর্জনের প্রথম ধাপ বলে মনে করেন সাদিয়া। তিনি চান তাকে সবাই তার ব্রান্ড হিসেবেই চিনুক।



উদ্যোক্তা মেলায় নিজের দোকানে সাদিয়া ইসলাম মিতু


জলরঙ দিয়েই তার পেইন্টিংয়ে হাতেখড়ি। বিভিন্ন ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন এবং তার পেইন্টিং সাবমিট করেছেন।বিভিন্ন সম্মাননা এবং সার্টিফিকেট কুড়িয়েছেন সেই স্কুল এবং কলেজের গণ্ডিতেই।


সামান্য হাত খরচের টাকা থেকেই একা একা ‘বাহারিকা’র পথ চলা। আর এখন এই একা বাহারিকার হাত শক্ত করে দাঁড়িয়েছে আরো অনেকগুলো হাত। প্রায় তিন বছরে ভালোবাসা পেয়েছে অসংখ্য ক্রেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের। বিভিন্ন উদ্যোক্তা সেমিনার ও প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে বাহারিকা। সম্মাননা ও প্রশংসা কুঁড়িয়েছে বেশ।


এসএমই ফাউন্ডেশন, চাকরি করব না চাকরি দেব, উইবিডি, বি'ইয়া, উইসহ সহযোগিতাপূর্ণ সকল প্রতিষ্ঠানকে পাশে থাকা ও দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মিতু।


মিতুর ভাষ্য, জীবনে সফলতার কোনো সীমা নেই।একটার পর একটা সফলতা যেমন আসবে, তেমনি বাধা-বিপত্তিও আসবে। যেকোনো সময় ঝুঁকি নেয়াই একজন ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্য। সুতরাং ভীত হওয়া যাবে না। থেমে থাকা যাবে না। পাছের লোকে অনেক কিছুই বলবে, এদের কথায় কান দিতে নেই। নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের থেকে দূরে থাকতে হবে।নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে।কটূক্তিকারীদের কথায় কান না দিয়ে ধৈর্য ধরে সাবলম্বী হয়ে সকলে মিলেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।


ভবিষ্যৎ নবীন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে মিতু বলেন, কাউকে দেখে নয়, কারো কথায় নয়, নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করুন।নিজেকে বুঝুন। আপনি কি চান? আদৌ কি চান? তারপর কাজ বা পণ্যের কাটাগরি নির্ধারণ করুন।কয়েক দিন ব্যবসা করে মার্কেট নষ্ট করা কারো কাছেই কাম্য নয়।এতে নিজের সময় নষ্ট করবেন এবং আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং ব্যবসায়ের প্রতি বিরূপ চিন্তা লালন করবেন।



‘বাহারিকা’র শাড়ির মডেলদের সাথে সাদিয়া ইসলাম মিতু


মিতুর উদ্দেশ্য নারীদের নিয়ে কাজ করার, নারীরাও ব্যবসা থেকে ভাল কিছু করতে পারেন তা প্রমাণ করা।আমিও পারি এই কথা যাতে প্রতিটি নারী বলতে পারেন।তাই অদূর ভবিষ্যৎতে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের সাবলম্বী হতে সাহায্য করবেন বাহারিকার ট্রেইনাররা। যদিও এরমধ্যেই স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বেশ সংখ্যক কর্মচারী বাহারিকার হয়ে কাজ করছেন। অদূরে আরো বাড়বে বলেই আশাবাদ মিতুর।


‘বাহারিকা’ নিয়ে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন দেখেন স্বপ্নবাজ এই উদ্যোক্তা। বর্তমানে ব্যবসাটা অনলাইনভিত্তিক। স্বপ্ন দেখেন ক্রেতাদের সুবিধার্থে অদূর ভবিষ্যতে ‘বাহারিকা’র নিজস্ব শো-রুম করার।এই প্রতিষ্ঠানে বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার। আর এভাবে ধীরে ধীরে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের বেকারত্ব দূর করার।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com