শিরোনাম
যে শিশুদের পথই চলার ‌ঠিকানা
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১৬:২২
যে শিশুদের পথই চলার ‌ঠিকানা
ফাদার বিকাশ‌ ‌কুজুর‌, সিএসসি‌
প্রিন্ট অ-অ+

পথশিশু‌ ‌বা‌ ‌টোকাইদের‌ ‌নিয়ে‌ ‌অনেক‌ ‌রসাত্মক‌ ‌ও‌ ‌ব্যঙ্গাত্মক‌ ‌রচনা‌ ‌আছে।‌ ‌কিন্তু‌ ‌তাদের‌ ‌জীবন‌ ‌আসলে‌ ‌ততোটা‌ ‌রসময়‌ ‌নয়।‌ ‌এই‌ ‌সকল‌ ‌শিশুরা‌ ‌মূলত‌ ‌পথে-ঘাটে‌ ‌ঘুরে‌ ‌বেড়ায়।‌ ‌অনেকেরই‌ ‌কোনো‌ ‌পরিবার-পরিজন‌ ‌নেই।‌ ‌পথই‌ ‌তাদের‌ ‌চলার‌ ‌পথ।‌ ‌পথই‌ ‌তাদের‌ ‌ঠিকানা।‌


এদের‌ ‌অনেকেই‌ ‌কারো‌ ‌না‌ ‌কারো‌ ‌ত্যাজ্য‌ ‌বা‌ ‌অবৈধ‌ ‌সন্তান।‌ ‌আবার‌ ‌বিভিন্ন‌ ‌কারণে‌ ‌বাড়ি‌ ‌থেকে‌ ‌পালিয়ে‌ ‌শহরে‌ ‌আসা‌ ‌পরিচয়হীন‌ ‌শিশুরাও‌ ‌এই‌ ‌দলে‌ ‌যোগ‌ ‌দেয়।‌ ‌পাশাপাশি,‌ ‌নদী‌ ‌ভাঙন,‌ ‌সহায়-সম্বল‌ ‌হারানো‌ ‌যে‌ ‌সকল‌ ‌মানুষ‌ ‌বাঁচার‌ ‌আশায়‌ ‌শহরে‌ ‌চলে‌ ‌আসে‌ ‌তাদের‌ ‌সন্তানেরা‌ ‌এবং‌ ‌স্বজনহারা‌ ‌অনেক‌ ‌শিশুও‌ ‌শহরে‌ ‌এসে‌ ‌এই‌ ‌তালিকায়‌ ‌যুক্ত‌ ‌হচ্ছে।‌ ‌ফলে‌ ‌পথশিশুদের‌ ‌সংখ্যা‌ ‌প্রতিনিয়তই‌ ‌বাড়ছে।‌


যে‌ ‌বয়সে‌ ‌হাতে‌ ‌বই-খাতা,‌ ‌চোখে‌ ‌স্বপ্ন,‌ ‌খেলাধুলা,‌ ‌দুরন্তপনা,‌ ‌বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা‌ ‌পাওয়ার‌ ‌কথা‌ ‌সে‌ ‌বয়সে‌ ‌তারা‌ ‌হাতে‌ ‌চায়ের‌ ‌কেতলি‌ ‌বা‌ ‌ফুটো‌ ‌বস্তা,‌ ‌চোখে‌ ‌ধোঁয়া,‌ ‌মালিকের‌ ‌অবজ্ঞা‌ ‌এমনকি‌ ‌সন্ত্রাসী‌ ‌ও‌ ‌মাদকসেবীদের‌ ‌সহযোগী‌ ‌হতে‌ ‌বাধ্য‌ ‌হয়।‌


ছবিতে‌ ‌লেখক বাম দিক থেকে প্রথম‌ ‌ক্রস‌ ‌চিহ্নিত।


‌ক্লাশ‌ অ্যাসাইনমেন্টের‌ ‌জন্য‌ ‌কোনো‌ ‌বিষয়‌ ‌নিব‌ ‌তা‌ ‌ভাবছিলাম।‌ ‌তখন‌ ‌ঢাকার‌ ‌বনশ্রীতে‌ ‌থাকি।‌ ‌মাঝে‌ ‌মাঝেই‌ ‌একদল‌ ‌পথশিশুকে‌ ‌চলাফেরা‌ ‌করতে‌ ‌দেখতাম।‌ ‌তাই‌ ‌ভাবলাম‌ ‌তাদের‌ ‌নিয়েই‌ ‌অ্যাসাইনমেন্টটা‌ ‌করা‌ ‌যাক!‌


তবে মনে কিছুটা ভয় আর দ্বিধা কাজ করছিল তারা‌ ‌আমার‌ ‌সাথে‌ ‌কথা‌ ‌বলতে‌ ‌চাইবে‌ ‌কি‌ ‌না‌ ‌বা‌ ‌কতটুকু‌ ‌স্বচ্ছন্দ্য‌ ‌হবে‌ ‌সে‌ ‌বিষয়ে।‌ ‌একদিন‌ ‌তাদের‌ ‌খোঁজে‌ ‌বের‌ ‌হই।‌ ‌ঘুরতে‌ ‌ঘুরতে‌ ‌হঠাৎ‌ ‌এক‌ ‌জায়গায়‌ ‌তাদের‌ ‌পেয়ে‌ ‌যাই।‌ ‌কাছে‌ ‌গিয়ে‌ ‌দু’একটি‌ ‌কথা‌ ‌বলতেই‌ ‌দেখলাম‌ ‌তারা‌ ‌বেশ‌ ‌স্বতস্ফূর্ত।‌


‌তাই‌ ‌তাদের‌ ‌মনস্তাত্ত্বিক‌ ‌দিক‌ ‌বিবেচনায়‌ ‌করে‌ ‌জানতে‌ ‌চাইলাম‌ ‌তাদের‌ ‌কী‌ ‌খেতে‌ ‌ইচ্ছে‌ ‌ করে।‌ ‌তারা‌ ‌বলল‌ ‌যে,‌ ‌তাদের‌ ‌ঝলসানো‌ ‌মুরগি‌ ‌খাওয়ার‌ ‌খুব‌ ‌ইচ্ছা।‌ ‌আমি‌ ‌তাদের‌ ‌অভয়‌ ‌দিয়ে‌ ‌বললাম‌ ‌যে,‌ ‌তাদের‌ ‌তা‌ ‌দেয়া‌ ‌হবে;‌ ‌তবে‌ ‌শর্ত‌ ‌হলো,‌ ‌পরদিন‌ ‌আমার‌ ‌সাথে‌ ‌এক-দেড়‌ ‌ঘন্টা‌ ‌সময়‌ ‌কাটাতে‌ ‌হবে।‌ ‌তারা‌ ‌সাগ্রহে‌ ‌রাজি‌ ‌হয়ে‌ ‌গেল।‌


‌পরদিন‌ ‌একটু‌ ‌চিন্তিত‌ ‌ছিলাম‌ ‌যে,‌ ‌তারা‌ ‌কথা‌ ‌রাখবে‌ ‌কি‌ ‌না।‌ ‌কিন্তু‌ ‌সেখানে‌ ‌পৌঁছেই‌ ‌দেখি‌ ‌ তারা‌ ‌আমার‌ ‌আগেই‌ ‌উপস্থিত।‌ ‌আমাকে‌ ‌দেখতে‌ ‌পেয়েই‌ ‌তারা‌ ‌বেশ‌ ‌উচ্ছ্বসিত।‌ ‌পরে‌ ‌তাদের‌ ‌সাথে‌ ‌ঘুরে‌ ‌ঘুরে‌ ‌বেশ কিছু‌ ‌ছবি‌ ‌তুললাম।‌


তারা‌ ‌কি‌ ‌কি‌ ‌করে,‌ ‌কিভাবে‌ ‌কি‌ ‌সংগ্রহ‌ ‌করে‌ ‌সেগুলোর‌ ‌ছবি‌ ‌তুললাম।‌ ‌এরপর‌ ‌তাদের‌ ‌জীবনের‌ ‌ইতিহাস‌ ‌শুনলাম।‌ ‌তাদের‌ ‌সাথে‌ ‌বসে‌ ‌থাকতে‌ ‌দেখে‌ ‌আশেপাশের‌ ‌লোকজন‌ ‌ভ্রু‌ ‌কুঁচকে‌ ‌তাকাচ্ছিল।‌ ‌কারণ‌ ‌শিশুদের পরনের পোশাক ‌বেশ‌ ‌নোংরা‌ ‌ছিল।‌ ‌কথা‌ ‌বলতে‌ ‌বলতে‌ ‌তারা‌ ‌যেন‌ ‌আমার‌ ‌আপনজন‌ ‌হয়ে‌ ‌উঠল।‌ ‌খাবারের‌ ‌কথা‌ ‌আর‌ ‌মনেই‌ ‌ছিল‌ ‌না।‌


প্লাস্টিক‌ ‌বোতল,‌ ‌কাগজ কুড়াতে পথে পথে ঘুরছে দুই পথশিশু। (ছবি: সংগৃহীত)


‌জামাল‌ ‌বাবু‌ ‌বলছিল‌ ‌তারা‌ ‌ঢাকায়‌ ‌আসার‌ ‌কাহিনী।‌ ‌তার‌ ‌বাড়ি‌ ‌জামালপুর।‌ ‌কয়েক‌ ‌বছর‌ ‌আগে‌ ‌সে‌ ‌তার‌ ‌নানীর‌ ‌সাথে‌ ‌ঢাকায়‌ ‌আসে।‌ ‌গ্রামে‌ ‌তার‌ ‌তেমন‌ ‌কেউ‌ ‌নেই।‌ ‌বাবা‌ ‌মারা‌ ‌যাওয়ার‌ ‌পর‌ ‌মায়ের‌ ‌অনেক‌ ‌কষ্ট‌ ‌হতো‌ ‌সংসার‌ ‌চালাতে।‌ ‌তাই‌ ‌সে‌ ‌নানীর‌ ‌সাথে‌ ‌ঢাকায়‌ ‌আসে।‌ ‌এখন‌ ‌সে‌ ‌ভুঁইয়াপাড়ায়‌ ‌মাছের‌ ‌ বাজার‌ ‌সংলগ্ন‌ ‌বস্তিতে‌ ‌একটি‌ ‌খুপড়ি‌ ‌ঘরে‌ ‌থাকে।‌ ‌তাদের‌ ‌খুপড়ি‌ ‌ঘরটি‌ ‌টিনের‌ ‌ছাউনী‌ ‌দেয়া।‌


সারাদিনে‌ ‌বাবুর‌ ‌কোনো‌ ‌কাজ‌ ‌নেই‌ ‌শুধু প্লাস্টিক‌ ‌বোতল,‌ ‌কাগজসহ‌ ‌নানা‌ ‌ধরনের‌ ‌টুকিটাকি‌ ‌জিনিস‌ ‌খুঁজে‌ ‌বেড়ানো‌ ‌ছাড়া।‌ ‌বাবু‌ ‌প্রতিদিন‌ ‌সকালে‌ ‌ঘুম‌ ‌থেকে‌ ‌উঠে‌ ‌কিছু‌ ‌খেয়ে‌ ‌বের‌ ‌হয়।‌ ‌দুপুরে‌ ‌আবার‌ ‌কিছু‌ ‌খেতে‌ ‌যায়।‌ ‌সন্ধ্যায়‌ ‌সব‌ ‌বিক্রি‌ ‌করে‌ ‌বাড়ি‌ ‌ফিরে‌ ‌যায়।‌ ‌সে‌ ‌কোনো‌ ‌দিন‌ ‌৫০‌ ‌টাকা,‌ ‌কোনোদিন‌ ‌৬০‌ ‌টাকায়‌ ‌তার‌ ‌টোকানো‌ ‌জিনিসগুলো‌ ‌বিক্রি‌ ‌করে।‌ ‌তার‌ ‌নানীর‌ ‌যথেষ্ট‌ ‌বয়স‌ ‌হলেও‌ ‌জীবনের‌ ‌তাগিদে‌ ‌তাকে‌ ‌কাজ‌ ‌করতে‌ ‌হয়।‌ ‌তিনি‌ ‌বিভিন্ন‌ ‌জায়গায়‌ ‌মাটি‌ ‌কাটার‌ ‌কাজ‌ ‌করেন।‌


এভাবেই‌ ‌তাদের‌ ‌দিন‌ ‌চলে‌ ‌যায়।‌ ‌নানী‌ ‌বৃদ্ধা‌ ‌হলে‌ ‌ভবিষ্যতে‌ ‌কী‌ ‌হবে‌ ‌বাবু‌ ‌জানে‌ ‌না।‌ ‌সে‌ ‌শুধু‌ ‌জানে‌ ‌এখনকার‌ ‌মতো‌ ‌বাঁচতে।‌ ‌ভবিষ্যত‌ ‌নিয়ে‌ ‌ভাবার‌ ‌তার‌ ‌অবকাশ‌ ‌নেই।‌


অন্যদিকে,‌ ‌কামরুল‌ ‌এসেছে‌ ‌কিশোরগঞ্জ‌ ‌থেকে।‌ ‌এখন‌ ‌থাকে‌ ‌ঢাকার‌ ‌ভুঁইয়াপাড়া‌ ‌মাছের‌ ‌বাজার‌ ‌সংলগ্ন‌ ‌বস্তিতে।‌


ফাদার বিকাশ‌ ‌কুজুর‌, সিএসসি।


তার‌ ‌পরিবার‌ ‌বেশ‌ ‌কয়েক‌ ‌বছর‌ ‌আগে‌ ‌ঢাকায়‌ ‌আসে।‌ ‌গ্রামে‌ ‌তাদের‌ ‌তেমন‌ ‌জমি-জমা‌ ‌নেই।‌ ‌তাই‌ ‌অন্যের‌ ‌জমিতে‌ ‌বর্গা‌ ‌চাষ‌ ‌করে‌ ‌কুলোয়‌ ‌না‌ ‌বলে‌ ‌তার‌ ‌বাবা-মা‌ ‌ঢাকায়‌ ‌চলে‌ ‌আসে।‌ ‌কামরুল‌ ‌গ্রামে‌ ‌পড়াশুনা‌ ‌করতো।‌ ‌ঢাকায়‌ ‌এসেও‌ ‌পড়শুনা‌ ‌শুরু‌ ‌করেছিল।‌ ‌কিন্তু‌ ‌শিক্ষকেরা‌ ‌অনেক‌ ‌মারধর‌ ‌করে‌ ‌বলে‌ ‌স্কুলে‌ ‌যাওয়াই‌ ‌ছেড়ে‌ ‌দিল‌ ‌সে।‌


এখন‌ ‌প্রতিদিন‌ ‌সকাল‌ ‌থেকে‌ ‌সন্ধ্যা‌ ‌পর্যন্ত‌ ‌এটা‌ ‌ওটা‌ কুড়িয়ে‌ ‌বেড়ায়।‌ ‌সে‌ ‌তার‌ ‌এই‌ ‌টোকাই‌ ‌জীবন‌ ‌নিয়েই‌ ‌সুখী।‌


আবার‌ ‌হৃদয়‌ ‌মিয়াও‌ ‌এসেছে‌ ‌‌কিশোরগঞ্জ‌ ‌থেকে।‌ ‌এখন‌ ‌থাকে‌ ‌ভুঁইয়াপাড়া‌ ‌মাছের‌ ‌বাজার‌ ‌সংলগ্ন‌ ‌বস্তিতে।‌ ‌৩‌ ‌ভাই-বোনের‌ ‌মধ্যে‌ ‌সে‌ ‌সবার‌ ‌ছোট।‌


সে‌ ‌যখন‌ ‌২য়‌ ‌শ্রেণিতে‌ পড়তো‌ ‌তখন‌ ‌তার‌ ‌বড়‌ ‌আপুর‌ ‌চিকিৎসায়‌ ‌অনেক‌ ‌অর্থের‌ ‌প্রয়োজন‌ ‌হয়।‌ ‌তার‌ ‌বাবা‌ ‌ঋণ‌ ‌করে‌ ‌চিকিৎসা‌ ‌করে।‌ ‌কিন্তু‌ ‌তাদের‌ ‌জমি-জমা‌ ‌বা‌ ‌অন্যান্য‌ ‌সম্পদ‌ ‌ছিল‌ ‌না,‌ ‌বিধায়‌ ‌তার‌ ‌বাবা‌ ‌ঋণ‌ ‌পরিশোধ‌ ‌করতে‌ ‌পারেনি।‌


অন্যদিকে,‌ ‌ঋণদাতারা‌ ‌তখন‌ ‌বারবার‌ ‌টাকার‌ ‌জন্য‌ ‌তাগাদা‌ ‌দিতে‌ ‌থাকে‌ ‌এবং‌ ‌অনেক‌ ‌অত্যাচার-জ্বালাতন‌ ‌করতে‌ ‌শুরু‌ ‌করে।‌ ‌তাই‌ ‌তারা‌ ‌স্বপরিবারে‌ ‌ঢাকায়‌ ‌চলে‌ ‌আসে।‌ ‌ঢাকায়‌ ‌এসে‌ ‌তার‌ ‌বাবা‌ ‌রিক্সা‌ ‌চালায়‌ ‌এবং‌ ‌মা‌ ‌মাটির‌ ‌কাজ‌ ‌করে।‌ ‌এভাবে‌ ‌তারা‌ ‌ধীরে‌ ‌ধীরে‌ ‌তাদের‌ ‌ঋণ‌ ‌পরিশোধ‌ ‌করছে।‌


হৃদয়‌ ‌আগে‌ ‌স্কুলে‌ ‌গেলেও‌ ‌এখন‌ ‌আর‌ ‌যায়‌ ‌না।‌ ‌তার‌ ‌স্কুলে‌ ‌যেতে‌ ‌ভাল‌ ‌লাগে‌ ‌না।‌ ‌এর‌ ‌চেয়ে‌ ‌এটা‌ ‌সেটা‌ ‌কুড়াতেই‌ ‌তার‌ ‌বেশি‌ ‌ভাল‌ ‌লাগে।‌ ‌সারাদিনের‌ কুড়ানো‌ ‌জিনিস‌ ‌বিক্রি‌ ‌করে‌ ‌সে‌ ‌যা‌ ‌পায়‌ ‌সেখান‌ ‌থেকে‌ ‌১০/১৫‌ ‌টাকায়‌ ‌হোটেল‌ ‌থেকে‌ ‌পুরি,‌ ‌সিংগারা‌ ‌ইত্যাদি‌ ‌খায়‌ ‌এবং‌ ‌বাকি‌ ‌টাকা‌ ‌মায়ের‌ ‌হাতে‌ ‌তুলে‌ ‌দেয়।‌ ‌বাবাকে‌ ‌টাকা‌ ‌দেয়‌ ‌না‌, ‌কারণ‌ ‌সে‌ ‌তার‌ ‌মাকে‌ ‌এবং‌ ‌তাকে‌ ‌মারধর‌ ‌করে,‌ ‌বাড়িতে‌ ‌প্রায়ই‌ ‌অশান্তি‌ ‌করে।‌


এই‌ ‌দলটিতে‌ ‌মোট‌ ‌সাত জন‌ ‌পথশিশু‌ ‌ছিল।‌ ‌তাদের‌ ‌দৈনন্দিন‌ ‌জীবনযাত্রা‌ ‌মোটামুটি‌ ‌একই‌ ‌রকম।‌ ‌তবে‌ ‌সাধারণত‌ ‌পথশিশুদের‌ ‌জীবনযাপন‌ ‌অত্যন্ত‌ ‌দুর্বিষহ‌ ‌হয়ে‌ ‌থাকে।‌ ‌নোংরা‌ ‌পরিবেশ‌ ‌আর‌ ‌অপুষ্টিতে‌ ‌বেড়ে‌ ‌ওঠা‌ ‌এদের‌ ‌৮৫‌ ‌ভাগই‌ ‌রোগাক্রান্ত।‌


এই পথই যাদের ঠিকানা। পথে পথেই ঘুরে বেড়ায় তারা। (ছবি: সংগৃহীত)


এসব শিশুরা অধিকাংশ‌ ‌সময়ই‌ ‌রাস্তা,‌ ‌পার্ক,‌ ‌ট্রেন-বাস‌ ‌স্টেশনে,‌ ‌লঞ্চঘাটে,‌ ‌সরকারি‌ ‌ভবনের‌ ‌নিচে‌ ‌ঘুমায়‌ ‌এবং‌ ‌প্রতিনিয়তই‌ ‌নাইটগার্ড‌ ‌কিংবা‌ ‌আইন‌ ‌প্রয়োগকারী‌ ‌সংস্থার‌ ‌সদস্যদের‌ ‌দ্বারা‌ ‌নির্যাতনের‌ ‌শিকার‌ ‌হয়।‌ ‌বিভিন্ন‌ ‌হোটেলের‌ ‌পচা-বাসি‌ ‌খাবার,‌ ‌এমনকি‌ ‌ডাস্টবিনে‌ ‌ফেলা‌ ‌দুর্গন্ধযুক্ত‌ ‌খাবারও‌ ‌খেয়ে‌ ‌থাকে।‌ ‌নোংরা‌ ‌স্থানে‌ ‌চলাফেরা‌ ‌ও‌ ‌ঘুমানোর‌ ‌কারণে‌ ‌চর্ম‌ ‌রোগে‌ ‌আক্রান্ত‌ ‌হয়।‌


এই‌ ‌পথশিশুদের‌ ‌একটি‌ ‌বড়‌ ‌অংশ‌ ‌শৈশব‌ ‌পেরিয়ে‌ ‌কৈশোরে‌ ‌পৌঁছার‌ ‌আগেই‌ ‌জড়িয়ে‌ ‌পড়ে‌ ‌চুরি,‌ ‌ছিনতাই,‌ ‌মাদক‌ ‌বিক্রি,‌ ‌পিকেটিংসহ‌ ‌নানা‌ ‌অপরাধমূলক‌ ‌কর্মকাণ্ডে।‌ ‌বিশেষ‌ ‌করে,‌ ‌মেয়ে‌ ‌শিশুরা‌ ‌যৌনবাহিত‌ ‌নানা‌ ‌রোগে‌ ‌আক্রান্ত‌ ‌হয়ে‌ ‌থাকে।‌ ‌এসব‌ ‌শিশু‌ ‌বেঁচে‌ ‌থাকার‌ ‌তাগিদে‌ ‌ভাসমান‌ ‌যৌনকর্মী‌ ‌হিসেবেও‌ ‌কাজ‌ ‌করে‌ ‌থাকে।‌


বনশ্রির‌ ‌শিশুদের‌ ‌চেহারা‌ ‌হাড়-হাড্ডিসার।‌ ‌তারা‌ ‌ঠিক‌ ‌মতো‌ ‌খেতে‌ ‌পারে‌ ‌না।‌ ‌পথে-ঘাটে‌ ‌বিভিন্ন‌ ‌ ফাস্টফুডের‌ ‌দোকানের‌ ‌আকর্ষণীয়‌ ‌খাবার‌ ‌দেখে‌ ‌তারা‌ ‌খেতে‌ ‌চায়,‌ ‌কিন্তু‌ ‌সেটি‌ ‌কিনে‌ ‌খাওয়ার‌ ‌সাধ‌ ‌থাকলেও‌ ‌সাধ্য‌ ‌নেই।‌ ‌শিশুরা‌ ‌বলছিল‌ ‌তাদের‌ ‌কষ্টের‌ ‌কথা।‌


তাদের‌ ‌সবচেয়ে‌ ‌বড়‌ ‌কষ্টের‌ ‌বিষয়‌ ‌হলো-‌ ‌সবাই‌ ‌ তাদের‌ ‌ধমক‌ ‌দিয়ে‌ ‌কথা‌ ‌বলে,‌ ‌সন্দেহের‌ ‌দৃর্ষ্টিতে‌ ‌তাকায়।‌ ‌সাহায্য‌ ‌করে‌ ‌না‌ ‌বিন্দুমাত্র‌ ‌অথচ‌ ‌খবরদারী‌ ‌করে।‌ ‌কোনো‌ ‌দোকানের‌ ‌পাশে‌ ‌দাঁড়ালেই ঝাঁঝালো‌ ‌গলায়‌ ‌বকঝাকা‌ ‌শুরু‌ ‌করে।‌ ‌আবার‌ ‌এলাকায়‌ ‌কিছু‌ ‌ কিছু‌ ‌মাস্তান‌ ‌আছে‌ ‌যারা‌ ‌তাদের‌ ‌টাকা‌ ‌পয়সা‌ ‌কেড়ে‌ ‌নেয়,‌ ‌চুরির‌ ‌ফাঁদে‌ ‌ফেলে‌ ‌বশে‌ ‌রাখতে‌ ‌চায়।‌


‌পথশিশুদের‌ ‌সাথে‌ ‌কথা‌ ‌বলতে‌ ‌বলতে‌ ‌বেশ‌ ‌কিছু‌ ‌বিষয়‌ ‌আবিষ্কার‌ ‌করলাম।‌ ‌তারা‌ ‌ক্রমেই‌ ‌আমার‌ ‌আপন‌ ‌হয়ে‌ ‌উঠল।‌ ‌ধীরে‌ ‌ধীরে‌ ‌‘তুমি’‌ ‌বলে‌ ‌সম্বোধন‌ ‌করতে‌ ‌লাগল।‌ ‌চুরির‌ ‌প্রসঙ্গ‌ ‌উত্থাপন‌ ‌করতেই‌ ‌বলল,‌ ‌“আল্লাহ,‌ ‌আমাগোরে‌ ‌হাত-পা‌ ‌দেয়‌ ‌নাই?‌ ‌চুরি‌ ‌করুম‌ ‌ক্যান?”‌ ‌বেশ‌ ‌ভ্রু‌ ‌কুঁচকানোর‌ ‌মতো‌ ‌বিষয়ই‌ ‌বটে!‌


বিশেষত‌ ‌সবাই‌ ‌যেখানে‌ ‌তাদের‌ ‌নেতিবাচক‌ ‌দৃষ্টিতে‌ ‌দেখে,‌ ‌সেখানে‌ ‌তাদের‌ ‌অবস্থান‌ ‌পুরোপুরি‌ ‌বিপরীত!‌ ‌সেদিন‌ ‌তাদের‌ ‌ফ্রাইড‌ ‌চিকেন‌ ‌খাওয়ার‌ ‌আবদার‌ ‌মেটালাম।‌ ‌তারা‌ ‌অনেক‌ ‌খুশি‌ ‌হলো।‌ ‌আমি‌ ‌চলে‌ ‌আসার‌ ‌সময়‌ ‌তারা‌ ‌হঠাৎ‌ ‌বলে‌ ‌উঠল,‌ ‌‌‘আসসালামু‌ ‌আলাইকুম’‌।‌ ‌আমি‌ ‌অবাক‌ ‌হয়ে‌ ‌ফিরে‌ ‌তাকালাম।‌ ‌এই‌ ‌সৌজন্যতা‌ ‌তাদের‌ ‌কে‌ ‌শেখাল?‌ ‌অত্যন্ত‌ ‌সুন্দর‌ ‌বিষয়‌ ‌বটে!‌


কাজের সন্ধ্যানে যাচ্ছে ছয় বন্ধু। (ছবি: সংগৃহীত)


‌প্রকৃতপক্ষে,‌ ‌তারা‌ ‌একটু‌ ‌যত্ন‌ ‌পেলে‌ ‌অবশ্যই‌ ‌ভাল‌ ‌মানুষরূপে‌ ‌গড়ে‌ ‌উঠতে‌ ‌পারবে।‌ ‌কিন্তু‌ ‌তাদের‌ ‌জন্য‌ ‌কিছু‌ ‌করার‌ ‌উদ্যোগ‌ ‌খুব‌ ‌কমই।‌ ‌কাজেই‌ ‌সরকার‌ ‌এবং‌ ‌বিত্তবান‌ ‌লোকেরা‌ ‌যদি‌ ‌তাদের‌ ‌সাহায্যার্থে‌ ‌এগিয়ে‌ ‌আসে,‌ ‌তবে‌ ‌তারাও‌ ‌দেশের‌ ‌জন্য‌ ‌বোঝাস্বরূপ‌ ‌না‌ ‌হয়ে‌ ‌সম্পদ‌ ‌হয়ে‌ ‌উঠতে‌ ‌পারে।‌


কেননা,‌ ‌এই‌ ‌বিপুলসংখ্যক‌ ‌শিশুকে‌ ‌এ‌ ‌অবস্থায়‌ ‌রেখে‌ ‌সুস্থ‌ ‌ও‌ ‌স্বাভাবিক‌ ‌সমাজ‌ ‌ব্যবস্থার‌ ‌কথা‌ ‌চিন্তা‌ ‌করা‌ ‌অসম্ভব।‌ ‌তাই‌ ‌বয়সভেদে‌ ‌প্রাতিষ্ঠানিক‌ ‌শিক্ষার‌ ‌পাশাপাশি‌ ‌নৈতিক‌ ‌ও‌ ‌কারিগরী‌ ‌শিক্ষায়‌ ‌শিক্ষিত‌ ‌করা‌ ‌গেলে‌ ‌তারাও‌ ‌দেশের‌ ‌সম্পদ‌ ‌হয়ে‌ ‌উঠবে।‌ ‌তাই‌ ‌এ‌ ‌জন্য‌ ‌প্রয়োজন‌ ‌আন্তরিক‌ ‌প্রচেষ্টা‌ ‌ও‌ ‌সমর্থন।‌


বিবার্তা/বিকাশ/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com