শিরোনাম
উদ্যোক্তা শিউলির জীবন সংগ্রাম
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২০, ২২:২৯
উদ্যোক্তা শিউলির জীবন সংগ্রাম
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন এয়ার হোস্টেজ হয়ে আকাশে উড়াল দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমাবেন। কিন্তু সবার ভাগ্যে তো আর সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কেননা তার দাদার বাড়ি ছিল ধর্মীয় অনুভূতিতে পুরোপুরি অন্ধ বিশ্বাসী। ওই বাড়িতে মেয়েদের ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। আর এয়ার হোস্টেজ হওয়ার স্বপ্ন তো ছিল পুরোপুরি কাল্পনিক ব্যাপার।


তবে সময়ের পালা বদলে তার স্বপ্নের রঙ বদলে যায়। তার স্বপ্ন এবার উদ্যোক্তা হওয়ার। শুরু করে নানান বাধার মুখে পড়েন। করেন সরকারি-বেসরকারি চাকরি। সেই সাথে সমতালে চলে উদ্যোক্তার কাজ। আবারো নেমে আসে কঠিন চ্যালেঞ্জ। হাল ছাড়েননি। সব মোকাবেলা করে এগিয়ে যান। তাই আজ তিনি সফল সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা।


বলছিলাম অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ইশিনা’-এর স্বত্বাধিকারী নারী উদ্যোক্তা মাহবুব আরা শিউলির কথা। তিনি একাধারে একজন মা, স্ত্রী, শিক্ষক, সংগীত শিল্পী ও সফল উদ্যোক্তা।



`ইশিনা’-এর স্বত্বাধিকারী উদ্যোক্তা মাহবুব আরা শিউলি।


শিউলির জন্ম পাবনা জেলার রাধানগর কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়িতে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। এখন আছেন অবসরে। মা ছিলেন গৃহিনী। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শিউলি মেজো। এক বোন ও এক ভাই মারা গেছেন।


শিউলির জন্মের পর থেকে শিশুকাল কাটে রাধানগরে। কবি বন্দে আলী মিয়াকে দাদা বলে ডাকতেন। বাবা-মায়ের মুখে শুনেছেন কবি তাকে ভীষণ আদর ও স্নেহ করতেন। কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এটা সেটা পছন্দের খাবার কিনে খাওয়াতেন।


সরকারি চাকুরে বাবার কারণে এক জায়গায় বেড়ে উঠা সম্ভব হয়ে উঠেনি শিউলির। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাকে। বাবা যখন যেখানে বদলি হয়েছেন সেখানেই পড়ালেখা করতে হয়েছে। ক্লাস সেভেনে পড়াকালে একটা পারিবারিক দুর্ঘটনার কারণে কিছুদিন পড়া বন্ধ থাকে। এরপর বাসায় পড়াশোনা করে এসএসসি পরীক্ষা দেন। যেহেতু তার পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কড়াকড়ি নিষেধজ্ঞা ছিল, তাই এসএসসি দেন পাবনা জেলার টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালায়। এরপর বাবা বদলির সুবাদে চলে যান চুয়াডাঙ্গা। সেখানে এইচএসসি পাস করে বদলি হয়ে আসেন নাটোরে।


পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় শিউলির। স্বামী পেশায় একটা বেসরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। বছর ঘুরতে তার কোল আলো করে আসে ছেলে সন্তান। ঘরে বসে বসে বোর ফিল করতেন। তাই নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টায় জয়েন করেন একটা সরকারি চাকরিতে। চাকরির পাশাপাশি ঘর সামলাতে হতো তাকে। সময়ের সাথে সাথে সংসারে ভালোবাসার ফলও বৃদ্ধি পেতে থাকে। পর পর তিন সন্তানের মা হন তিনি। চাকরি, সংসার, তিন সন্তান এক হাতে সব সামলিয়ে দিন-রাত এক করে এরই মধ্যে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করেন। পাশাপাশি সংগীতের উপরে ছয় বছরের ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ওই কোর্সে তিনি নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত এবং ক্লাসিক্যাল সংগীতের উপর শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন করেন।



অদম্য উদ্যোক্তা শিউলি।


অনেক কষ্টের পরে ভাগ্য দেবতা তার প্রতি প্রসন্ন হয়। সংগীতের শিক্ষক হিসেবে চাকরি হয় রাজশাহীতে। এরপর সংগীতের শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিভাগের ট্রেইনার হয়ে নাটোর পিটিআইয়ে দায়িত্ব পালন করেন। শেখার নেশা থেকে ঢাকা ছায়ানটে নজরুল সংগীতের ছাত্রী হিসেবেও কিছুদিন ক্লাস করেন শিউলি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষাজীবনের বেশিরভাগই শেষ করেছি বিয়ের পরে। তাই কি চাকরি স্থল, কি ক্লাসে সব জায়গাতেই কাঁথা বালিশসহ ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যেতাম। বাচ্চাকে পাশে শুইয়ে রেখে আমি অফিস, ক্লাস, এমন কি সংসারের সমস্ত কাজ করেছি।


শিউলির সংসারে কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। সুখের সংসারে সবই থাকলেও ছিল না তার কোনো অধিকার। তাই নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো তার। আর সেটাই তাকে সবসময় কুড়ে কুড়ে খেতো। পারিবারিক সমস্যার কারণে শ্বশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ির মধ্যে তেমন ভাল সম্পর্ক ছিল না। সঙ্গত কারণে শিউলির খুব প্রয়োজন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।


বিয়ের দুবছর পর থেকেই প্রতিবেশী বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন তিনি। সেই সাথে সারাদিন সংসারের কাজ সেরে রাত জেগে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করতেন। এরপর হাতে ডিজাইন করে শাড়ি থ্রিপিস ফতুয়া পাঞ্জাবি সোফার কুশন কভার সেলাই করে রাজশাহী সপুরা সিল্ক হাউজে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। সুন্দর ও নান্দনিক ডিজাইন দেখে ব্যবসায়ীরা পছন্দ করেন এবং পাঁচশ পাঞ্জাবির অর্ডার দেন।


এতো বড় অর্ডারের কাজ একার পক্ষে তো আর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করে দেয়া সম্ভব না, তাই পাড়ার মেয়েদেরকে নিয়ে কাজটা শুরু করেন। কিন্তু এতে বাধা দেন শাশুড়ি মা। তার ভাষ্য, পাড়ার কাউকে বাড়িতে আসতে দেয়া যাবে না। ওই পরিস্থিতিতে অনেক কষ্ট করে অর্ডারটা রেডি করে দেন। শুধু শাশুড়ির কারণে আর বড় কোনো কাজের অর্ডার নিতে পারেননি শিউলি। নিজে যা পারতেন তাই করতেন। সেগুলো বিক্রি করে নিজের খরচ চালাতেন। এভাবে চলতে থাকে জীবন যুদ্ধ।


সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা চাকরির জন্য চেষ্টা করেন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে একটা চাকরি হয়েও যায় তার। কিন্তু বেতন খুবই কম থাকায় কারো জন্যই তেমন কিছু করতে পারতেন না। যে টাকা পেতেন তা সংসারের পেছনেই চলে যেতো। এভাবে নিজে চলা এবং সন্তানদের লেখাপড়া করানোটা কঠিন হয়ে উঠেছিল।


জীবনের প্রয়োজনে সরকারি বেসরকারি চাকরি করেছেন শিউলি। কিন্তু কোনো কিছুতেই সব সামলে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। মনকে আবারো শক্ত করে নিজে থেকে ছোট পরিসরে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোমী এই উদ্যোক্তা। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কারো সাহায্য পাননি। এবার উদ্যোক্তা হতে ঝুঁকি নেন তিনি। কাউকে না জানিয়ে ব্রাক ব্যাংক থেকে বিশ হাজার টাকা লোন‌ নেন। তখন তার বড় ছেলে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আবাসিক হলে থেকে পড়াশোনা করতো।


ওকে দেখতে আসার নাম করে কিছু দেশি ব্লকের সুতির শাড়ি নিয়ে যান গ্রামে। সামনে ছিল পহেলা বৈশাখ। শাড়িগুলো প্রথম দিনেই প্রতিবেশীরাই কিনে নেয়। এতে তার অনেক লাভ হয়। ব্যাংকের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করে বাকি টাকা দিয়ে আবারো শাড়ি নিয়ে যান। সবাই এতো পছন্দ করেন যে কিছুদিনের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। এতে শিউলির আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল দ্বিগুণ।



হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও গানের চার্চাকালে শিউলি।


সেবার সামনে ছিল ঈদ। ঈদে মেয়েরা তাদের পছন্দের শাড়ি-ড্রেস কিরবে। বিধি বাম, আবারো এতে বাধা দিয়ে শাশুড়ি বলেন, বাড়িতে এসব লোকজন আসতে দেয়া যাবে না। কিন্তু শিউলি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের জেদি। তার ভাষ্য, তারা আমাকে কাজ করতে দেবে না, আবার স্বচ্ছলতাও দেবে না। তা তে কি হয়? এরপর অনেকটা আমি জেদ করেই নাটোরে একটা দোকান নিলাম। চারদিকে রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। দোকান দিয়ে আমি ছিলাম প্রথম মেয়ে কাপড়ের ব্যবসায়ী। কিছু মেয়ে অবশ্য ঘরে বসে ব্যবসা করছিলেন। সেখান থেকেই উদ্যোক্তা জীবনের সফলতা অর্জন আর আলাদা একটা ভালোবাসার টান অনুভব করতে শুরু করি। তবে এর জন্য সংসারে নানান রককমের অশান্তিও ফেস করতে হয়েছে।


২০০৯ সালের কথা। ওই সময়কার এক নম্বর দেশি ব্র্যান্ড ড্রেস লাইনের ড্রেস দিয়েই শুরু হয় শিউলির কাপড়ের ব্যবসা। বলতে গেলে নাটোরের প্রায় সব মেয়েই সেই সময় তার কাছ থেকে ড্রেস লাইনের ড্রেস এবং দেশি শাড়ি কিনে পরেছেন। তখন ইন্ডিয়ান থ্রিপিচ ও কাপড়েরও খুব প্রচার এবং জনপ্রিয়তা ছিল। এর‌মধ্যেই তিনি দেশি কাপড় দিয়ে ব্যবসা করে অনেক ভালো করেছিলেন। দোকান দিয়ে ব্যবসা করার জন্য পারিবারিকভাবে সবসময় সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো। বিশেষ করে তার শাশুড়ির সাথে।


সময় বয়ে যায়। তখন ছিল ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট। পারিবারিক ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন কারণে সরকারি শিক্ষকতার চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন শিউলি। বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য চলে আসেন যাদুর নগরী ঢাকায়। এসে জীবিকার তাগিদে একটা প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করেন। তখন অনলাইনে সবেমাত্র কিছু শপ কাপড়ের বিজনেস শুরু করেছিল। তবে সেটা ছিল অনেক কঠিন। চেনা পরিচিত ছাড়া কেউ পেজে এড হত না। তবুও শিউলির তখন মনে হত একসময় অনলাইন বিজনেস হবে তার মেইন বিজনেস।


ঢাকায় এসে শুরু হলো অনলাইনে ব্যবসা করার আপ্রাণ চেষ্টা। ফেসবুকে একটা পেজ খুলেন। কিন্তু তখন লাইভের‌ এতো প্রচলন ছিল না। কাস্টমার কেকোয়ালিটি সম্পর্কে জানাতে বোঝাতে ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা একটা নতুন পেজের জন্য খুব কঠিন ছিল। দুই বছর পেজ চালানোর পরও পেজে লাইকার আর ফলোয়ারের সংখ্যা হয়েছিল মাত্র ৭০০ জন। মনটা প্রচণ্ড রকমের ভেঙে পড়ে। তারপরও ব্যবসাটা টুকটাক করে বেশ ভালই চলছিল। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, কলিগ, আত্মীয়-স্বজনরা কাপড় নিতেন ওই অনলাইন শপ থেকে। সবসময় নিজের ও কাজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শিউলির। এরপর শুধু ফেসবুকে ফ্রেন্ড আর ফলোয়ার বাড়ানো ছিল তার কাজ। যখনি কেউ এড হতেন তখনি তাকে পেজ থেকে ইনভাইট পাঠাতেন। তার বিজনেস পেজের লাইক আর ফলোয়ারের সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারে পৌঁছাতে সময় লেগেছে আড়াই বছর। টানাপোড়েনে সময়টা কোনো রকমের চলছিল।


মানুষ চায় এক আল্লাহ চায় আরেক। ইতোমধ্যেই শহুরে সংসারের মোটামুটি সবই গুছিয়ে নিয়েছেন শিউলি। সবই ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। ফুলের মতো সাজানো বাগানের যেনো মালিই চলে গেল। আচমকা ঝড়ে উলটপালট হয়ে গেলো সবকিছু। চেনা মানুষগুলো তখন হয়ে গেল অচেনা। অন্যদিকে বাচ্চারা সবাই তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছিল। আর তাদের দুইজনের সব ইনকাম বাচ্চাদের মানুষ করতেই শেষ হয়ে যেতো। চারদিকে তখন তার জীবনে নেমে এলো অন্ধকারের ছায়া।


শিউলির ভাষ্য, এতোদিন উদ্যোক্তা জীবনের অত্যাচারের সঙ্গী ছিল ঘরের মানুষ, এখন হলো বাইরেরও মানুষ। পুরো পৃথিবী চলে গেল অন্যদিকে। বাচ্চাদের রেখে একদম শূন্য হাতে ফেলে গেল আমাকে। শুরু হয় ভয়ঙ্কর রকমের কষ্টের আরেক নতুন অধ্যায়। এক বছরের মধ্যে মা-বোন, শাশুড়ি ও স্বামী পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ায় শারীরিক ও মানসিকভাবে আমি পুরোপুরি থেমে গেলাম। কিন্তু তিন-চার মাস পরে দেখলাম, আমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ি, তাহলে আমার বাচ্চারা না খেয়ে থাকবে। একটা সময় বাচ্চাগুলোও শেষ হয়ে যাবে।


জানা গেলো, শিউলির স্বামী যখন মারা যান তখন ছোট ছেলে বৃটিশ কলম্বিয়া ও কুইন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংলিশ ভার্সনে ক্লাস ফাইভে, মেজো ছেলে ক্যাডেট কলেজে ক্লাস নাইনে এবং বড় ছেলে ঢাকা ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছিল। শিউলির তিন ছেলেই ভীষণ টেলেন্টেড। তাদের প্রাইভেট পড়ানোর জন্য কোনোদিন কোনো টিউটর লাগেনি। ডিকশনারি আর গুগল হচ্ছে ওদের টিচার। সবাই ছোটবেলা থেকেই ইংলিশ ভার্সনে পড়ালেখা করেছে। প্রত্যেকে সব ক্লাসে ফাস্ট বয় ছিল। ছোট ছেলে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। মেজো ছেলে ক্লাস ফাইভে সমাপনী পরীক্ষায় সারা বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে এবং ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। বড় ছেলে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। ছোট ছেলে এখন ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস এইটে পড়ছে। মেজো ছেলে সেন্ট জোসেফস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংলিশ ভার্সনে পড়ছে। বড় ছেলে পড়ালেখা করছে ঢাবিতে চতুর্থ বর্ষে।


সময়ের পালা বদলে, বদলে গেল শিউলির জীবনের দৃশ্যপট। প্রয়োজনের তাগিদে আবারো চাকরি নেন একটা প্রাইভেট ফার্মে। সেখানেও ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়নি তার। পারিপার্শ্বিক নানান ঝামেলায় সেটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।


তখন নিজের অনলাইন বিজনেস আর শ্বশুর বাড়ির জমিজমা থেকে কিছু টাকা সংগ্রহ করে তিন ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে যান সংগ্রামী এই নারী। স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তার চৌদ্দ বছর ধরে করে আসা সরকারি চাকরিটাও ছেড়ে দেন। স্বেচ্ছায় চলে যান অবসরে।


তখন ওই চাকরির গ্রাচুয়িটির টাকা এবং প্রিন্সিপাল স্বামীর কলেজ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে চলতি বছরের মার্চে ধানমন্ডি রাইফেল স্কয়ারের সীমান্ত সম্ভার শপিং কমপ্লেক্সে শাড়ি ও ড্রেসের একটা শোরুম নেন। সেখানে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার শাহজাদপুরের তাঁতের সুতি, সুতি জামদানী, হাফসিল্ক, হাফসিল্ক জামদানী, মসলিন জামদানী, হ্যান্ডলুম এবং হাতের কাজের শাড়ি থ্রিপিস পাওয়া যায়। এছাড়াও সব রকমের দেশি পোশাকেরও রয়েছে বিরাট কালেকশন।



তিন ছেলের সাথে উদ্যোক্তা শিউলি।


ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় প্লাটফর্ম উইম্যান অ্যান্ড ইকমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের সাথে এড হন। রাজিব ভাইয়ের দিক-নির্দেশনায় এক্টিভ থাকেন বেশি কয়েক মাস। এতে পরিচিতি বাড়তে থাকে। আর বিজনেস পেজে লাইক ও ফলোয়ারের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলে। বেচাকেনা যা হয় তা দিয়ে ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের লেখাপড়া চালাতে এবং তাদের ঠিকমতো খাবার দেয়াও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।


ব্যবসা করতে গিয়ে নানান হয়রানির কথা বলতে গিয়ে শিউলি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছি ঠিকই, তবে কখনোই শান্তি মতো স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারিনি। মেয়ে মানুষ ব্যবসা করবে এটা শশুর বাড়ির লোকজন কেউ কখনই মেনে নেয়নি। এজন্য নিজের হাজব্যান্ড ও তিন ছেলে ছাড়া কখনো কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার পর্যন্ত করতো না। তবে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসাতে আত্মনির্ভরশীলতার যে শান্তি এটা চাকরিতে নেই। আমি সরকারি, বেসরকারি চাকরি সব‌ই করেছি। কিন্তু ব্যবসা বা উদ্যোক্তা কাজে যে স্বাধীনতা আছে এটা আর কোনো জায়গায় নেই।


লড়াকু এই উদ্যোক্তার মতে, সবচেয়ে বড় কথা চাকরিতে গিয়ে নিজের ইজ্জত সম্মান নিয়ে বসদের সামনে চলা বিপদ। বসরা চাইলে সম্মান দিবেন, না চাইলে দিবেন না। সব সময় তাদের হুকুমের দাস বানিয়ে রাখেন। উদ্যোক্তার জীবন হচ্ছে সামাজিকভাবে সম্মান দিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয়তা মেটায় নিজের ওপরে আস্থা অর্জন করতে সাহায্য করে। উই আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে মাথা উঁচু করে আত্মসম্মানের সাথে বাঁচতে হয়। উই থেকে আর ডিএসবি গ্রুপ থেকে শিখছি কীভাবে একজন ভালো মানের উদ্যোক্তা হওয়া যায়। আর হ্যাঁ, উইতে আসার পর আমি অনলাইনে ঘরোয়া স্বাদের খাবার নিয়ে কাজ শুরু করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। এখন বেশ ভালই চলছে। এ কাজে আমাকে সাহায্য করছে আমার তিন ছেলে।


গ্রুপ দুটির প্রধানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যার এবং নিশা আপুর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না। আমার মতো কত পথ হারানো পথিকের পথের সন্ধান করে দিচ্ছেন তারা, এর হিসাব হয়তো ওনাদের কাছেও নাই।‌ তবে একজনের কাছে আছে তিনি হলেন উপর‌ওয়ালা। ইতোমধ্যেই বেশ ভাল টাকা আয় করেছি। আশা করছি, শিগগিরই সব কিছু কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো।


জীবনের অর্জন নিয়ে শিউলির ভাষ্য, এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাপ্তি নেই আমার জীবনে। হারানো আর দুঃখ-কষ্ট ছাড়া কিছুই পাইনি এখনো পর্যন্ত। জানিনা সামনে কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তবে, হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে নানান প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে তাদের যে সুন্দর মতো মানুষ করেত পেরেছি এটা আমার জীবনের জন্য সব চেয়ে বড় অর্জন। তিন ছেলেই আমার জীবনের সব। আমার অনলাইন ব্যবসার সব অর্ডার, শো-রুমের অর্ডার নেয়া থেকে শুরু করে সারা রাজধানীতে ক্লায়েন্টের কাছে পৌছে দেয়া সবই তারা তিনজনে মিলে করে। পালা করে শো-রুমে বসা, অনলাইনে খাবারের অর্ডার পেলে সব উপকরণ কিনে আনা আর সব সাথে তৈরিতে সাহায্য সবই আমার সাথে করে। তিন ছেলে না যেন আমার তিনটা হিরের টুকরা। একজন মা হিসেবে তাদের নিয়ে আমি অনেক গর্বিত।



অদম্য উদ্যোক্তা শিউলি।


নতুনদের প্রতি তার পরামর্শ, কাজকে সম্মান করতে না পারলে আর ভয় করলে সফলতাকে কখনও স্পর্শ করতে পারবে না কেউ। সবার প্রতি একটাই পরামর্শ সেটা হলো, ধৈর্য, ধৈর্য আর ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে। আর হাজার দিক থেকে বাধা আসবে, কিন্তু থেমে গেলেন তো হেরে গেলেন।


ভবিষ্যতে অনেক বড় হতে চান এবং অনেক অনেক সম্মানিত হতে চান লড়াকু এই উদ্যোক্তা। এত দিন ছিল সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা, এখন আরো দশজনের মুখে যেন হাসি ফোটাতে পারেন সেই চেষ্টা করছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় নারী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন স্বপ্নবাজ এই উদ্যোক্তা।


বিবার্তা/গমেজ/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com