শিরোনাম
নুরুল আবছারের উদ্যোক্তা জীবনের পেছনের গল্প
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২০, ১৭:১৬
নুরুল আবছারের উদ্যোক্তা জীবনের পেছনের গল্প
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

জীবনে কিছু হওয়ার অদম্য ইচ্ছা, কঠোর পরিশ্রমের মনোভাব আর পরিবারকে পাশে পেলে যে কোনো মানুষের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ব্যবসার পুঁজি হিসেবে বাবার এক লাখ টাকা আর মন থেকে দেয়া দোয়া নিয়ে ‍উদ্যোক্তা জীবনে সফল হওয়া তারই উদাহরণ নুরুল আবছার।


ফেনী সোনাগাজীর উত্তরচর মজলিশপুরে এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠা আবছারের। বাবা কৃষি কাজ করেই চার বোন ও দুই ভাইকে পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আজ বাবা নেই। মা আছেন। ভাই-বোনদের মধ্যে আবছার সবার ছোট।



এলিফ্যান্ট রোড মাল্টিপ্লানের অফিসে চায়না ক্লায়েন্টদের সাথে নুরুল আবছার


নিজের এলাকা সোনাগাজী থেকেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৯৭ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করার পরে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে থাকেন আবছার। ওই সময়ের জন্য কম্পিউটারে কাজ করাটা ছিল অনেক কাঙ্ক্ষিত একটা বিষয়। ওই এলাকায় হাতে গোনা কয়েকজন কম্পিউটারে কাজ করতে পারতেন। তার মনে জেদ চাপে কম্পিউটারে টেনিং নেয়ার। তাই ফেনীর একটা কারিগরি ট্রেনিং সেন্টার থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের উপরে প্রশিক্ষণ নেন। সেই সাথে ভর্তি হন কলেজে।


৬ মাস শেখার পরে তার দক্ষতার উপরে সন্তুষ্ট হয়ে ট্রেনিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ সোনাগাজী কমার্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে পার্ট টাইম চাকরির অফার দেন। ছাত্রাবস্থায় অফারটি পেয়ে ট্রেইনার হিসেবে যোগ দেন আবছার। পড়ালেখার পাশাপাশি শুরু করেন পার্টটাইম চাকরি জীবন। ওই সেন্টারে কাজের পাশাপাশি কম্পিউটারের উপরের আরো অন্যান্য কোর্সগুলো সম্পন্ন করে দক্ষতা অর্জন করেন। তার ক্যারিয়ার জীবনে যোগ হলো নতুন পালক।


ছাত্রাবস্থাতে আবছারের মাথায় আসে চাকরি করে অন্যের অধীনে কাজ নয়, নিজের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে সময়োপযোগী কোনো কিছু নিয়ে ব্যবসা করে স্বাধীনভাবে কাজ করে বাঁচতে হবে তাকে। মানুষের জীবন অনেক ছোট। এ ছোট জীবনে তাকে পরিকিল্পতভাবে কাজ করে সময়ের সাথে যুদ্ধ করে চলতে হবে। তাই উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করার জন্য ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।



ফেমাস ভিশন লিমিটেডর কর্মীদের একাংশ


এ বিষয়ে আবছারের ভাষ্য, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করার পরেই যে আমার চাকরি হয়ে যাবে তা না। এদেশে সোনার হরিণ নামক ভাল একটা চাকরি পেতেও ৫-৭ বছর সময় চলে যাবে। কেননা, ভাল চাকরির জন্য নিজেকে ভালভাবে তৈরি করতে হয়, দক্ষ করতে হয়। ওই ক্যারিয়ার গড়ার পরে যে চাকরি হবে তার কোনো নিয়শ্চয়তাও নেই। হলেও অন্যের অধীনে থেকে সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত নিয়ম মেনে প্রতিদিন ডিউটি করতে হবে। এদিক থেকে নিজে ব্যবসা করলে স্বাধীনভাবে কাজ করা যাবে। বসের প্যারা থাকবে না। নিজে ভাল থাকতে পারবো আবার দেশের কিছুসংখ্যক বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা যাবে। এ উদ্দেশ্য নিয়ে কলেজ জীবন থেকেই কর্মজীবনের প্রস্তুতিমূলক পলিসি নিয়ে কাজ করছি। যাতে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে পরে একজন ভাল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করতে পারি।


এইচএসসি পাস করার পরে আবছার ভর্তি হন ডিগ্রিতে। তখন ভাবেন আর চাকরি নয় এবার একটা নিজের প্রতিষ্ঠান দেয়ার সময় হয়েছে। পড়ালেখার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে স্থান হিসেবে বেছে নেন দাগনভূঞাকে। যে কোনো উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথম প্রয়োজন পুঁজির। তার বাবা ছিলেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। চার বোন ও দুই ভাইকে অনেক টাকা খরচ করে সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আবছার যখন ব্যবসার জন্য টাকা চান, তখন তার বাবা বলেন, তোমার পড়ালেখাতে অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি। তাই এখন তোমাকে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে তোমাকে দেব মাত্র এক লাখ টাকা আর মনভরে দোয়া। এটা দিয়ে যদি তুমি ভাল মতো ব্যবসা করতে না পারো তাহলে তোমাকে পাঁচ কোটি টাকা দিলেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবা না।


দাগনভূঞা বাজারে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু ফার্নিচার আর একটা কম্পিউটার কিনে শুরু হয় আবছারের স্বপ্নের যাত্রার। বাবা যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাকে সফল হতেই হবে। যে কোনো মূল্যে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মনে ছিল আত্মবিশ্বাস আর সাথে ছিল বাবার দোয়া।


১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু হওয়া এই কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের নাম দেয়া হয় ‘ফেমাস কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার’। স্থানীয় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি কম্পিউটার কম্পোজের কাজ করা হতো এই ট্রেনিং সেন্টারে। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটারের বিভিন্ন কোর্সের উপরে ট্রেনিং দেয়া হতো। আবছার এক হাতেই সামলাতেন সব কিছু।


অল্পদিনের মধ্যেই অনেক ছাত্রছাত্রী এসে ট্রেনিং নেয়া শুরু করেন। কিছু দিন পরে সেন্টারে এত বেশি শিক্ষার্থী হয় যে একটা কম্পিউটারে প্র্যাকটিসের জন্য সমস্যা হয়ে যায়। তাই ফজরের নামাজের পর থেকে শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিসের জন্য সিডিউল করে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে আবছারকে। শুরু হয় তার কঠোর পরিশ্রমের জীবন। শিক্ষার্থীদের চাহিদানুসারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থিউরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতে হতো।



ফেমাস কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকম’ প্রতিষ্ঠানকে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কেক কেটে উদ্বোধনকালে. . .


দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলও আসে আবছারের ট্রেনিং সেন্টার থেকে। সে আয় দিয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে আরেকটা কম্পিউটার কেনা হয়। ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনা করার পাশাপাশি নিজেকে আরো দক্ষ করতে কম্পিউটারের উপরে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজের চেষ্টায় ১৯৯৮ সালে ওই এলকায় প্রথম হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হন আবছার। ক্যারিয়ার জীবনে যোগ হলো নতুন পালক। শিক্ষার্থীদের ট্রেনিংয়ে যোগ করেন হার্ডওয়্যার বিষয়টি।


সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের শেখার চাহিদাও। সে সাথে নিজের উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতেও গ্রাফিক্স ডিজাইনটা শেখা আবছারের জরুরি হয়ে পড়ে। তাই এবার প্রশিক্ষণ নেন গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে।


১৯৯৯ সাল। সারা দেশে ফিচার ফোনের ব্যবহার শুরু হতে থাকে। সময়ের সাথে নিজের ব্যবসাটাকে আরো সমৃদ্ধ করতে ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি মোবাইল ব্যবসা শুরু করেন আবছার। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘ফেমাস কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকম’।দোকানে কম্পিউটার এবং মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রি করা হতো।



নুরুল আবছারের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বিবার্তা২৪ এর প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ


২০০০ সাল। আবছারের মাথায় আসে এ সময়ে শিক্ষার্থীদের কম্পিউার ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি মোবাইল ট্রেনিংটাও দেয়া দরকার। তাহলে স্থানীয়ভাবে তারা নিজের কর্মসংস্থান করে নিতে পারবে। মোবইলের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারে প্রশিক্ষণ নিতে চলে আসেন ঢাকায়। ধানমন্ডি ও ইস্টার্নপ্লাজা থেকে দুটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন এই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নিজের এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণে যোগ করেন মোবইলের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ।


অল্পদিনের মধ্যে ফেনী জেলায় ‘ফেমাস কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকম’ আলোড়ন ফেলে দেয়। সরকারি অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।


২০১২ সাল। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। চারদিকে বইছিল তথ্যপ্রযুক্তির জোয়ার। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের জীবনে সিকিউরিটির ছিল বড় অভাব। এই একটা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের মার্কেটে কাজ করলে মন্দ হয় না। দেশের মার্কেটে সিকিউরিটির পণ্যের অভাব ছিল। সময়ের চাহিদা আর ভবিষ্যত মার্কেটের কথা চিন্তা করে উদ্যোক্তা হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরা অ্যান্ড সিকিউরিটি আইটেম নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেন আবছার।



শিক্ষার্থীকে ট্রেনিং দিচ্ছেন নুরুল আবছার


নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০১৩ সালে চায়না যান আবছার। সবদিক বিবেচনা করে দেখেন সিসিটিভি ক্যামেরা অ্যান্ড সিকিউরিটি আইটেম নিয়ে প্রোডাকশনে না গিয়ে আমদানি করে দেশের মার্কেটে নিজের ব্র্যান্ডে বাজার জাত করলে বেশি ভাল। তাই শুরু করেন চায়না থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সিসিটিভি ক্যামেরা অ্যান্ড সিকিউরিটি আইটেম আমদানি।


প্রোপাইটর হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরা অ্যান্ড সিকিউরিটি আইটেম আমদানি শুরু করার পরে আবছার দেখেন দেশের বাজারে সিকিউরিটির পণ্যের অনেক চাহিদা রয়েছে। সারা দেশে ব্যবসাটাকে ছড়িয়ে দিতে ব্যবসাটাকে বড় করে লিমিটেড কোম্পানি করতে হবে। তখন জয়েনস্টক থেকে অনুমোদন নিয়ে ‘ফেমাস কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকম’ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘ফেমাস ভিশন লিমিটেড’।


‘ফেমাস ভিশন’ এবং ‘এফভিএল’ এ দুটি ব্র্যান্ডকে সরকারি অনুমোদন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নবাজ এ উদ্যোক্তা। বর্তমানে এ দুটি ব্র্যান্ড নিয়ে ফেনীর দাগনভূঞা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় তিনটি শোরুম ও একটা অফিসে ২০ জন কর্মী কাজ করছেন।



রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড মাল্টিপ্লানের অফিসে কাজে ব্যস্ত কর্মীরা


ফেমাস ভিশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন একদল উদ্যোমী ও ডায়নামিক কর্মীবাহিনী। কর্মীদের সহায়তায় ৬৪টি জেলায় সিকিউরিটির পণ্য পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দেশের চাহিদা পূরণ করে বাইরের দেশে রফতানি করার স্বপ্ন দেখছেন সংগ্রামী এ উদ্যোক্তা। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কম্পিউটার, মোবাইল, শহরের জীবনযাত্রা সব জায়গাতেই সিকিউরিটির অভাব রয়েছে। সব সেক্টরে সর্বোচ্চ সিকিউরিটি দিতে প্রয়োজনীয় গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য আমদানি করে মানুষকে স্বস্তিতে থাকার পরিবেশ তৈরিতে কাজ করার চেষ্টা করছেন আবছারের এই কর্মীবাহিনী। ডিজিটাল বাংলাদেশকে আরো সুরক্ষিত করতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com