শিরোনাম
অদক্ষ নারীদের শিখিয়ে দক্ষ করতে চান মাকসুদা খাতুন
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:০৬
অদক্ষ নারীদের শিখিয়ে দক্ষ করতে চান মাকসুদা খাতুন
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

প্রতিটি মানুষই স্বপ্ন দেখে। কারো পূরণ হয়। কারো হয় না। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, বাস্তবায়নে করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। অন্য পাঁচটা স্বপ্নবাজ মেয়ের মতো মাকসুদা খাতুনও স্বপ্ন দেখতেন নিজে কিছু একটা করার। সব সময় তার মনে প্রবল আগ্রহ ছিল নিজ উদ্যোগেই কিছু একটা করে স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ার। মাকসুদার সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে।


রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত শহরে বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের বড় মেয়ে মাকসুদা খাতুন গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সফলতার সাথে মাধ্যমিক, কিশালয় মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে স্নাতক, মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে মাস্টার্স এবং আশা ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন।


স্নাতক প্রথম বর্ষে থাকতেই একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে তোলেন মাকসুদা। বয়সের স্বল্পতার কারণে পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করতে না পেরে সেটি এক সময় বন্ধ করে দেন।


পড়াশোনা চলাকালীনই মাকসুদাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পড়াশোনা ও সংসার সামলে অলস সময় কাজে লাগাতে তিনি কল্যাণপুর রিয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তিন বছর শিক্ষকতা করেন।


একটা সময় পড়াশোনা শেষে ব্যাংকার হওয়ার ইচ্ছাও ছিল মাকসুদার। ব্যাংকে চাকরির জন্য চেষ্টাও করেন। কিন্তু ভাগ্য খোলেনি। ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল অন্যদিকে।



একটি বাইং হাউসে এক্সিকিউটিভ অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে যোগদান করেন মাকসুদা। ধীরে ধীরে কর্মদক্ষতা বাড়তে থাকায় বিভিন্ন বড় কোম্পানি থেকে কাজের অফার আসতে থাকে। যোগ দেন বিগ বস করপোরেশন নামক একটি বাইং হাউসে ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে। ইতোমধ্যেই সংসার আলো করে আসা নতুন অতিথিকে ঠিকমতো সময় দিতে না পারার কষ্ট, সকাল-সন্ধ্যা অফিসের দায়িত্ব পালনে কাজ-কর্মে মনোযোগ দিতে না পারায় এক দিনের নোটিসে চাকরি ছেড়ে দিতে হয় তাকে।


পেশাগতভাবে মাকসুদার স্বামী ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে। তার ছিল পার্টনারশিপে চামড়াজাত পণ্যের এক্সপোর্ট বিজনেস। চাকরি করায় সময় দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেন মাকসুদা। কিন্তু পার্টনারের একচেটিয়া সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসায় লস হতে থাকায় বন্ধ হয়ে যায় স্বামীর ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিও।


ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হলেও অল্প সময়ে তৈরি হওয়া ব্যবসার প্রতি ভালোবাসা বন্ধ হয়নি মাকসুদার। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত ও ই-কমার্সসহ ব্যবসায় উন্নয়নবান্ধব বেশকিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।


প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নিয়ে, নিজের জমানো অর্থ ও গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় নতুন করে চালু করেন মাকসুদা। ২০১৬ সালে নিজস্ব স্বত্বাধিকারে যাত্রা শুরু করা উদ্যোগটার নাম দেন ‘শাবাব লেদার’। শুরু হয় মাকসুদার ব্যবসায়িক জীবন।



উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের গল্পটা বলতে গিয়ে মাকসুদা বলেন, সব সময়ই ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু একটা করি। নিজের পরিচয় গড়ি। পরিচয়টা শুধু এমন নয় যে, টিচার মাকসুদা, ব্যাংকার মাকসুদা, অ্যাকাউন্টেন্ট মাকসুদা- সেভাবে নয়। আমি এমন একজন মাকসুদা হই, যে কিনা অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। অনেকের জন্য চিন্তা করবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ভালো একটা অবদান রাখতে পারবে।


মাকসুদার সোজাসাপ্টা কথা, চাকরি মানে শুধুমাত্র নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। নিজের জন্য চিন্তা করা। ওই চাকরির মাধ্যমে সাধারণ একটা পরিচয় তৈরি হয়। তবে এটার মাধ্যমে অন্যের জন্য কিছুই করা হয় না। আমি যখন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব, তখন নিজের একটা পরিচয় তৈরি হবে। সেই সাথে অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।


চাকরি মানেই অন্যের অধীনে প্রতিষ্ঠানের জন্য ৮-৫টা পর্যন্ত কাজ করা। কিন্তু যখন আমি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করব তখন শুধু ৮ ঘণ্টা নয়, চাইলে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতে পারব। এখন তাই করছি। তখন শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের কর্মসংস্থানের কথাও চিন্তা করার সুযোগ হবে। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে ২৫ জন কর্মচারী কাজ করছেন। তাদের কর্মসংস্থানের কথা আমার ভাবতে হয়। এটা এক দিনে হয়নি। অনেক সময় লেগেছে। এ চেতনা থেকেই আমার উদ্যোক্তা হওয়া।



পাঁচজন কর্মী নিয়ে দুটি মডেলের ৪৮টা চামড়ার লং জেন্টস ওয়ালেট দিয়ে উদ্যোক্তা জীবনের যাত্রা শুরু করেন মাকসুদা। ওয়ালেট যখন ডেলিভারি দিতেন তখন একেকজন তাকে বলতেন, আপনি শুধু ওয়ালেট করেন; মানিব্যাগ করতে পারেন না? সেই থেকে শুরু করেন মানিব্যাগ তৈরি।


ভালো সাড়া পেলে একটা সময়ের পর অফিসিয়াল ব্যাগ তৈরি করেন। ধীরে ধীরে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করেন এক্সেকিউটিভ ব্যাগ, এক্সেকিউটিভ ফাইল, লেডিস ব্যাগ, ম্যাসেঞ্জার ব্যাগ, লেডিস পার্টস, ব্যাকপ্যাক, বেল্ট, মাউস প্যাড, চাবির রিং, করপোরেট গিফট আইটেম, পেন হোল্ডার, পেন স্ট্যান্ড, ডায়েরি কভার, জ্যাকেটসহ যাবতীয় চামড়াজাত পণ্য।


বিজনেসকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে মাকসুদা বলেন, বিজনেসে কাস্টমারের ডিমান্ড পূরণ করাই আসল কাজ। কাস্টমারের মনকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কাস্টমার কী চান, সেটা যেমন আমাকে বুঝতে হবে। তেমনি কাস্টমার কী চাইতে পারেন সেটাও আমাকে বুঝতে হবে। সেই সাথে মার্কেটিংয়ে পলিসি বুঝতে হবে। কী কৌশলে প্রোডাক্ট কাস্টমারের কাছে পৌঁছানো যায়, সেটা জানতে হবে।


ওমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর বাংলাদেশ, ওমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর, নতুন প্রজন্ম, বি'ইয়াহ, চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা বেশকিছু সংস্থার সাথে বর্তমানে কাজ করছেন মাকসুদা।


তিনি বলেন, আমার মা অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন। মা আমাকে স্বপ্ন দেখাতেন। সব সময় বলতেন, কিছু একটা করো। তারই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আজ এ পর্যন্ত এসেছি। মানুষ নিয়ে বিভিন্ন রকমের কাজ করায় আমার মেয়ে এখন আমারই মতো হতে চায়। এটা আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রেরণা দেয়। ভীষণ ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়। অনেক বড় পাওয়া।



দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এক ঝাঁক কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের চামড়াজাত পণ্য। শুধু দেশেই নয় সুইজারল্যান্ড, জাপান, নেপাল, গ্রিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে মাকসুদার ‘শাবাব লেদার’ এর পণ্য। শুরুর দিকে একটা কাজ শেষ না হতেই চিন্তায় পড়তেন এটা শেষ হলে কি করবেন। এখন কাজের চাপে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে সময় বাড়িয়ে নিতে হয় মাকসুদাকে।


প্রতিদিন একটু একটু করে অর্জিত অভিজ্ঞতায় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে কাজের পরিধি, ব্যবসার প্রসার। সুযোগ হচ্ছে অনেকের কর্মসংস্থানের। সম্প্রতি স্বামীও চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছেন ব্যবসায়। দুজনের সম্মিলিত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে ‘শাবাব লেদার’।


আজকের এ সফলতার জন্য, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিডিওএসএন, চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব, বিইয়া’হসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মাকসুদা।


মাকসুদার এ উদ্যোগের জন্য ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ‘উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০১৮’ দেয়া হয়।



তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি মাকসুদা বলেন, কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চান তাহলে তাকে বলব, ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হলো মার্কেটিং। প্রথমে মার্কেট সারভে এবং রিসার্চ করে বের করতে হবে মার্কেটে কোন প্রোডাক্টগুলোর বেশি ডিমান্ড আছে। কোথায় গেলে সেগুলো সেল করা যাবে। কে বা কারা এ প্রোডাক্টে গুরুত্ব বুঝবে, কিনবে। এ ক্ষেত্রটা আগে খুঁজে বের করলে ব্যবসা করার সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে।


তিনি বলেন, পরিশ্রমী ও সৎ হতে হবে। কাজকে ভালোবাসতে হবে। সেটা যত ছোট কাজই হোক না কেন। সময়ের মূল্য বুঝে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। পাছে লোকে কিছু বলে এমন কিছুতে পাত্তা দেয়া যাবে না। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, স্বপ্ন সত্য করার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতে হবে।


নারীসহ আরো অনেকের কর্মসংসস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়া, অদক্ষদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষজনশক্তিতে পরিণত করে তোলা এবং কাজ শিখে দক্ষতা অর্জন করতে চায়- এমন তরুণদের ইন্টার্নির সুযোগ করে দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চান এ উদ্যমী নারী উদ্যোক্তা।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com