কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস আজ
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৩
কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস আজ
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ৬ ডিসেম্বর। কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে পরাজিত করে কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করে। এই দিনে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার তার সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করেন। তিনি শহরের সরকারি মহিলা কলেজ সংলগ্ন পানির ওভারহেড ট্যাংকে উঠে প্রথম স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পরলে শহরের বিভিন্নস্থানে আশ্রয় নেয়া লোকজন প্রকাশ্যে এসে বিজয় উল্লাস করেন। ২৩০ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর পাক হানাদার বাহিনীর হাতে মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।


দিবসটি উপলক্ষ্যে স্থানীয়রা কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনকৃত স্থানে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ এবং জেলা জুড়ে যে-সব বধ্যভূমি অবহেলা ও অযত্নে পরে আছে, সেগুলোর সংস্কার ও মৃত্যুবরণকারীদের নামের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান।


বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার বলেন, ৫ ডিসেম্বর আকাশ থেকে হামলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রতিরোধের ফলে দিশেহারা পাক বাহিনী ৬ ডিসেম্বর ট্রেন যোগে কুড়িগ্রাম ত্যাগ করে। আমরা তখন মোগলবাসা থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। আমি ৩৩৫জন মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে শহরে প্রবেশ করি। এরপর অন্যান্য কোম্পানির দলগুলোও শহরে প্রবেশ করে। আমি প্রথম পানির ওভারহেড ট্যাংকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। এরপর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ এবং পিটিআইতে আরো দুটো পতাকা উড়িয়ে বিজয়বার্তা ছড়িয়ে দেই।


উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুড়িগ্রাম মূলত ৬ নম্বর এবং ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।


মুক্তিযুদ্ধে ৬ নং সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন উইং কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার। এই সেক্টরের অধীনে রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল।


অপরদিকে কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকাটি ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু তাহের। বীর প্রতীক তারামন বিবি এই সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল ভুমিকা। ১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছিল ৮ টি থানা নিয়ে গঠিত একটি মহকুমা। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্র নেতারা চিলড্রেন পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চের কালোরাতের পর সংগ্রাম কমিটি ২৮ মার্চ গওহর পার্ক ময়দানে জনসভা করার পর বেসরকারী হাইকমান্ড গঠন করে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ মার্চ রংপুরস্থ ইপিআর উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন। তারই নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ এপ্রিল থেকে তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী দালালদের সহযোগিতায় তিস্তা নদী পাড় হয়ে লালমানিরহাট দখল করে নেয়। এরপর পাক বাহিনী ৭ এপ্রিল এবং ১৪ এপ্রিল দু’বার কুড়িগ্রাম দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নেয়।


এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে জুলাই মাস থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে থাকে একের পর এক সফল অভিযান। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় পাকবাহিনী চালায় নৃশংস গণহত্যা। এদিন পাকবাহিনী ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৩৪জন নিরীহ মানুষকে দাগার কুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে হত্যা করে। ১৪ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিগেডিয়ার জসির নেতৃত্বে ভরতীয় সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ মাউন টেন ডিভিশনের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ভূরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী, ৩০ নভেম্বর সমগ্র উত্তর ধরলা এবং ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরসহ সমগ্র জেলা হানাদার মুক্ত করে।


যুদ্ধকালীন সময়ে এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন-আব্দুল কুদ্দুস নান্নু, রওশনাল বারী রঞ্জু, আব্দুল হাই সরকার, কে,এম,আকরাম হেসেন, সুবেদার মেজর আরব আলী, সুবেদার বোরহান উদ্দিন, সুবেদার মাজহারুল হক সুবেদার আলতাফ হোসেন, বদরুজ্জামান, শওকত আলী সরকার ও আবুল কাশেম চাঁদ।


শিক্ষার্থী মার্জিয়া মেধা বলেন, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরকে আমাদের প্রেরণা ধরে আমাদেরকে নতুনভাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তৈরি করতে হবে।


শিক্ষর্থী রাজ্য জোতি জানান আমাদের বধ্যভূমিগুলো অবহেলা ও অযত্নে পরে আছে। আমরা সেগুলোর সংস্কার চাই। পাশাপাশি যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের তালিকাও দেখতে চাই।


কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল বাতেন সরকার সেদিনের অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি তিনি জানান, কুড়িগ্রামে পানির ওভার হেড ট্যাংকে যে স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল সেই স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবিটি বাস্তবায়নে প্রশাসনের সহযোগতা চান।


সেদিনের সেই স্মৃতিচারণ করে সাবেক কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার জানান, সেপ্টেম্বরে আমি কুড়িগ্রাম শহরে গেরিলা হামলা চালাই। উপর‌্যপুরি আক্রমণ ও আকাশ পথে হামলার ফলে পাক বাহিনী মনোবল হারিয়ে ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম ছেড়ে চলে যায়। আমরা বিকেলে কুড়িগ্রাম শহরকে মুক্ত ঘোষণা করে পানির ট্যাংকির উপরে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে জয়োল্লাস করি।


বিবার্তা/বিপ্লব/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com