ইসরাইলি গণহত্যা ও আধুনিক সভ্যতার দায়!
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:১৬
ইসরাইলি গণহত্যা ও আধুনিক সভ্যতার দায়!
ড. আশেক মাহমুদ
প্রিন্ট অ-অ+

ইসরাইলের গণহত্যা সকল সীমা অতিক্রম করেছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা এমনকি ফিলিস্তিনের শরণার্থী শিবির কোনটিই বাদ যায়নি ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ থেকে। ইসরাইলি হামলায় গাজা ভূখণ্ডের আল-আহলি হাসপাতাল যখন গুড়িয়ে দেয়া হয়; আর সেখানেই ৫০০ জনের অধিক রোগী ও আশ্রয়প্রার্থী মারা যায়- তখনই পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে যে ইসরাইল অমানবিকতার চূড়ান্ত সীমা পার করেছে। গত ২০ দিনে ইসরাইল ৮ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, এর মধ্যে ৩ হাজারের বেশি শিশু আর ২ হাজারের বেশি নারী। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ যুদ্ধ বন্ধের কোন উদ্যোগ নিতে পারছে না। উলটো আমেরিকা ও ইউরোপের শাসকেরা ইসরাইলের গণহত্যা মিশনকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে চলছে। এমনকি, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যখন বললেন ‘হামাস শূন্য থেকে আক্রমণ করেনি’- সাথে সাথে ইসরাইল জাতিসংঘের মহাসচিবের পদত্যাগ দাবি করে। মূলত ইসরাইলের দখলদারিত্ব আর গণহত্যা মার্কিন আর ইউরোপের মধ্যপ্রাচ্য দখলের পরিকল্পনার অংশ—এ বিষয়টি এতদিনে খোলাসা হয়েছে। এতে করে আধুনিক সভ্যতার মূল্যবোধ বহনের দাবিদার ইউরোপ আমেরিকার মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।


আসলে ইসরাইলি গণহত্যাকে পাশ্চাত্য মিশন থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। কেননা, আল-আহলি হাসপাতালে হামলার দিনই ছিল বাইডেনের ইসরাইল সফরের দিন। এমনকি ওই দিন ভোরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন তেলআবিব থেকে ঘোষণা দিয়েছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফর ইসরাইল, মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ কথাটি বলার দিনই গাজার হাসপাতালে এই নৃশংস ও ঘৃণ্য অমানবিক গণহত্যা চালায় ইসরাইল। সারা বিশ্ব এই ঘটনায় শুধু স্তম্ভিত হয়নি, এ ঘটনাকে ইউরোপ আমেরিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যেভাবে দেখছে তাতেও চরম বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এমন জঘন্য ঘটনার পরও আমেরিকা গাজায় জরুরি ত্রাণ পৌঁছাতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে আনীত প্রস্তাবে ভেটো দেয়। তার আগে রাশিয়া কর্তৃক উত্থাপিত ‘গাজা-ইসরাইল’ যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানে ‘না’ ভোট দেয় আমেরিকা, ব্রিটেন ও জাপান। এদিকে ফ্রান্সে ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। জার্মানি সরকার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে। এ থেকে বোঝাই যায়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন চলমান গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ পরিস্থিতিকে মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ বলেছেন।


মূলত ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো আমেরিকার সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের সাম্রাজ্যের আওতাধীনে আনার জন্য। তারা জানে, পুরো মধ্যপ্রাচ্য তেল সম্পদে সমৃদ্ধ আর ‘যুদ্ধ সংস্কৃতি’ অব্যাহত থাকলে মার্কিন অস্ত্র-কেন্দ্রিক পুঁজিবাদ আরো বিস্তৃত হবে। সেই মধ্যপ্রাচ্যকে করায়ত্ত করতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইয়াহুদী’ বর্ণবাদকে কাজে লাগাতে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল আমেরিকা। সেজন্য পাশ্চাত্য শক্তি ইউরোপীয় বর্ণবাদকে ‘ইসরাইলি’ বর্ণবাদের মোড়কে ভিন্নমাত্রার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। সেই সাথে আরবের রাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের ‘ইসলাম’ (মূল থেকে বিচ্যুত) কে সুনিপুণ কায়দায় ব্যবহার করে আরব জাতিকে ঘুমিয়ে রাখার পরিকল্পনা হাতে নেয় পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় বাধ সাধে কিছু শক্তিশালী প্রতিরোধ বাহিনী। প্রতিরোধ বাহিনীর মুখ্য এজেন্ডা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা। ইসরাইল সেই মুক্তিযুদ্ধকে বিনাশ করতে গিয়ে দমননীতির আশ্রয় নিয়েছে।


এতে করে ইউরোপ আমেরিকার ‘মানবাধিকার’ আর ‘গণতন্ত্রের’ প্রচারণা যে নিছক বাগাড়ম্বর ছিল- তা খোলাসা হয়ে গেছে। এতো বছর আমেরিকা আর ইউরোপ নিজেদের ‘মানবতাবাদী’, ‘কল্যাণকামী’, ‘গণতান্ত্রিক’, এবং ‘স্বাধীনতাকামী’ হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। অথচ ফিলিস্তিনে ইসরাইলের সকল অমানবিক আর অত্যাচারী কাজগুলোকে সমর্থন দেয়ার মধ্য দিয়ে ইউরোপ আমেরিকা তাদের রাজনৈতিক চরিত্রের আসল চেহারা পুরো বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছে। উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের রাজনৈতিক অভিসন্ধি আরো পরিষ্কার হয়েছে। আমেরিকা ও ইসরাইল মূলত যে কথা বারবার বলছে তা হলো ‘গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেয়া’ তাদের লক্ষ্য। এর মানে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে যে আলাদা ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল তা ছিল উদ্দেশ্য সাধনের কৌশল মাত্র। চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘গোটা মধ্যপ্রাচ্য’কে মার্কিন বলয়ে নিয়ে আসা। এ কারণে ইউরোপ আমেরিকার শাসকেরা বলছে ‘ইসরাইলের হামলা করার অধিকার আছে’, ‘ইসরাইলের নিরাপত্তার অধিকার আছে’।


এর মধ্য দিয়ে আধুনিকতার বিশ্বায়ন মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আধুনিকতার মূল কথাই হল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বঞ্চিত নিপীড়তদের মুক্তি, বর্ণবাদের বিপরীতে মানবিক সাম্য, পরাধীনতার স্থলে স্বাধীনতা, স্বৈরশাসনের বিপরীতে জনগণের বাক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। অথচ ইউরোপ আমেরিকার বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদ আর সমরবাদ এতোটাই আগ্রাসী যে, আধুনিকতার বয়ানসমগ্র এখন ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের ঔপনিবেশিক চরিত্রকে উন্নত প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা দিয়ে এতকাল ঢেকে রেখেছিল। ঘুরেফিরে সেই ঔপনিবেশিক মানসিকতার ছাপ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমেরিকা তার ‘গণতান্ত্রিক’ মডেল থেকে বেরিয়ে এসে ইসরাইলের নাৎসি চরিত্রকে সমর্থন দিয়ে চলছে। শুধু তাই নয়, আরবের প্রভাবশালী দেশগুলোর রাজতান্ত্রিক কাঠামোকে সমর্থন দিয়ে আমেরিকা বৈশ্বিক ‘গণতান্ত্রিক’ মূল্যবোধকে আহত করেছে। পাশ্চাত্যের রাজনীতি এমনই করে ইউরোপ আর আমেরিকার নৈতিক মূল্যবোধের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইউরোপ আমেরিকার সরকারপ্রধানেরা ‘মানবাধিকার’ হরণের চূড়ান্ত লঙ্ঘনকে সমর্থন দিয়ে পাশ্চাত্য মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণু দিককে ফুটিয়ে তুলেছে। সমাজতাত্ত্বিক ইয়োরগেন হেবারমাসের যৌক্তিক সংলাপতত্ত্ব (Rational communication theory), রুশোর জনগণের সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব (General will), জন লকের সামাজিক চুক্তিতত্ত্ব (Social contract theory), পারসন্স এর সামাজিক ব্যবস্থা তত্ত্ব (Social system theory), ডুরখেইম এর সামাজিক সংহতিতত্ত্ব (social solidarity theory) সহ পাশ্চাত্যের সকল মানবতাবাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্ব অকার্যকর হয়ে পড়েছে ইসরাইল ও আরবের দেশগুলোতে।


রাজনীতির এমনই অধ্যায়ে মার্কিন আর ইসরাইলের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের এজেন্ডা হলো ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ দমন করা আর সে কাজে আরবের রাজতান্ত্রিক সরকারকেও ব্যবহার করা। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ‘গাজা’ নিজেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই বাঁধা উপড়ানোর জন্য ইসরাইল আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় গাজাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। গণহারে ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করছে, যেন আগামীদিনের প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ সমূলে ধ্বংস করা যায়। গাজাকে ২০ বছর ধরে অবরুদ্ধ কারাগার বানিয়েও সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি বলে ইসরাইল আরো বেশি সহিংস হয়ে উঠেছে। উপরন্তু হামাসের শক্তিবৃদ্ধি ইসরাইলকে এতোটাই সহিংস করেছে যে, ‘মানবাধিকার’ হরণের সকল সীমা লঙ্ঘন তাদের চোখে ‘অধিকারের’ মতো। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও রাজতান্ত্রিক আরবের দেশগুলোর মানবিক মূল্যবোধের সংকট আরো প্রকট হয়েছে।


তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আমেরিকা ও ইউরোপের বিপরীতে রাশিয়া, চীন, ও ইরানের মার্কিন বিরোধী অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখাকে জটিল করেছে। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানের শক্তিশালী অবস্থান মার্কিন ও ইসরাইলের অভিসন্ধি পূরণকে তীব্রভাবে আঘাত করছে। ইউরোপ আমেরিকার রাজনৈতিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা যেমন জরুরি, তেমনি আরবের রাজতান্ত্রিক শাসনের স্থলে জনগণের অধিকার অনুসৃত শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীনতার জন্য আরো অনেক মূল্য দিতে হবে।


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


বিবার্তা/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com