সর্বজনীন পেনশন বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বিত অধ্যায়
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৪৩
সর্বজনীন পেনশন বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বিত অধ্যায়
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যত ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বা উন্নয়ন ঘটেছে, আমার দৃষ্টিতে– এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মহৎ একটি প্রকল্প হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প।


বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এই পেনশন যে কতটা জরুরি ছিল, সেটি হয়তো আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারি না। একটি রাষ্ট্রের মূল উপাদান ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব আর সরকার। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে মূল উপাদান রাষ্ট্রের জনগণ। রাষ্ট্রের ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার পরিবর্তনশীল কিন্তু তার জনগণ, তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এসব বদলায় না। সেই ভূখণ্ডে জনগণের যাপিত জীবনের সেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই জনগণ ছাড়া আসলে অন্য সব উপাদান গৌণ হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশকে পিছনে ফেলে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এশিয়ার ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ হাতেগোনা কয়েকটা দেশে এই পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।


দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষ এই পেনশনের আওতায় আসবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট কোটি। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন ১৪ লাখের কিছু বেশি। সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে প্রায় ৮ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এই ব্যবস্থার আওতায় আসবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করছে সরকার।


এগুলো হচ্ছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। প্রবাস স্কিমটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। প্রগতি স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য। সুরক্ষা স্কিম রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য। আর সমতা স্কিম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য।


বিলে বলা হয়েছে, পেনশনে থাকাকালে কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।


পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে।


মূল যে বিষয়টা সামাজিক যে বৈষম্য সেই বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে আসবে এই পেনশন প্রকল্প।


শেষ বয়সে এসে, আমাদের দেশের মানুষদের যে অবহেলা, অনাদর বা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়, সেটি বহুলাংশেই কমে যাবে। হাতে টাকা থাকলে মানুষের আত্মবিশ্বাসও বহুগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থা এখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে চলছে। সেবা খাত হিসেবে নয়, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক বিকল্প পেশাসহ নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে।


সম্প্রতি কেয়ার ভিসা নামে পরিচিতি পাওয়া দক্ষ শ্রমিক বা স্কিলড ওয়ার্ক ভিসার লাখ লাখ মানুষ ব্রিটেনে এসেছেন। এখনো আসছেন। আর এই কেয়ার ভিসার মূল কাজ হচ্ছে কেয়ার হোমে বয়স্ক মানুষের সেবা দেয়া। পাশাপাশি যদিও অন্যান্য বিশেষ মানুষদের ও সেবা দেয়া হয়ে থাকে। দুই ধরনের সেবা দেয়া হয়, কমিউনিটি সেবা হচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যক্তির বাসায় গিয়ে তার দৈনন্দিন কাজে, ব্যক্তিগত পরিচর্যাসহ যাবতীয় কাজে তাকে সহায়তা করা। অন্যটি হচ্ছে যারা বিভিন্ন কেয়ার হোমে বসবাস করেন তাদের সার্বক্ষণিক দেখভাল করা। যা পরিবারে থাকলে সেই ব্যক্তি পেতেন। আর এই ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মূলত সেই পেনশনের অর্থই সেখানে ব্যয় করে থাকে।


শুধুমাত্র যদি প্রবাসীদের কথা ধরি– মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারীদের জন্য এই প্রকল্প যে কীভাবে সাহায্য করবে, তা অকল্পনীয়। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি, আমাদের গ্রামে এক সময় প্রচুর মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে ছিল, বলা হত প্রত্যেক পরিবারে একজন করে মধ্যপ্রাচ্যে থাকে আমাদের গ্রামে। এরা যতদিন বিদেশে ছিল, চাকচিক্য, আভিজাত্য, ধুমধাম ছিল চোখ ধাঁধানো। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে এরা বাড়িতে বিল্ডিং করেছে, জমিজমা কিনেছে, কিন্ত দেশে যখন একেবারে চলে এসেছে, এদের অনেককেই দেখেছি কয়েক বছর পর অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে, অথবা অন্য কোথাও দোকান, মিল, ফ্যাক্টরিতে কাজে যোগ দিতে। আর এর মূল কারণ হয় ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ বাটোয়ারা করে অবশিষ্ট যা পায় তা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে পারে না। অথবা ছেলেরা বা ভাইয়েরা শুধু ধুমধাম করেছে, পরিকল্পনামাফিক সেই অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেনি। আর সাধারণ মানুষের ইচ্ছা থাকলেও সঞ্চয় করার আসলে সুযোগই থাকে না। অনেককেই দেখেছি মানবেতর জীবন যাপন করতে। কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসেন একেবারে শেষ বয়সে। কারণ দেশে এসে কী করবেন সেই ভয়ে আর দেশেই আসেন না। পরিবার-পরিজনবিহীন একটা জীবন কাটিয়ে দেন প্রবাসে।


যদি সরকার আরেকটু গভীরভাবে কাজ করে, তবে খুব সহজেই এই পদ্ধতি বাংলাদেশে কার্যকর করা সম্ভব। ব্রিটেনে যেমন এইসব দেখভালের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা আছে, যারা এর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সেইরকমভাবে দেখভালের ব্যবস্থা করা, যাতে করে পেনশনপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তির টাকা ঐ নির্দিষ্ট হোমে মাস শেষে পৌঁছে যাবে। সারাজীবন কষ্ট করে উপর্জন করে শেষ বয়সে সন্তান কর্তৃক নির্যাতন নিপীড়ন এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে বাংলাদেশে।


বিশেষ করে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা মানু্ষকে বেশি অসহায় করে তোলে। তাই পেনশন সেই নিরাপত্তা বলয় তৈরিতে সাহায্য করবে। বিধবা ভাতা এবং বয়স্ক ভাতা সমূহ অনেকাংশেই একবারে প্রান্তিক শ্রেণির জীবন মানে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এই ভাতার জন্যও অনেকে বয়োবৃদ্ধ মানুষ পরিবারের যত্নে বসবাস করছেন।


এই সর্বজনীন পেনশনের সুফল এই মুহূর্তে দৃশ্যমান হবে না বলে হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্ত আজ থেকে ১৫ বছর পর যখন মানুষ সেই সুবিধা পাওয়া শুরু করবে৷ তখন এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশকেই দেখব আমরা। মানুষের মাঝে বৈষম্য কমে আসবে। একটি মানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কারণ ক্ষুধা বা অভাবের তাড়না মানুষকে নানাবিধ অমানবিক কাজে লিপ্ত করে। সেই তাড়না যখন থাকবে না, তখন মানুষের মানবিকতার প্রকাশ প্রকট হয়। ইউরোপের বৃদ্ধদের দেখলে সেই মানবিকতার প্রকাশ অনুধাবন করা যায়।


বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে, বিষয়গুলো নিশ্চিত করা দরকার, তা হলো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্য এবং লেনদেনের স্বচ্ছতা ও সহজকরণ। ব্যাংকে জমা দেয়ার পরিবর্তে মোবাইল সার্ভিস বা বিকাশ নগদ, রকেটের মত সার্ভিস প্রোভাইডার তৈরি করা। যাতে করে গ্রামের মানুষটি ও স্থানীয় বাজারে, পাড়ার দোকানে সেই সেবা গ্রহণ করতে পারে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা হতে পারে পোস্ট অফিস। সরকারী পেনশন পেতে নাকি শেষ বয়সে এসে সেই চাকরীজীবীদের জুতার শুকতলা ক্ষয় হয়ে যায়। অনেকেই দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে পেনশন উত্তোলনের আগেই জীবন থেকে বিদায় নিয়ে নেন। এইসব জায়গাগুলো সহজতর করতে হবে। যাতে করে যেদিন মেয়াদ পূর্ণ হবে গ্রাহক পরের মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার একাউন্টে অথবা স্থানীয় এজেন্ট বা পোস্ট অফিস থেকে সেই টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। সেটি তাকে চিঠির মাধ্যমে মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। তাঁকে যাতে কোন ধরনের আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্যের মাঝে পড়তে না হয়। এই বিষয়গুলো সরকারকে আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হবে।


উন্নত দেশে ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স প্রদান বাধ্যতামূলক। এবং এই ইন্সুরেন্স প্রদানের উপর নির্ভর করেই অবসরকালীন ভাতা বা পেনশন প্রদান করা হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠে নাই। বিকল্প হিসাবে এই ইচ্ছামাফিক চাঁদা দেয়ার ব্যবস্থাটিও ভালো উদ্যোগ। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে বিদেশ গমনের আগে, ভিসা পাওয়ার পর এই পেনশন স্কিম বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন এবং স্কিমগুলো সহজে পরিবর্তনের ও ব্যবস্থা রাখা দরকার। যাতে একজন লোক বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসলে নিয়মিত চাঁদা দিতে পারেন। অথবা দেশে একটি স্কিমে টাকা জমা দেয়ার পর বিদেশ গেলে, বিদেশ থেকে নিয়মিত চাঁদা দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।


শুধু বিরোধিতার খাতিরে, বিরোধিতা করার জন্য কিছু মানুষ ঘোষণার পর থেকেই এর বিরোধিতা শুরু করেছে। সরকার মানুষের টাকা নিতে এই প্রকল্প ঘোষণা করেছে। সরকারের কাছে নগদ টাকা নেই তাই এসব করছে। নানা রকম যুক্তি, নানা মত প্রকাশ করছে।


মানবিক উন্নয়নকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নানা ফতোয়া দিচ্ছে অনেকে যাতে করে প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়। বরং আলোচনা হওয়া উচিত ছিল, বেকার ভাতার কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না? সেসব না করে, তারা বরং রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের খুঁত ধরতে, এগিয়ে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই এসব সমালোচনা। এক গুণে দুই গুণতে হয়, অন্তত শেখ হাসিনর সরকার শুরু তো করেছে। আগামীতে সময়ের সাথে হয়তো আরো বিষয় যোগ হবে। সেই সব আলোচনা না করে, সমালোচনা করার খাতিরে সমালোচনা হচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে। মানু্ষকে নিরুৎসাহিত করছেন তারা।


নিকট অতীতে পদ্মাসেতু নিয়ে কত ধরনের গুজব ছড়িয়েছিল, তেমনি করোনার টিকা নিয়ে, লকডাউন নিয়ে একই অবস্থায় গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বিব্রত করতে, বাধাগ্রস্ত করতে বারবার এই কাজগুলো করে চলে। আর এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যখন সমালোচনায় মেতে ওঠে তখন ধরে নিতে হবে, কাজটি রাষ্ট্রের মৌলিক উন্নয়নে সঠিক পথেই আছে। দেশের সাধারণ মানুষ বারবারই এদের পরাহত করে দেশের অগ্রযাত্রায় শরিক হয়েছে।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com