গৃহবধূ থেকে ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার 'আদ্যোপান্ত'
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪১
গৃহবধূ থেকে ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার 'আদ্যোপান্ত'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবন শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।


মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্রের আপসহীন এ নেত্রীর পথচলা ছিল অনেকটাই সাদামাটা।


১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহতের সময় দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে ঢাকা সেনানিবাসে বসবাস করছিলেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৭৮ বছর।


রাজনৈতিক মহলে তিনি একজন দুর্বল ও অদক্ষ নেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে পছন্দ করতেন, কারণ তারা জানতেন তিনি শক্ত হাতে ক্ষমতা পরিচালনা করতে সক্ষম নন। সে সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলও (বিএনপি) ছিল গভীর সংকটে—দল দিশেহারা, নেতৃত্বহীন এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তিতে জর্জরিত।


বিএনপির একাংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হোক। তবে যারা আব্দুস সাত্তারের সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা এর বিরোধিতা করেন। প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার গ্রন্থ ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’-এ লিখেছেন, সামরিক ও শাসকগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় আশঙ্কার নাম ছিল খালেদা জিয়া। কারণ প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলে তিনিই হতে পারতেন সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী।


তড়িঘড়ি করে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদও সাত্তারকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বিএনপির ভেতরে মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধানের ইচ্ছাই কার্যকর হয়। মওদুদ আহমদের ভাষায়, ‘বেগম জিয়া যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইতেন, তাহলে অন্য কারো প্রার্থী হওয়ার তখন আর প্রশ্ন উঠতো না।’


রাজনীতিতে আসার অনীহা


রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে জিয়াউর রহমানের পাশে খালেদা জিয়াকে খুব একটা প্রকাশ্যে দেখা যেত না। তার রাজনীতিতে প্রবেশ অনেককেই বিস্মিত করেছিল। সাংবাদিক শফিক রেহমান তার লেখায় উল্লেখ করেন, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হলেও খালেদা জিয়া ছিলেন লাজুক গৃহবধূ—দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে সাংসারিক জীবনেই ব্যস্ত।


বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে অসন্তোষ এবং দল পরিচালনার ব্যর্থতার কারণে বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু রাজনীতির প্রতি তার নিজস্ব আগ্রহ ছিল না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল—স্বামীর আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে গভীর মানসিক আঘাত, পরিবারের অনীহা এবং রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা।


সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ তার বই ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি’-তে উল্লেখ করেছেন, রাজনীতি তাকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে কি না—এই আশঙ্কা তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছিল।


রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা


দলের নেতা-কর্মীদের দীর্ঘ অনুরোধ ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রয়োজনে অবশেষে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যুক্ত হতে সম্মত হন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেনাপ্রধান এরশাদও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, কারণ এতে তার ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারত।


১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। একই বছরের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে তার প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য আসে। এরপর তিনি দ্রুত দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে উঠে আসেন।


১৯৮৩ সালে তিনি সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন—যা সামরিক শাসক ও ক্ষমতাকেন্দ্রের অনেকেরই পছন্দ ছিল না।


তিনি ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। তার দৃঢ় সংকল্পের কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক হয়েছিলেন তিনি।


পরবর্তীতে ১৯৮০ দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা, সাত দলীয় জোট গঠন, নির্বাচনী কারচুপির বিরোধিতা এবং বারবার কারাবরণ এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান শেষে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময় এবং শুধুমাত্র তৈরি পোশাকশিল্প খাতেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯%। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যোগ দেন।


‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে উত্থান


প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় বসেই বেগম খালেদা জিয়া জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন, যেন বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি করে।


১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নতুন নির্বাচনে হেরে যায় তার দল। তবে দেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।


১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।


২০০৬ সালে, তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।


ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা ‘উপবৃত্তি’ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে।


বেগম জিয়া কোনো আসনেই পরাজিত না হওয়ার অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে পাঁচটি পৃথক সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে, তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সেখানে তিনি জয়লাভ করেছিলেন।


গণতন্ত্রের জন্য নতুন লড়াই


২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করলে গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়ে। গণতন্ত্রের প্রতি তার ভূমিকার জন্য, তাকে ২০১১ সালে নিউ জার্সির স্টেট সিনেট ‘গণতন্ত্রের জন্য যোদ্ধা’ উপাধিতে ভূষিত করে।


জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, মূলত নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেই তাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে তার ‘ন্যায্য বিচারের অধিকারকে সম্মান করা হয়নি।’


পরবর্তীতে চলতি বছর আপিল বিভাগের রায়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমানসহ সবাই খালাস পান। রায়ে আদালত জানায়, এ মামলায় আসামিদের কারও ‘অপরাধ পাওয়া যায়নি’।


বিবার্তা/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com