
জোটবদ্ধ হয়ে এক দলের প্রতীকে অন্য দলের প্রার্থীর নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ না মিটলেও উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (সংশোধন) অধ্যাদেশের গেজেট জারি করা হয়েছে। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে সব প্রার্থীকে। সোমবার আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশের গেজেট জারি করেছে।
এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে নির্বাচনী আইনে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের সাত দিন আগে থেকে এবং নির্বাচিত হয়ে পুরো পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণখেলাপি হলে তাঁর আসন শূন্য হয়ে যাবে। পাশাপাশি পলাতক (ফেরারি) আসামিকে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য এবং অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা পরিবর্তন করে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে, আংশিক ফিরছে ‘না’ ভোট। শুধু একক প্রার্থী থাকলেই ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি চালু করা, অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধান, এআইয়ের অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য (ভোটে অযোগ্য এমন) দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে সংশোধিত আরপিওতে বলা হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা সদস্য থাকলেও প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন– এমন প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী শিগগিরই দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করবে ইসি। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল ঘোষণা করতে পারে ইসি। এর আগে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনে বড় রকমের পরিবর্তন আনল সরকার।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আরপিওর সংশোধিত অধ্যাদেশ নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, কমিশনের সুপারিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ন, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ও বিদেশি শাখা বিলুপ্তির প্রস্তাব আমলে নেওয়া হয়নি। প্রার্থী হওয়ার ছয় মাস আগেই ঋণখেলাপিমুক্ত হতে হবে– এমন প্রস্তাবও বাদ দেওয়া হয়েছে। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্যানেল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন হয়। এর পরই বিএনপির পক্ষ থেকে একই প্রতীকে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আপত্তি ওঠে। অন্তত দুই দফা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এক পর্যায়ে বিএনপির আপত্তি আমলে নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলের খবর প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। তবে তীব্র বিরোধিতায় নামে জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
এর আগ থেকেই অবশ্য জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। আরপিও সংস্কার নিয়ে রাজনীতির ময়দানে চলমান মতবিরোধ বাড়তি উত্তাপ ছড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে সোমবার মধ্যরাতে আরপিও সংশোধনের গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
তবে গতকাল মঙ্গলবারও বিএনপির জোট শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ পরিবর্তনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
নতুন অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া পলাতক আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না রাখা, প্রার্থীদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের বিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখা, ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত বিধান বিলুপ্ত, ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকে লেনদেনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
নতুন আরপিও অনুযায়ী, সমভোট পেলে হবে পুনঃভোট, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি চালু করা, অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধান, এআইয়ের অপব্যবহারকে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য (ভোটে অযোগ্য এমন) দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে আরপিওতে বলা হয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দণ্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় গণভোট প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য ও সরকারি সিদ্ধান্ত এলে ইসির কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ব্যবস্থা নিতে পারবেন– এমন বিধান রাখা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে হলফনামায় অসত্য তথ্য যাচাই ও ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নির্বাচনী আইনের সব ধরনের সংস্কার কাজ শেষ হলো। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, ভোটকেন্দ্র নীতিমালা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, সাংবাদিক নীতিমালাসহ সব ধরনের আইন-বিধি সংস্কার করেছে ইসি।
আরপিও সংশোধন হওয়ায় এর আলোকে দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা শিগগির জারি করবে ইসি।
নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনের বিধান করে আরপিও সংশোধনের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। কেননা, অনেক দল মাঠে না থেকেও বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট করে সেই দলের প্রতীকে নির্বাচন করে। এতে যারা প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি করতে চান, তাদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ে। নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনের বিধান থাকলে এই ধরনের সমঝোতা কমবে।
জানা গেছে, আরপিওর ২০ ধারার এই সংশোধনী নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের বিষয়ে সোমবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি বৈঠকে’ আলোচনা হয়। বৈঠকে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আরপিওর সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় আবার পরিবর্তন আনার কথা বলেন। তাদের যুক্তি ছিল, নির্বাচন কমিশনে যেহেতু অনেক দল আপত্তি জানিয়েছে, তাই আরপিও আবার সংশোধন দরকার। তবে, উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বৈঠকে মত দিয়ে বলেন, মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে; পাশাপাশি রাজনীতিতেও নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। উপদেষ্টাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে মতভেদের কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার আর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। যদিও আরপিওর বিষয়টি আরও পর্যালোচনা করতে আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]