সাহিত্যে জাগরূক প্রতিভা রণজিৎ সরকার
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:২৪
সাহিত্যে জাগরূক প্রতিভা রণজিৎ সরকার
অনিন্দিতা রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

রণজিৎ সরকার। সাহিত্য নিয়ে যাদের অল্পবিস্তর আগ্রহ আছে, অমর একুশে গ্রন্থমেলা এলেই যারা সাগ্রহে চলে যান মেলার উৎসবে, বই সংগ্রহ থেকে শুরু করে বই পড়া সবটাতেই যারা পান নির্মল আনন্দ এই নামটা তাদের চেনা এবং জানা। দেশত্মাবোধের সকল চেতনাকে তুলে ধরতে চান লেখনীতে, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বাংলার ইতিহাস উপজীব্য করে লিখতে ভালোবাসেন, শিশু ও কিশোরের মনের ছবিটি চিত্রিত হয় যার গল্পে-কবিতায়-উপন্যাসে, প্রেম-অপ্রেমেও যার লেখনী ক্ষুরধার তিনি রণজিৎ সরকার।


যাকে নিয়ে বলছি, রণজিৎ সরকার— নামের মতোই সে রণজিৎ, তবে রণে নয় সাহিত্যে বিজয়ী এক মুখ। সদা হাসোজ্জ্ব্যল এই যুবকের সাহিত্যও মুক্তোদানার হাসিতে ঝরে। আর পাঠকের ঝুলিতে গেলে হয়ে ওঠে রত্ম-আকরের মতোই মূল্যবান।


প্রথম গল্পের বই ‘স্কুল ছুটির পর’ ২০১২ সালের বইমেলায় প্রকাশ হলে ব্যাপক সাড়া পায়। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে ৬২টি। পেয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০২০)। ‘জননীজন্ম’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল (ডিএসইসি) লেখক সম্মাননা।



নারায়ণ সরকার ও শোভা সরকার দম্পতির সন্তান রণজিৎ। পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সরাইদহ গ্রামে। ক্লাস নাইন থেকে ডেবিট-ক্রেডিট পড়তে পড়তে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স। তবে লেখালেখির শুরুটা শৈশব-কৈশোরেই, অর্থাৎ ছোট থেকেই সাহিত্যজগতে পদচারণা রণজিৎ সরকারের। লেখার নেশা থেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন সাংবাদিকতা। একটি জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত। নিয়মিত লিখছেন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ছোটকাগজ, অনলাইনে।


রণজিৎ সরকারের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ব, ছোটদের বইয়ের বন্ধু বঙ্গবন্ধু, শিশু-কিশোরদের গল্পে গল্পে বঙ্গবন্ধু, ভাষা শহীদের গল্প, বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প, গল্পে গল্পে জাতীয় চার নেতা, গল্পে গল্পে বর্ণমালা, প্রেমহীন ক্যাম্পাস, নায়িকার প্রেমে পড়েছি, ক্যাম্পাসের প্রিয়তমা, প্রেমজ্বলে ডুবে যাই, পরীর সঙ্গে দেশ ঘুরি, স্কুল ছুটির পর, ক্লাসরুমে যত কাণ্ড, ও প্রেমভূতির নিমন্ত্রণলিপি।


লেখালেখির শুরুর গল্প বলতে গিয়ে রণজিৎ বলেন, আমার শুরুটা মূলত মায়ের আশীর্বাদে। আমার প্রথম লেখাটা ছিল কবিতা। কবিতাটা ছিল মাকে নিয়ে লেখা। কবিতার নাম ছিল ‘মা’। আমি একদিন পড়তে বসে মাকে কাছে ডাক দিলাম। মা আমার কাছে এলেন। মাকে বললাম, তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি মা। তুমি শুনবে? মা রাজি হয়ে গেলেন। আমি কবিতাটা পড়ে শুনালাম। কবিতাটা পড়া শেষ হলে মায়ের চোখের জল টপটপ করে পড়তে লাগল। আমিও কেঁদে ফেললাম। মা আমরা মাথা হাত রাখলেন। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ওই কবিতাটাই পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। কয়েকদিন পর ছাপা হলো। এইটা আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা।



শুধু তাই নয় রণজিৎ আরো বলেন, বাড়িতে সন্ধ্যায় বিবিসি শোনা হত। গ্রামের সবাই আসত। একদিন মা সবাইকে বললেন, আমার ছেলে রণজিৎ, কবিতা লিখে। সেই আসরে আমার কবিতা পড়া হলো। সবার বাহবা পেলাম, মা খুশি হলেন, নতুন উৎসাহ পেলাম। তখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি। বন্ধুমহলে কবি পরিচয়ে পরিচিত হতে শুরু করলাম। বন্ধুরা অনেকে মজাও করত, কিন্তু সেও এক নির্মল আনন্দ।


ছোটবেলায় রণজিৎ সরকারের মজার এক অভ্যাস ছিল, আর সেটি হল নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ভুয়াইগাঁতী বাজারের সেলুনে ঢুকে নিজের চেহারাটা দেখতেন। চেহারা দেখা হলে, সেলুনে পত্রিকা পড়তেন। হাসতে হাসতে রণজিৎ বলেন, নায়ক হওয়ারও শখ ছিল মনে। তবে মূলত চাইতাম আমার নামটা ছাপা হোক, ছাপার অক্ষরে আমাকে সবাই জানুক।


সেই সেলুনে বসে যখন স্বপ্নের বীজ বুনন শুরু সেসময়ে রণজিৎ প্রথম প্রথম পত্রিকা হাতে নিয়ে সাহিত্য আর বিনোদন পাতা চোখ বুলাতেন। সাহিত্য ও বিনোদন দেখে কখনও কখনও শিরোনামগুলো পড়ে রেখে দিতেন। ধীরে ধীরে পত্রিকা পড়ায় গভীর মনোযোগ দিলেন। ছোট রণজিৎ আবিষ্কার করল, পত্রিকার পাতায় অনেক মানুষের নাম ছাপা হয়। তার খুব ইচ্ছা হলো নিজের নামটা পত্রিকায় ছাপা অক্ষরে দেখার। কিন্তু কীভাবে কোথায় লেখা পাঠাবেন। তা কোন কিছুই জানেন না। হঠাৎই করতোয়া পত্রিকায় গল্প, কবিতা, ছড়া, লেখা আহ্বান দেখতে পেলেন, এরপর মাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা ডাকযোগ পাঠিয়ে দেন। পরের সপ্তাহে ছাপা হলো। রণজিৎ খুশিতে আত্মহারা, স্বপ্নদুয়ার বুঝি খুলে গেল।



সাগ্রহে ছাপা হওয়া নিজের লেখা বন্ধুদের দেখাতে লাগলেন রণজিৎ। বন্ধুরা তাকে একটু অন্য চোখে দেখতে শুরু করল। তার বন্ধু শ্যালম লেখালেখির বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তারপর বন্ধুরা মিলে কবিতা কম্পোজের পর প্রিন্ট করে ভুঁইয়াগাতী বাজারের প্রায় প্রতিটি দোকানে লাগাতেন। স্কুলের ওয়ালসহ বিভিন্ন জায়গায়। তারপর ধীরে ধীরে লিখতে লাগলেন। জাতীয় দৈনিকসহ স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে লেখা পাঠাতে লাগল। লেখা ছাপা হতে শুরু হলো। আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল তার। তারপর থেকে নিয়মিত লিখছেন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ছোটকাগজ, অনলাইনে।


প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতিচারণ করে রণজিৎ বলেন, আমার প্রথম বই প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। ‘স্কুল ছুটির পর’ ছোটদের গল্পের বই। বইটি মেলায় এসেছিল ৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ওইদিন বিকেলে ২০ কপি বই নিয়ে এলে এক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। একটা শিশুর কথা খুব মনে পড়ে। ওই শিশু আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল। আমি লজ্জায় স্টলের সামনে থেকে পালিয়ে যাই। তারপর থেকে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ওইদিনের স্মৃতি বারবার মনে পড়ে। শিশুটি মনে হয় বইমেলায় এসে বলবে, আমি সেই মেয়েটি যাকে প্রথম অটোগ্রাফ দেননি। আজও শিশুটির অপেক্ষায় আছি। এখন অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় শিশুটির কথা মনে হয় খুব।


দীর্ঘ এক দশক ধরে লিখছেন রণজিৎ। লেখালেখি, বই প্রকাশ ও পাঠকের ভালোবাসা পেয়ে অনেক ভালো লাগা ও ভালোবাসার জায়গা তৈরি হয়েছে রণজিৎ তার। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই যে ভালোবাসা ও ভালোলাগার জায়গাটা এটা লেখালেখি ছাড়া সম্ভব হতো না। প্রতিটি বই প্রকাশের অনুভূতি আমার একই রকম। প্রতিটি মা যেমন তার সন্তানদের সমানভাবে ভালোবাসেন; ঠিক তেমনই আমার বইগুলোর অনুভূতি একই রকম থাকে। তবে ভালো লাগাটা বেশি তখনই হয়; যখন একটা ভালো লেখা হয়, তখনকার অনুভূতিটাই বেশি ভালো লাগে। ভালো লেখার অপেক্ষায় আছি।



তরুণ বয়সেই অনেকগুলো বই বের হয়েছে এবং তার লেখা জনপ্রিয়ও। এ প্রসঙ্গে রণজিৎ সরকার বলেন, আমি নিয়ম করে প্রতিদিন লিখি। প্রতিদিন কিছু না কিছু না লিখে থাকতে পারি না। লেখালেখিটা আমার মজ্জাগত। আমার ভেতরে সব সময় লেখালেখির ভাঙা গড়ার ভাবনার কাজ করে। লেখালেখির ভাবনা ছাড়া আমি অন্য কোন কিছু অতি সহজে ভাবতে পারি না। যেমন বিশ্ববিখ্যাত লেখক গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছেন, ‘লেখকের ২৪ ঘণ্টার চাকরি হলো, লেখালেখি করা।’ আমি লেখার কোন বিষয় পেলে, বিষয়টা নিয়ে ভাবতে থাকি লিখব কী লিখব না। যদি দেখি আমি লিখতে পারব, তাহলে ভাবতে থাকি, কীভাবে শুরু করব। চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য, সংলাপ নিয়ে ভাবি, বিভিন্নভাবে তারপর লেখা শুরু করি। আমি জনপ্রিয় কী না, তা জানি না। আমার ভেতর থেকে লেখার তাড়া দেয়, আমি লিখি। আমার দায়িত্ব লেখা, আমি লিখি। বাকিটা সময় বলে দেবে।’


লেখালেখির নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে রণজিৎ সরকার বলেন, ‘লেখালেখি করতে ভাল লাগে তাই লিখি। নেশার মতো প্রতিদিন না লিখে থাকতে পারি না। স্কুলজীবনে পরীক্ষার খাতায় জীবনের লক্ষ্য রচনাতে লিখেছিলাম ‘আমি লেখক হব।’ সে কথা মনে পড়লে আমার এখন নিজের হাসি পায়। মাঝে মাঝে ভাবি ছেলেবেলায় এত বড় দুঃসাহস ছিল আমার। এখন তো এ কথা ভেবে ভয় পাই। কারণ আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি লেখক হওয়া কতো বড় কঠিন কাজ। আর ভাল মানুষ হিসেবে সৎ থেকে নিয়মিত লিখে যেতে চাই।’


তবে শিশুসাহিত্য নিয়ে রণজিৎ সরকারের ভাবনাটা একটু আলাদা এবং বিস্তৃত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবনার জায়গা অনেক আছে। শিশুদের মনন ও সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য দরকার ভালো বই। ভালো বই লেখার দায়িত্ব কিন্তু একজন লেখকের। লেখকের সাথে জড়িয়ে আছেন এক সচেতন অভিভাবক। একজন অভিভাবক যদি ভালো বই শিশুকে তুলে দেন, তাহলে সে কিন্তু ভালো কিছু জানতে পারবে। ভালো বই পড়ে নিজের বোধশক্তিটা বাড়াতে পারবে। বোধশক্তি তৈরি হলে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। অন্যকে বোঝাতে তার সহজ হবে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। লিখতে লিখতে কোন লেখাটি ভালো হবে, তা বলা যাবে। তবে আমি আজীবন ভালো লিখতে চাই। সময় বলে দেবে কোন লেখাটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।


জগতের সকল জাগরূক সৌন্দর্যের মতোই সাহিত্যজগতে রণজিৎ প্রতিশ্রুতিশীল এক কথাশিল্পী। যার প্রতিভা সদা জাগরূক। তিনি তার শিল্পের মধ্য দিয়ে আজীবন বলতে চান দেশ ও দশের কথা, মা ও মাটিকে ভালোবেসে বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চান দেশীয় পরিমন্ডল ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত করে, নবকুঁড়িটির বুকে লিখে যেতে চান সুন্দরের নাম, যার ঘ্রাণ নিবে বাংলার প্রতিটি শিশু।


বিবার্তা/এসবি/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com