জীবন সংগ্রামজয়ী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মোত্তালিব মিহির
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৪
জীবন সংগ্রামজয়ী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মোত্তালিব মিহির
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

জন্ম হোক যথা, কর্ম হোক ভালো। আবার এও সত্যি, জন্ম নয় কর্মেই মানুষের পরিচয়। চিরায়ত এই বাংলা কথাগুলো সত্যে ও বাস্তবে রূপান্তরিত করে, যথার্থে উত্তীর্ণ করে, নক্ষত্রসম ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা এক তরুণ এম এ মোত্তালিব মিহির। জীবন যার কাছে নিবিড়ভাবে ধরা দিয়েছে দারিদ্র্যের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, জীর্ণ মুখে শুষ্ক হাসি নিয়ে বাস্তবতা বারবারই তাকে উপহাস করেছে, কিন্তু মোত্তালিব মিহির জীবনযুদ্ধের প্রতিটি প্রতিকূলতাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন সহাস্যে। আর তাই কণ্টকাকীর্ণ পথের পথিক হওয়া স্বত্বেও তীব্র অর্থসংকটকে সঙ্গী করেই পড়ালেখার সকল ধাপ সফলতার সাথে পেরিয়ে মোত্তালিব মিহির হয়েছেন বিসিএস ক্যাডার।


বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা তার জীবনের স্বপ্ন ছিল এমনটা নয়, মূলত দারিদ্র্যের জন্য যখন বারবার তার পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছিল তিনি একটা স্বপ্নই সামনে স্থির করেছিলেন, আর সেটি হল তার মতো অসংখ্য তরুণের পাশে যেন দাঁড়াতে পারেন এমন যোগ্যতায় নিজেকে উত্তীর্ণ করতে চেয়েছেন। আর করেছেনও তাই। সরকারি কর্মকমিশনে নিযুক্ত হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারে। আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠা এখন তার জন্য সময় আর সুযোগের অপেক্ষামাত্র।


বগুড়ার শিবগঞ্জের বর্গাচাষি মহাবুল ইসলাম ও জামিলা বিবির সন্তান এম এ মোত্তালিব মিহির। বর্গাচাষি বাবা আর গৃহিণী মায়ের একান্ত লালিত স্বপ্ন ছিল তাদের ছেলে মিহির একদিন সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছাবে। মিহির বলেন, গ্রামের একদম সাদামাটা কৃষক পরিবারে জন্ম আমার। সোনাফলা গ্রাম আমার, এক জমিতে তিন ফসল ফলে এমন। গ্রামও ছিল বৃহৎ,  কিন্তু আমার গ্রামে শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। আমিই আমার গ্রাম থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই।


বগুড়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামের অতি সাধারণ পরিবেশে গ্রামীণ এক পরিবারে বেড়ে উঠছিলেন এম এ মোত্তালিব মিহির। গ্রাম্য পরিবেশ সাধারণত যেমন হয় সেরকমই ছিল তার জীবনযাপন। তাই পড়ালেখা নিয়ে সবিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না। কিন্তু একটি ঘটনা বদলে দেয় তার জীবন। মিহির বলেন, আমি গণিত খুব কম পারতাম। একদম টেনেটুনে পাশ করতাম। সেসময় আমাদের গ্রামে একজন গণিতের শিক্ষক ছিলেন। দশ গ্রামের সবাই তার কাছে গণিত পড়তে যেত। আমাদের তখন বছরে তিনটি পরীক্ষা হত। প্রতি পরীক্ষার আগে স্যার তার প্রাইভেটে পরীক্ষা নিতেন। যথারীতি এক পরীক্ষার সময় আমি পরীক্ষা দিচ্ছি। ম্যাথ কিছু পারি না, খুব দুষ্টামি করছি। তখন আমি সেভেন থেকে এইটে উঠবো। সেই পরীক্ষার হলের একটি ঘটনা সম্পূর্ণ বদলে দেয় আমার জীবন।


পরীক্ষার হলে খুব দুষ্টামি করছিলেন মিহির। শিক্ষক তাকে বললেন, তুমি যে এত লম্ফঝম্প করছো তোমাকে তো কেউ গুনছে না। ওই ঘড়িটা দেখো। ওই ঘড়িতে ঘণ্টার কাটা যতটা ঘুরছে তার চেয়ে বেশি ঘুরছে মিনিটের কাটা, তারচেয়ে বেশি ঘুরছে সেকেন্ডের কাটা। সবাই ঘণ্টার কাঁটাটাকেই গোনে। গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীরাই সেখানে পরীক্ষা দিচ্ছিল। হঠাৎ শিক্ষকের এরকম কথা মোত্তালিব মিহিরকে নাড়া দেয়। খুব অপমানবোধও হয় তার। সে সিদ্ধান্ত নেয়, ভালো করে পড়াশোনা করতেই হবে তাকে। খুব পড়াশোনা করতে শুরু করেন মিহির। পরের পরীক্ষায় রেজাল্ট কিছুটা ভালো হলেও ততটা ভালো হয় না। কিন্তু মিহির বুঝতে পারেন আরো চেষ্টা করলে হয়ত ফলাফল ভালো হবে। তিনি চেষ্টা বাড়িয়ে দেন আরো বেশি করে।


ফলে পরবর্তী পরীক্ষায় তার রেজাল্ট খুব ভালো হয়। হঠাৎ করে তার এরকম পরিবর্তন সবাইকেই ভাবায়। অনেকেই ভাবে সে শিক্ষকের কাছে পড়ে আলাদা সুবিধা পেয়ে রেজাল্ট ভালো করেছে, কেউ ভাবে সে হঠাৎ ভালো করেছে ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু মিহির সংকল্প করে নেয় যে তাকে আরো ভালো করতে হবে। ফলে সে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু কলেজ পাশ করার পর আবার বাধা পড়ে তার পড়ালেখায়। তীব্র অর্থসংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দুয়ার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তার। তবে, মিহির কিন্তু দমে যাওয়ার মানুষ নয়।


মিহির বলেন, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত গণিতে আমি টেনেটুনে পাশ করতাম। একদম তেত্রিশ পেয়ে পাশ করতাম। হয়ত এক দুই নম্বর গ্রেস দিয়ে পাশ করাত আমাকে। আমি যে অতীতের এসব গল্প বলছি তাতে আমি লজ্জিত নই। কারণ, এসব দুর্বলতা থেকে শিক্ষে কাজে লাগিয়ে আমি পরবর্তী জীবনে সাফল্য অর্জন করেছি।


আবার একটু পেছনে ফিরব যেতে হয়, যখন ক্লাস সেভেনে পড়তেন মিহির তখন চাচার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হয় তাকে। কারণ, পারিবারিক অবস্থা তেমন ছিল না যেন পড়ালেখা করবেন। চাচার সাথে দোকানে গিয়ে কাজ করে দিতেন। চাচা কিছু টাকা দিলে সেটি দিয়ে বাবা-মার জন্য ছোটোখাটো কিছু হলেও কিন্তু। ছোট্ট মিহিরের এ ছিল এক পরম আনন্দ। তবে শুধু সেই কৈশোরেই নয়, জীবনের প্রতিটি ধাপে বাবা-মা পরিবারের কথা ভেবেছেন সযত্নেই। কলেজে যখন পড়া শুরু করেন তখনকার একটি গল্প উল্লেখ না করলেই নয়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ইউনিফর্ম, বইপত্র সবই কেনা হল। বাধ সাধল অন্য একটি বিষয়। কলেজের ইউনিফর্মে যে জুতা অন্তর্ভুক্ত ছিল সেটির দাম ছিল প্রায় বারোশ টাকা। সেই টাকা দিয়ে জুতা কেনা প্রায় অসম্ভব ছিল মিহিরের পক্ষে। কিন্তু মিহির কি পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ। আলু ক্ষেতে কাজ করতে শুরু করল মিহির, হাল চাষ দিয়ে জুতা কেনার টাকা জোগাড় করে নিজের কলেজে যাওয়া নিশ্চিত করেন তিনি।



মোত্তালিব মিহির বলেন, এইচএসসি পড়াশোনা শেষে ২০১২ সালে ঢাকায় এসে আর্থিক অভাব অনটনের জন্য আবারও পড়াশোনা ছেড়ে দিই। একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেই। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করতাম। সারাদিন গেইটে বসে থাকতে হতো। সময় কাটতো না তাই মাঝে মাঝে বই পড়তাম। একদিন ছুটি নিয়ে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করি। সে ঢাকায় এসেছে কোচিং করে অ্যাডমিশন দিবে। তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সম্পর্কে জেনে পড়াশোনার সেই উদ্দীপনা আবারো জাগে। সিকিউরিটি চাকরির বেতন হতে কিছু টাকা জমিয়ে ভর্তি হয়ে যাই একটি কোচিংয়ে।


এভাবে চাকরির পাশাপাশি কোচিং করে ২০১৩ সালে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। সিকিউরিটি চাকরিটি ছেড়ে দিলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এই ভয়ে ঢাকাতেই থেকে যাই এবং ভর্তি হই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই শুরু হলো নতুন এক সংগ্রাম। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করে কলাবাগান থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে ক্লাস করতে হতো। ভাড়া বাঁচানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসেই যাতায়াত করতাম। আমার মনে আছে একদিন ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময় স্টুডেন্ট ভাড়া ছয় টাকা না থাকার কারণে সদরঘাট থেকে কলাবাগান পর্যন্ত হেঁটে আসতে হয়। এভাবে কখনো সিকিউরিটি চাকরি কখনো বা টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হয়েছে।


মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়াতে হয় মিহিরকে। একসাথে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও শেষপর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। একদিকে পড়াশোনার খরচ, অন্যদিকে থাকা-খাওয়ার খরচ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার খরচ জোগানোই শুধু নয়, ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ জোগানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যায় মিহিরের জন্য। কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো মিহিরের জীবনকে অবরুদ্ধ করে নিয়েছিল বহু আগেই। মিহিরও সাহসিকতার সাথে চ্যালেঞ্জকে আলিঙ্গন করেছিল। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ার ধাপে ধাপে টিউশনি, প্রুফ রিডিং এবং সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোত্তালিব। কোনো কিছুই তার অগ্রগতিতে বাধা হতে পারেনি। রাত জেগে ডিউটি করে আবার ক্লাসে বসতেন, পড়তেন। তিনি কখনোই ভাবেননি, নাহ আমি পারবো না। মন থেকে চেষ্টা করলে যেকোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে সকল সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডার। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) থেকে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।



তিনি আরও জানান, শত বাঁধা পেরিয়ে আমাকে এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে। তবে কখনো হাল ছাড়িনি। আমি এমন একটা গ্রাম থেকে উঠে এসেছি যেখানে ছেলেমেয়েদের নাম দস্তখত শেখার পরে স্বপ্নই থাকতো বিদেশ চলে যাবে। এরকম একটা পরিবেশে আমি স্বপ্ন দেখতাম আমি একদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করব। তবে কখনো ভাবিনি যে বিসিএস এর মতো এত প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটা পরীক্ষা দিয়ে দেশের প্রথম শ্রেণির একটা চাকরি করব।"


মোত্তালিব বলেন, বিসিএস ক্যাডার হওয়া যতটা না কষ্টের তার থেকে বেশি কষ্টসাধ্য কাজ হচ্ছে লেগে থাকা। তাই ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকলে একদিন সফলতা আসবেই। জীবনে দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে আল্লাহর অশেষ রহমতে আজকে আমি ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। তবে, আমি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই। আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে দেশ ও দশের উপকারে আসতে পারি। আমার মতো যে-সব তরুণ পড়ালেখা করতে যেয়ে বাধার মুখে পড়ে তারা যেন সেই বাধাকে অতিক্রম করতে সহযোগিতার হাতটি পাশে পায়।


বিবার্তা/এসবি/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com