'গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে'
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ২১:৪২
'গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

গোপালগঞ্জ জেলায় ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হামলার ঘটনার পর দুই দিনব্যাপী সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।


প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের পর আসক বলছে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা-সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে আসক।


২১ থেকে ২২ জুলাই আসকের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গোপালগঞ্জে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। সহিংসতার ঘটনায় নিহত, আহত, আটক-গ্রেপ্তার হওয়া নাগরিকদের পরিবার ও স্বজনদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী এবং কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আসকের প্রতিনিধিরা।


পরে শুক্রবার (২৫ জুলাই) নিজেদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে আসক।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আসক মনে করে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এ ছাড়া ১৬ জুলাই রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা–সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আসক এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।’ এতে বলা হয়, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা আসককে জানিয়েছেন, এনসিপির নেতারা স্বল্পসংখ্যক সমর্থকের উপস্থিতিতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এই মন্তব্যের পরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরে সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এনসিপির নেতাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধারণ জনতা’ রাস্তায় নেমে আসে, একপর্যায়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।


আসকের প্রতিবেদন বলছে, গোপালগঞ্জের সমাবেশের দিন সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকেরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র ছিল।...১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা চলাকালে নির্বিচার নাগরিকদের আটক ও গ্রেপ্তার করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মতো অভিযোগও উঠেছে। ভয়ে মানুষকে নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরপরাধ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলার যেসব এলাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, সেসব এলাকাতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড়ের অভিযোগ রয়েছে।


সহিংসতার ঘটনায় নিহত পাঁচজনের মধ্যে শুধু ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া রমজান মুন্সীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে আসকের প্রতিনিধিদল। তাঁর সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে গুলির চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। আসকে প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত ইমন তালুকদারের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিকেল পাঁচটার দিকে মরদেহ দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য হয়েছেন। ইমনের শরীরে গুলির চিহ্ন এবং শরীরের মুখমণ্ডলসহ নানা স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ইমন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, সে একটি ‘ক্রোকারিজের’ (তৈজসপত্র) দোকানে কাজ করত। নিহত রমজান কাজী, দীপ্ত সাহা ও সোহেল মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে, হাসপাতাল থেকে দ্রুত মরদেহ নিয়ে দাফন বা সৎকারের তাগিদ দেওয়া হয়, যে কারণে তাঁরা লাশ নিয়ে এলাকায় চলে যান।


গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে ২০ জুলাই দীপ্ত সাহার পরিবার ছাড়া অন্য তিনটি পরিবারকে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরিবারের সদস্যরা যেন ২১ জুলাই কবরস্থানে সকাল ১০টায় উপস্থিত থাকেন, মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হবে। পরে ২১ জুলাই কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। রমজান কাজী ও ইমনের মরদেহ উত্তোলন ও সুরতহাল প্রক্রিয়ায় সরেজমিনে উপস্থিত ছিল আসকের প্রতিনিধিদল। পরিবারগুলো এই প্রক্রিয়াকে নতুন একধরনের হয়রানি বলে মনে করে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা যথাযথ বিচার দাবি করেছেন।


গোপালগঞ্জের ঘটনায় ২১ জুলাই পর্যন্ত মোট আটটি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি মামলার কপি পেয়েছে আসকের তথ্যানুসন্ধান দল। সেগুলো বিশ্লেষণ করে তারা বলেছে, মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ৪০০। এর মধ্যে আসামির তালিকায় নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫৮ জনের। এসব আসামির মধ্যে ৩ জন নারী এবং ৩২ জন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন। ছয়টি মামলার তিনটি সন্ত্রাসবিরোধী আইন, দুটি ফৌজদারি আইনে ও একটি মামলা হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইনে। ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ১৮ জন শিশুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর আওতায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।


আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ২৪ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১ জন সাধারণ নাগরিক, দুজন পুলিশ সদস্য এবং আরেকজন গোপালগঞ্জ সদরের ইউএনওর গাড়িচালক। আহত ব্যক্তিদের কতজন গুলিবিদ্ধ ছিলেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও আহত দুই পুলিশ সদস্য ও ইউএনওর গাড়িচালক—তাঁদের কেউ গুলিবিদ্ধ ছিলেন না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত ব্যক্তিদের তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৬ জুলাই দুপুর থেকে মোট ৪ জনকে মৃত অবস্থায় গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। দীপ্ত সাহাকেও ‘ব্রট ডেথ’ (মৃত অবস্থায় আনা) ঘোষণা করা হলেও তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টি সঠিক নয়।


গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) আসকের প্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘১৬ জুলাই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি, বরং সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেছে হামলাকারীরা। একপর্যায়ে এনসিপি নেতাদের আমার কার্যালয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি (সাঁজোয়া যান) আমার অফিসে নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করতে হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে।’


হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে এসপি আরও বলেছেন, ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। ওই দিন পর্যন্ত মোট ৮টি মামলা হয়েছে। কারাগার এবং সরকারি সম্পত্তিতে হামলার ঘটনায় তখনো মামলা হয়নি, তবে কারাগার কর্তৃপক্ষ মামলা করবে।


আসকের প্রতিনিধিরা গোপালগঞ্জ সদর থানায় তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর গোপালগঞ্জে দায়িত্বরত সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ করতে পারেনি আসকের প্রতিনিধিদল।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com