
একই দিন, একই সময়, দুই শহরে একই ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ হওয়ার দাবি!—সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ এর করা দুটি মামলা ঘিরে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য, উঠেছে বিশ্বাসযোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে বড় প্রশ্ন।
গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে’ অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে দাবি করেছেন এমদাদ। তবে বিভ্রান্তির শুরু এখান থেকেই। ঢাকার শাহবাগ থানায় করা মামলায় বলা হয়েছে—ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর পরীবাগে, আর খুলশী থানায় করা আরেক মামলায় বলা হয়েছে—ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায়!
চার মাস আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা মামলায় বাদী হয়েছেন বিএনপির অঙ্গসংগঠনের সাবেক নেতা এমএ হাশেম রাজু। সেখানে এমদাদের পক্ষে ২০১ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে রয়েছেন দেশত্যাগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাও। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথাই সেখানে বলা হয়েছে।
আর ১০ মাস পর নিজেই বাদী হয়ে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় মামলা করেন এমদাদ। সেখানে আবার দাবি, তিনি চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হন। দুই মামলার এজাহারে দুটি ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি দুই ভাষ্যেই রয়েছে গুলির ধরন, আহত হওয়ার স্থান ও চিকিৎসার বর্ণনায় বিস্তর অসঙ্গতি।
ঢাকার মামলায় বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট পরীবাগ মোড়ে মিছিলে গুলিবর্ষণের সময় এমদাদ ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন, পরে তাকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয় এবং ৫ আগস্ট তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
চট্টগ্রামের মামলায় আবার দাবি করা হয়, ৪ আগস্ট নিউ মার্কেটে এবং পরদিন ৫ আগস্ট ওয়াসা মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার ডান চোখে গুলি লাগে, বাম চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই ব্যক্তির একই সময়ে দুই স্থানে থাকা ও আহত হওয়ার দাবি আইনজীবীদের চোখে “অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও নজিরবিহীন”।
খুলশী থানার ওসি মো. আফতাব হোসেন বলেন, “একই ঘটনায় একাধিক মামলা হতে পারে না। একই ব্যক্তি একই সময়ে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হওয়াও অসম্ভব। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর বলেন, “মামলার তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না, কারণ ভিকটিমের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল সনদ দেওয়া হয়নি। বহুবার যোগাযোগ করেও তা পাওয়া যায়নি।”
মামলা দুটি ঘিরে সবচেয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এজাহারে স্থানীয় সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের নাম অন্তর্ভুক্তি। চট্টগ্রামের মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১৬৭ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন চারজন সাংবাদিকও। অথচ তাদের কেউই ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে জানা গেছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান বলেন, “ফৌজদারি আইনের ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করলে দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে। একই সঙ্গে দণ্ডবিধির ১৮২ ধারায় সরকারি কর্মকর্তাকে মিথ্যা তথ্য দিলে তা অপরাধ।”
ঢাকার মামলার বাদী এমএ হাশেম রাজু বলেন, “৪ আগস্ট ঢাকাতেই গুলিবিদ্ধ হন এমদাদ। তিনিই আমাকে লিখিত ক্ষমতা দিয়ে মামলা করতে অনুরোধ করেন।” চট্টগ্রামের মামলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আইনজীবীরা বলছেন, মামলাগুলো শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না—তা খতিয়ে দেখা জরুরি। একই ঘটনায় দুই শহরে দুই ভাষ্যের মামলা করার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিভ্রান্তি ছড়ানো কিংবা হয়রানিমূলক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের জের ধরে বর্তমানে বিচারিক ও প্রশাসনিক যন্ত্রকে ব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। তবে একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুই শহরে আহত হওয়ার দাবি সত্য হলে তা হবে দেশের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা—আর যদি না হয়, তবে এটি হবে আরেকটি মামলার আড়ালে ‘মিথ্যার রাজনীতি’।
বিবার্তা/জাহেদ/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]