লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস আজ
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:০৫
লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস আজ
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

আজ (৪ ডিসেম্বর) লক্ষ্মীপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন ভোরে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে।


এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গুলি বর্ষণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ওই ঘাঁটির দুই শতাধিক রাজকার ও হানাদার সদস্য।


এটাই ছিল লক্ষ্মীপুরে হানাদার বিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ।


লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাষ্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ী ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলি বর্ষণ করতে করতে উক্ত ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ রেখে ৩ ডিসেম্বর ঘাঁটির খুব কাছাকাছি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় তারা। ৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদাররা আত্মসমর্পণ শেষে লক্ষ্মীপুর ছেড়ে চলে যায়।


এদিকে ৯ মাসে লক্ষ্মীপুরের রনাঙ্গণের ৩৭টি সম্মূখ্যযুদ্ধে অংশ নেন। এতে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।


বীর শহীদরা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্লাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো. মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্ল্যা, মো. আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল রশিদ।


তবে জেলায় মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪।


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো সময় জুড়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষত বিক্ষত ছিল।


অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিল। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে লক্ষ্মীপুর হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়।


লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রীজ, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গালর্স হাই স্কুল, মডেল হাই স্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, এল.এম. হাই স্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদরাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমলনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো ছিলো হানাদার ও রাজাকার ক্যাপ এবং গণহত্যার স্থান।


এদিকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাই স্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর- রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল.এল হাই স্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এবং ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর হাতে শত শত হানাদার ও রাজাকার নিহত হয়।
বিভিন্ন ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্য মতে, যুদ্ধের নয় মাস লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ বিশাল সারের গুদামটি ছিল মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙ্গালীদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। শেষে এদেরকে সন্নিকটস্থ রহমতখালী খালের উপর মাদামব্রীজে ফায়ার করে হত্যা করে খালে ভাসিয়ে দেয়া হতো লাশ। বাগবাড়ির এই জায়গাটিকে বলা হয় টর্চার সেল। যুদ্ধশেষে এই টর্চার সেল লাগোয়া গণকবর স্থাপিত হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত মাদাম ব্রীজ এলাকা। ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যাক্ত মাদাম ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়নি।


সূত্র আরও জানায়, নভেম্বরের শেষের দিকে রায়পুর আলীয়া মাদরাসায় হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে হানাদারদের সাথে সম্মুখ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বাসু শহীদ হন।


শহীদ আব্দুল হালিম বাসু’র নিজ এলাকা সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের প্রধান সড়কটি তার নামে নামকরণ করা হয়। বিজয়র নগর এলাকায় তার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাসু বাজার’।


১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এ কে এম আলী হায়দারের নেতৃত্বে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর বাঁধের হাট এলাকার রাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন মাজহারুল মনির সবুজ। তার নামানুসারে নিজ এলাকা ভবানীগঞ্জের পিয়ারাপুরে ‘ শহীদ মাযহারুল মনির সুবজ উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়।


বিবার্তা/সুমন/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com