টাঙ্গাইলে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৩, ১৫:১৯
টাঙ্গাইলে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

টাঙ্গাইলের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে পানি বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। জেলার মধুপুর ব্যতিত ১১টি উপজেলার ৩২টি হাটে এখন তৈরি নৌকা বিক্রি হচ্ছে। নৌকা তৈরির মৌসুমি কাঠমিস্ত্রিরা এখন খুবই ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। দিনরাত হাতুরি-বাটালের শব্দে মুখর টাঙ্গাইলের নৌকা তৈরির হাট-বাজার।


জানাগেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার মধ্যে মধুপুর ব্যতিত ১১টি উপজেলায় বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতে নৌকার প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে নৌকা তৈরির কাঠমিস্ত্রি (সুতার) ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দিনরাত কাঠ চিরানো, তক্তা ও গুড়া বানানো, রান্দা দিয়ে কাঠ মসৃণ করা, তারকাঁটা (ছোট লোহা) ও পাতাম (লোহার পাত) দিয়ে তক্তা জোড়া লাগানো ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কাঠমিস্ত্রিরা (সুতার)।


এসব কাজগুলো তারা বাড়ি বা পাড়ায় কিংবা নৌকার হাটগুলোর কাছাকাছি স্থানে করে থাকেন। নৌকা তৈরির মৌসুমি কাঠমিস্ত্রিরা বর্ষা মৌসুম ব্যতিত সময়গুলোতে বাড়ির পারিবারিক কাজ ও কৃষি কাজ করে থাকেন। আবার পেশাদার কাঠমিস্ত্রিরা সারা বছর নৌকা তৈরি ছাড়াও ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।


খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ১১টি উপজেলার ৩২টি হাটে বর্ষা মৌসুমে নৌকা বিক্রি করা হয়। হাটগুলো হচ্ছে-টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি, মাহমুদ নগর, ছিলিমপুর ও ওমরপুর; নাগরপুরের গয়হাটা ও চরসলিমাবাদ; মির্জাপুরের বরাটি, ছাওয়ালি মহেড়া ও চাকলেশ্বর; কালিহাতীর রামপুর, আউলিয়াবাদ ও কস্তুরিপাড়া; বাসাইলের মিরিকপুর, কাউলজানী, রাশড়া করিম বাজার ও ফুলকী; ঘাটাইলে কদমতলী ও হামিদপুর; ধনবাড়ীর পাইস্কা ও কেরামজানী; গোপালপুরের মোহনপুর, নলীন বাজার, নবগ্রাম ও চাতুটিয়া; ভূঞাপুরের ফলদা, গোবিন্দাসী, কুঠিবয়ড়া ও অর্জুণা; সখীপুরের দাড়িয়াপুর ও বহেড়াতৈল এবং দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, এলাসিন ও ফাজিলহাটি।


সরেজমিনে জানা যায়, কাঠমিস্ত্রিরা (সুতাররা) কেউ বাড়ির আঙনায় বা পাড়ার খালি জায়গায়, কেউ কেউ হাটের পাশে নৌকা তৈরি করছেন। কেউ কাঠ চিরাচ্ছেন, কেউ তক্তা ও গুড়া বানাচ্ছেন, আবার কেউ রান্দা দিয়ে কাঠ মসৃণ করছেন, কেউ কেউ তারকাঁটা (ছোট লোহা) ও পাতাম (লোহার পাত) দিয়ে তক্তা জোড়া লাগাচ্ছেন।


কাঠমিস্ত্রি বলরাম সূত্রধর, বিশ্বজিৎ সূত্রধর, স্বপন সূত্রধর, পলাশ সূত্রধর, হরিমোহন সূত্রধর সহ অনেকেই জানান, এখন প্রায় প্রত্যেক এলাকার বড় রাস্তাই পাকা করা হয়েছে। ফলে দূরের যাত্রার জন্য কেউ বড় নৌকা তৈরি করে না। বর্ষায় এ পাড়া থেকে ওপাড়া যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট নৌকার প্রয়োজন হয়। তাই বড় নৌকা তৈরি হয়না- ছোট নৌকার কদর বেশি। তারা আক্ষেপ করে জানায়, এক সময় এ পেশা তাদেরই ছিল। এখন অনেক এলাকায় মুসলমানরাও এ পেশায় এসে তাদের সুনাম ক্ষুন্ন করছে ও চাহিদা কমে গেছে।


অধিকাংশ কাঠমিস্ত্রি জানায়, বর্ষা মৌসুমে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেই তাদের সংসার চলে। ছোট সময় থেকে বাপ-দাদার কাছে হাতেখড়ি নিয়েছেন তারা। কাঠমিস্ত্রির কাজ করা তাদের নেশা ও পেশা। একটি নৌকা তৈরিতে তিনজনের ২-৩দিন সময় লাগে। তাদের কেউ কাঠ কাটছেন, আবার কেউ তারকাঁটা (ছোট লোহা) লাগাচ্ছেন। একজন পাতাম (লোহার পাত) দিয়ে তক্তা জোড়া দিচ্ছেন।


বাসাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিরিকপুর গ্রামের মৃত নেপাল সূত্রধরের ছেলে প্রফুল্ল সূত্রধর (৬৫) জানান, তিনি রাশড়া করিম বাজারে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করছেন। প্রফুল্ল সূত্রধরের সাথে আরও দুইজন কাজ করছেন। তারাও ব্যস্ত সময় পাড় করছেন।


তিনি জানান, দীর্ঘ ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন। ছোটবেলায় হাতুড়ি ও বাটালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। তাদের সময় পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি ছিল। সংসার চালানোই যেখানে দায়- সেখানে লেখাপড়ার প্রশ্নটা অবান্তর ছিল। বাপ-দাদারা বলেছে- কাঠমিস্ত্রির কাজ করেই পেট চালাতে হবে। তাই বাপ-দাদার সাথে কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখেছেন। মুরব্বীদের সাথে বাসাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করতেন। এখন বর্ষার সময় হলে নৌকা তৈরি করেন এবং শুকনো মৌসুমে ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি তৈরি করে হাটে বিক্রি করে সংসার চালান। বর্ষা মৌসুমে নৌকার কদর বেড়ে যায়। তাই বর্ষার সময় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাপ-দাদারা শিখিয়ে যাওয়া কাজ এখন তাদের নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে ২-৩দিন সময় ও ৮ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। হাটে ওঠালে একটি ছোট নৌকা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।


কাঠমিস্ত্রি রমেন স্যানাল জানান, শিশুকালে হাতুড়ি-বাটালের সঙ্গে বড় হয়েছেন তিনি। লেখাপড়া করেন নাই। পূর্বপুরুষের পেশাকেই মূল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বউ-বাচ্চা নিয়ে মোটামুটি ভালোই চলে যায়। তিনি চুক্তিতে বায়নায় নৌকা তৈরি করেন। এতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পান। বর্ষার সময় এলে আয়-রোজগার ভালোই হয়। শুকনো মৌসুমে সংসারের টুকিটাকি আর কৃষিকাজ করেন। তিনি এই পেশায় প্রায় ৩৫ বছর
ধরে রয়েছেন।


অপর কাঠমিস্ত্রি সখী সরকার জানান, প্রায় ৩০ বছরের বাপ-দাদার পেশায় আছেন তিনি। বর্ষার সময় নৌকা তৈরি ও অন্য সময় ঘর তৈরির কাজ করেন। বর্ষা মৌসুমে নৌকার খুবই কদর থাকে। এ সময় নৌকার কাজ বেশি করেন। নৌকা তৈরিতে লোহা, কাঠ, স্টিল ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।


বিবার্তা/ইমরুল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com