
রাষ্ট্রের যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাকর্মে নিযুক্ত থাকার কথা, সেই প্রতিষ্ঠান যখন নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে দেশের মানুষের গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে, তখন তা যতটা বিস্ময়ের, তারচেয়েও বেশি হতাশাব্যঞ্জক। বলছি, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই)-এর কথা। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড, লাগামহীন দুর্নীতি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যুথবদ্ধ অনিয়মের কারণে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক সময়ে অনৈতিক কার্যকলাপের শীর্ষে নাম লিখিয়েছে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (BORI) বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দেশের সমুদ্র সম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে এবং সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ভয়ংকরভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
সংস্থাটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদের একক স্বেচ্ছাচারিতায় বিপাকে পড়েছে শত শত চাকরিপ্রত্যাশী। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য একাই নিয়ন্ত্রণ করছেন ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ। ইতোমধ্যেই তিন কোটি টাকার বেশি লেনদেনও হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৩৯.০৮-০০০০,০০৯,১১,০০১.২২/৮১৩ স্মারকে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার, সাইন্টিফিক অফিসার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারসহ অন্যান্য পদের জন্য অস্থায়ী নিয়োগের লক্ষ্যে দরখাস্ত আহ্বান করে। প্রতিষ্ঠানটি ৫টি পদে ১৮ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পদগুলোর জন্য চলতি বছরের জানুয়ারির ১ তারিখ পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়। আবেদন সাপেক্ষে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ১ জুন। এরপর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়।
কিন্তু, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দুর্নীতি। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একেকজন প্রার্থীর কাছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। শুধু তাই নয়, একাধিক প্রার্থীর কাছে একসাথে মোটা অঙ্কের ঘুষ চাওয়া হয়। প্রার্থীরা ঘুষ দিতে না পারায় ভুক্তভোগী ওই প্রার্থীদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়।
ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার পদ ছাড়াও সাইন্টিফিক অফিসার পদে ওশেনোগ্রাফিক ডাটা সেন্টারে আবেদনের জন্য দুইটি পদ ছিল। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাউকেই এডমিট কার্ড দেওয়া হয়নি। একশর মতো প্রার্থী এক বছরের জিআইএস সার্টিফিকেট নিয়ে ডাটা সেন্টার আবেদন করেছিল। কিন্তু মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশীদ মাত্র একজনকে এডমিট কার্ড দিয়েছিলেন।
পরীক্ষার দিন জানা যায়, ডাটা সেন্টারের জন্য মাত্র একজনকে এডমিট কার্ড দেওয়া হয়েছে। যাকে ডাটা সেন্টারের এডমিট কার্ড দেয়া হয়েছিল- মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাকে পরীক্ষা দেওয়া থেকে বিরত রাখেন। সমুদ্রবিজ্ঞানের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই বিষয়ের প্রতিকার চেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রীর নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক চাকরিপ্রার্থী বিবার্তাকে বলেন, ম্যাডাম নিজে আমার সাথে টাকা লেনদেনের বিষয়ে কথা বলেছেন, আমার কাছে কললিস্ট আছে। আমি টাকা দিতে অপারগ হওয়ায় তিনি পরে আমার সাথে আর যোগাযোগ করেননি। এমনকি লিখিত পরীক্ষায় টিকলেও ভাইভায় আমাকে অপদস্থ করা হয়। অন্য প্রার্থীদের সর্বোচ্চ চার-পাঁচ মিনিট ভাইভা হলেও আমার ভাইভা হয় বিশ মিনিটের অধিক সময়। তখন আমার সাথে দুর্ব্যবহারও করা হয়। টাকা দিয়ে চাকরি নিতে পারছি না বলে এই অবস্থায় পড়তে হবে!
চাকরিপ্রত্যাশী শাহরিয়ার সিয়াম বিবার্তাকে বলেন, নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য বা দুর্নীতি এগুলো পত্রিকায় দেখেছি। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী, এতকিছু জানি না। তবে পরীক্ষা হয়েছে অনেকদিন, এখনো নিয়োগের বিষয়ে কোনো খবর নেই। আর আমরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখেছি ডাটা সেন্টারের জন্য একজন বাদে কেউ এডমিট কার্ড পায়নি। আমি সাইন্টিফিক অফিসার পদের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম। নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও দ্রুত হলে খুব ভালো হয় আমাদের জন্য।
ভুক্তভোগী চাকরিপ্রার্থী মহিউদ্দিন মাহি বিবার্তাকে জানায়, আমরা পাশ করেছি প্রায় চার বছর হলো। চার বছরে সমুদ্রবিজ্ঞানে মাত্র একটা সার্কুলার ছিল। আমি নিজে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি। কিন্তু আমার কাছ থেকে টাকা চেয়েছে বিভিন্ন সময়। এরা টাকা চায়, আবার বলে কোনো এভিডেন্স রাখা যাবে না। নিশ্চয়তা ছাড়া কাউকে কেন টাকা দেবে একজন মানুষ? টাকা না দেওয়ায় আমাকে ভাইভা বোর্ডে প্রায় ২০ মিনিটের মতো অপমান এবং লাঞ্ছিত করেছে। আমার রোল নম্বর ২১৫। আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমি এর বিচার চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ, যিনি নিজেই একজন সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার। প্রতিষ্ঠানের এই নিয়োগ বাণিজ্যে আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। একটি অডিও ক্লিপে আবু সাঈদ শরীফের সাথে এক চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরি পেতে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত আলোচনা করতে শোনা যায়। যদিও সেই অডিও ক্লিপে কথা বলা ব্যক্তিটি আবু সাঈদ শরীফ কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ বিবার্তাকে বলেন, আপনার সাথে এখন আমি যে কথা বললাম সেটা আপনি রেকর্ড করে বলবেন আমি এরকম কথা বলেছি, সেটা হয়? কোনো স্টুডেন্ট এর থেকে টাকা নিবো এটা কি হয়? আমি একজন প্রফেসরের ছেলে। আমার জীবনে আমি কোনোদিন এক পয়সা হারাম রোজগার করি নাই। যারা বলে এসব, তারা নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই বলে।
নিয়োগ বাণিজ্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, নিয়োগ বোর্ডে আমি ছিলাম। নিয়োগে আমার সম্পৃক্ততা ছিল কিন্তু আমার দ্বারা কারো হক নষ্ট হয়নি, কোনো দুই নম্বরি হয়নি। এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। নিয়োগে স্বচ্ছতা ছিল একশত ভাগ, কারো হক নষ্ট করা হয় এমন কোনো কিছু করা হয়নি। প্রিভিলাইজ দেওয়া হয়নি। কারো প্রতি দয়াও দেখানো হয়নি।
নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বিবার্তাকে বলেন, যদি সৎভাবে কোনোকিছু করা হয় তখনই সমস্যা হয় বেশি। নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে, এখনো পর্যন্ত রেজাল্ট হয়নি, কিছুই হয়নি, অথচ এর মধ্যে টিকটিকি শ্রেণির লোক আছে- তাদের কী হয়েছে আমার জানা নেই, তারা বিভিন্নভাবে অভিযোগ দিচ্ছে। যারা অভিযোগ দিচ্ছে তারা কি সিলেক্ট হয়েছে তারাও জানে না, আমিও জানি না। রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পরই না আপনি বুঝতে পারবেন। রেজাল্ট হওয়ার আগে তারা কীভাবে জানবে কারা নিয়োগ পেয়েছে কারা পায়নি বা কী কী সব চলছে। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, কোনো প্রমাণ নাই কিছু নাই, শুধু কথাতেই এসব বলে যাচ্ছে! আপনারা যদি চান আমার প্রিভিয়াস রেকর্ড দেখতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটাও অনিয়মের অভিযোগ কেউ দেখাতে পারবে না। আমার হাতে একটা প্রতিষ্ঠান, একটা ডিপার্টমেন্ট, টানা সাত বছর। মেটেরোলজির চেয়ারম্যান ছিলাম, সেখানে প্রচুর শিক্ষক, স্টাফ নিয়োগ হয়েছে, আমি ডিন ছিলাম। একটা জায়গাতেও কেউ আমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের কথা বলতে পারবে না। এখন আমি ভালো কিছু কাজ করছি, আমার বিরুদ্ধে এসব কথা হচ্ছে।
চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম কে করেছে কোথায় করেছে দেখাতে বলেন। এই ধরনের চিন্তার মধ্যেও আমরা আসলে থাকি না।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (BORI) কক্সবাজারের রামু উপজেলার জঙ্গল গোয়ালিয়া পালং-এ অবস্থিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেটি সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদানে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, গবেষণালব্ধ ফলাফলের প্রয়োগ এবং এতদসংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিবার্তা/এসবি/রোমেল/সউদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]