শিরোনাম
আশ্রয়ণ প্রকল্প: স্বপ্নের ঠিকানা পেয়েও আশ্রয়হীন সুবিধাভোগীরা, শাল্লায় নজিরবিহীন দুর্নীতি (পর্ব-৭)
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২১, ১৫:১৭
আশ্রয়ণ প্রকল্প: স্বপ্নের ঠিকানা পেয়েও আশ্রয়হীন সুবিধাভোগীরা, শাল্লায় নজিরবিহীন দুর্নীতি (পর্ব-৭)
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সুনামগঞ্জের শাল্লায় ভূমিহীনদের দেয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে।আর অনেক ঘরের মেঝে ভাঙা, টয়লেটও ভেঙে গেছে।শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণে নজিরবিহীন দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী দেয়া স্বপ্নের ঠিকানা পেয়েও ফের আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন শাল্লা উপজেলার সুবিধাভোগী মানুষগুলো।


জানা গেছে, মুজিবশতবর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে দেশের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ ঘর প্রধানমন্ত্রী শাল্লায় দিয়েছিলেন ভূমিহীনদের।কিন্তু সুষম বণ্টনের অভাবে বহু হত দরিদ্র পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার থেকে বঞ্চিত হন। পরে মাত্র ১ হাজার ৪৩৫টি ঘরে নির্মাণ কাজ শুরু হয়।এখনো বহু ঘরের কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে। এরমধ্যে তিনটি গ্রামেই ২৫টি ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে।


আরো পড়ুন :প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প: কলাপাড়ায় আড়াই কোটি টাকা লোপাট (পর্ব-১)


এদিকে আবার ঘরের কাজ শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু ঘরে দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল।ব্যবহারের আগেই কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ ধসে পড়েছে। খসে পড়ছে দরজা জানালাও। এমন চিত্র উপজেলার ভেড়াডহর, সেননগর, আটগাঁও, মুজিবনগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে।


অন্যদিকে বেশকিছু ঘরের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সুবিধাভোগীরা। অনেকই আবার বাড়তি সিমেন্ট, কাঠও, ফ্লোর করতে ইটের সঙ্কটের কথাও বলেছেন।


বাহাড়া ইউপির ভেড়াডহর গ্রামের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সুবিধাভোগী বেনু বৈষ্ণব বলেন, ঘরের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সড়কে থাকছি এতদিন।এখন অন্যের বাড়িতে গেছি।আমরারে যে কষ্টের মাঝে ফালাইছে ভাষায় প্রকাশ করার মত না।



নগেন্দ্র বৈষ্ণব বলেন, আমি গরিব মানুষ। টুকরি দোকানদারি কইরা খাই।এই কয়টা মাস আমার ৩টা ছোট বাচ্চা লইয়া সীমাহীন কষ্ট করছি।২৬ জুন আমার ঘরে টিন লাগাইতাছে।আমার মূল ঘরের সামনের অংশ ফাইট্টা গেছে।এখন জোড়াতালি দিতাছে।আমি মানতাম না।এই ঘর যদি ভাইঙ্গা পড়ে? আমার ঘর আবার নতুন কইরা বানাইয়া দেউক।


আরো পড়ুন :প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প: নির্মাণ শেষ হতে না হতেই ভেঙ্গে গেল ঘর (পর্ব- ২)


নির্মল বৈষ্ণবের স্ত্রী বলেন, ৪টা মাস পরের ঘরে থাকতাছি।আমার স্বামী অসুস্থ।আরো সিমেন্ট লাগে।কই পাইমু টাকা? ভাত খাইতেই কষ্ট অইতাছে।


ওই গ্রামের অলি বৈষ্ণব বলেন, ‘আমার ঘরেও ফাটল দেখা দিছে। শুধু আমার ঘরে নয় পূর্বহাটি ও টুকের হাটিতেই এমন ১০টা ঘরে ফাটল দিছে।এগুলো কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে প্লাস্টার করতাছে।ব্যবহারের আগেই এই অবস্থা! আর ব্যবহার করলে একটা ঘরও ঠিকত না।’


তিনি আরো বলেন, ‘মৃত যোগেশ বৈষ্ণবের স্ত্রী সীতা রাণী বৈষ্ণবের ঘরটা চার আঙ্গুল ফাটল।এই মহিলার ঘরটা যদি ধসে পড়ে-তাহলে জীবনে আর ঘর বানাইত পারত না। দুইটা সন্তান নিয়া অসহায় অবস্থায় আছে ওই বিধবা মহিলা।আবার প্রায় ঘরের দরজা জানালা খসে খসে পড়তাছে।’


আরো পড়ুন :আশ্রয়ণ প্রকল্প: মেহেন্দিগঞ্জেও ভেঙে পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের সেই ঘরগুলো (পর্ব-৩)


শাল্লা সদরের অদূরে শান্তিপুর গ্রামের মানিক মিয়া বলেন, ‘শান্তিপুর গ্রামের খায়রুল মিয়া ও রুবেল মিয়ার ঘরে বড় ফাটল দেখা দিছে।’


অন্যদিকে সেননগরের কেনু মিয়া বলেন, ‘দরজা জানালা ছুইট্টা গেছে। দরজাটা ঠিক করছি। জানালাটা পারছি না।’


জাহির আহমদ বলেন, ‘আমার জানালাও খুইল্যা পড়ছে। আমার বারান্দায় এখনো টিন লাগানোর বাকি আছে। কাঠ আমি কিন্না আনছি।’


মুজিবনগরের তোয়াহিদ মিয়া বলেন, ‘বৃষ্টি হলে ঘর ভিজে যায়। বৃষ্টি অইলে ঘরে পানি জমে।দোয়ারে দিয়া পানি ঢুকে।রান্নাঘরের চালের উপর দিয়াও পানি পড়ে।এসময় হাত দিয়ে তিনি দেখান হাটু পানি হয়ে যায় তার ঘরে।


এদিকে, মুজিবনগরের উত্তর পূর্বে অংশেরও অনেক ঘরে একাধিক ফাটল দেখা গেছে।এমনও দেখা গেছে কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে।অনেক ঘরের দরজা জানালাও খসে পড়তে দেখা যায়।আবার ফাটল জায়গায় জোড়াতালি দিয়ে প্লাস্টার করে রং করতেও দেখা গেছে।এসমস্ত ঘরে বসবাস না করায় কার কোন ঘর অনেকই বলতে পারেন না।প্রায় ঘরেই তালা ঝুলতে দেখা যায়।নির্মাণে নিম্ন মানের কাঠ ও দরজা জানালায় স্টিলের পরিবর্তে হালকা পাতলা প্লেন শিট ব্যবহার করা হয়েছে।অধিকাংশ ঘরের মেঝেতে সলিং দেয়া হয়নি। বাথরুমের কমোড পাইপ, রিং কোনো কিছুই বসানো হয়নি। অথচ প্রতিটি বাথরুম ও মূলঘরের ফ্লোর সলিংয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে।ঘর নির্মাণে সলিং বাথরুমের টাকা সংশ্লিষ্টদের পকেটে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।


আরো পড়ুন :আশ্রয়ণ প্রকল্প: মির্জাপুরেও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ভেঙে তছনছ! (পর্ব- ৪)


সূত্রমতে, সকল ঘর নির্মাণ ও ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এককভাবে পরিচালনা করছেন।নির্মাণের মালামাল পরিবহনের টাকা গৃহহীনদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে প্রত্যেক পরিবারকে চার হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী দেয়া উপহার স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে আশ্রয়হীন এসব মানুষেরা যে পরিমাণে আনন্দিত হওয়ার কথা তাদের মাঝে সেই আনন্দের ঝিলিক নাই বলেই চলে।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শাল্লা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সরদার মো. ফজলুল করিম বিবার্তাকে বলেন, উপজেলায় এক হাজার ৪৩৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।এর মধ্যে মাত্র ৪০টি ঘরে ছোটো ছোট কয়েকটি ফাটল দেখা গেছে।খবর পেয়ে সাথে সাথে সেগুলো মেরামত করা হয়েছে।এছাড়াও কিছু ঘরের নির্মাণকাজ এখনো চলছে।অল্প সময়ের মধ্যে সেই অসমাপ্ত কাজগুলোও সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।


তিনি আরো বলেন, আল্লাহর রহমতে অন্য উপজেলা থেকে শাল্লা উপজেলার ঘরগুলো ফাটলের সংখ্যা অনেক কম। তবে যেখানেই ফাটলের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই মেরামত করে দেয়া হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।


আরো পড়ুন :প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প: লক্ষ্মীপুরেও ভেঙে পড়ছে ঘর, কয়েকটিতে ফাটল (পর্ব-৫)


এ ব্যাপারে জানতে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল-মুক্তাদির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে ঘরগুলো ভেঙে পড়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। তিনি বিবার্তাকে বলেন, এসব ঘরগুলোর অবস্থা আমিও দেখেছি, এগুলো মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ করছি। তাড়াতাড়িই এসব ঘর মেরামত করে দেবো।


সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বিবার্তাকে বলেন, কয়েকটি ঘরে ফাটলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া দরিদ্র মানুষজনের উপহারে একটি টাকার অনিয়মও সহ্য করা হবে না। ইতোমধ্যে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।


আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ভেঙে যাওয়া ঘরগুলো ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নির্মিত এবং নির্মাণাধীন বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলী ও গুণগতমান অনুমোদিত ডিজাইন ও প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়েছে কি না তা যাচাই করতে মাঠ পরিদর্শন করা হচ্ছে। যেসব এলাকায় দুর্নীতি ও অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।


আশ্রয়ণ প্রকল্প : ৬ মাস না যেতেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ফাটল (পর্ব-৬)


বিবার্তা/খলিল/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com