শিরোনাম
শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি
প্রকাশ : ১৩ মে ২০১৯, ১৫:২৪
শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা  চিঠি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অনেক মন খারাপ করা খবরের মধ্যেও একটা খবর দেখে একটু ভালো লাগলো। সাথে ছোটবেলার একটি স্মৃতিও মনে পড়ে গেল। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কবিতা আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে একটি পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেটা ছিল একটি গোল আকৃতির সিরামিক বাটি। পুরস্কার নিয়ে সবাইকে দেখাবো বলে তাড়াহুড়ো করে অতি আনন্দে অনেকটা নাচের ভঙ্গিতে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাস্তায় কিসে যেন হোঁচট খেয়ে বাটিটা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল! মনটা অনেক খারাপ হয়ে যায়, বেশ কান্নাও পেয়েছিল।


যাই হোক, পরের দিন সকালে স্কুলে গিয়ে সরাসরি স্যারের রুমে চলে গিয়েছিলাম। হেড স্যারকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অভিযোগের সুরে বলেছিলাম স্যার আমাকে যদি কবিতা আবৃত্তির পুরস্কার হিসেবে বাটিটা না দিয়ে একটা কবিতার বই দিতেন তাহলেই ভালো হতো, ভাঙতো না!!


সেখানে আপনাদের শুভেচ্ছাসহ স্বাক্ষর থাকতো, আমার নাম লেখা থাকতো সেটা মনে হয় বেশি আকর্ষণীয় হতো। সাহস করে স্যারকে বলেছিলাম, স্যার এর পর থেকে পুরস্কার বই দিবেন তাহলে আর ভাঙবে না!


স্যার আমার কান্না দেখে বলেছিল নাও আর একটা বাটি তুমি নিয়ে যাও। কিন্তু আমি বলেছিলাম স্যার বাটি তো আমার বাড়িতে আছে। আসলেও তো তাই। থালা, বাটি, জগ মগ, গ্লাস তো সবার বাড়িতেই থাকে কিন্তু পুরস্কৃত ছাত্র-ছাত্রীদের নাম সম্মিলিত, অতিথিদের বা শিক্ষকদের শুভেচ্ছা স্বাক্ষরসহ শিক্ষা সামগ্রী তো সবার বাড়িতে থাকে না। এটাই তো পুরস্কার! এটাই তো আকর্ষণ! এটাই তো মজা!


সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার হিসেবে থালা, বাটি, মগ, জগ, গ্লাসসহ কোনো ধরণের ক্রোকারিজ সামগ্রী না দিতে নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এসবের পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে বই দিতে বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। আশা করি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সানন্দে নির্দেশনাটি গ্রহণ করবে। (একজন অ্যালামনাস হিসাবে আমার স্কুলে যখন কোনো কিছু দেই তখন সেটা অবশ্যই শিক্ষা সামগ্রীই হয়।)


যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। দেশব্যাপী ২৩ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ পালিত হয়েছে। তাই খাদ্য ও পুষ্টির একজন শিক্ষক হিসাবে আগ্রহটা যেমন বেশি তেমনি উদ্বেগটাও বেশি! পুষ্টি শিক্ষার বিষয়ে আমার মনে হয় যোগ-বিয়োগটা একটু ভালো করে মেলানো দরকার।


একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ, সুস্থ জাতি গঠনের জন্য অবশ্যই আমাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আসলে শিশুদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা দরকার। সেটার প্রথম ধাপ হতে পারে প্রাথমিক স্তরের বইগুলোতে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে, বিভিন্ন ছড়ার মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে। পুষ্টি শিক্ষা সংযোজন করা যাতে করে শিশুরা প্রথম থেকেই অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি জ্ঞানের সাথে পরিচিত হয় এবং তা অনুসরণ করে।


যখন পাঠ্যপুস্তকে এই পুষ্টি বিষয়ক অধ্যায়গুলো ছেলেমেয়েরা পড়বে তখন এই বিষয়গুলো শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না পরিবারেও এগুলো আলোচনা হবে। এতে করে সবাই বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হবে। যা আস্তে আস্তে সঠিক খাদ্য নির্বাচন, সঠিক খাদ্যাভাস তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করবে।


কিছুদিন আগে আমার একজন সহকর্মী আমাকে বলছিলো আপনাদের স্কুল নিউট্রিশন ক্যাম্পেইন প্রোগ্রামটা (নিউট্রিশন ইনিশিয়েটিভের স্কুল নিউট্রিশন এডুকেশন কার্যক্রম) দেখে আমার ছেলে এখন খাবার দাবারের ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়েছে। আসলে সরাসরি শিশুদেরকে জানাতে পারলে তা বেশ ফলপ্রসূ হয়।


এই যে তথাকথিত ছড়া বা রাইমস যেমন আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে ঢাকঢোল ঝাঁজর বাজে, হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম, ইত্যাদি। এসব পড়ে আমাদের শিশুরা আসলে কী শিখছে? ছোটবেলা থেকেই যদি তারা এরকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অর্থহীন বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়, এগুলো আত্মস্থ করে তাহলে কিভাবে একটি হেলদি, স্মার্ট জেনারেশন তৈরি হবে?


ইংরেজি বর্ণমালা গুলো কি এরকম কি হতে পারে না যেমন এ ফর অ্যাপল। অ্যাপল ইজ এ নিউট্রিশাস ফ্রুট, বি ফর ব্যানানা এন্ড ব্রকলি। ব্যানানা এন্ড ব্রকলি গিভস আস ভিটামিনস, সি ফর কোকোনাট। কোকোনাট ওয়াটার ইজ দ্য বেস্ট ড্রিঙ্ক, ডি ফর ডেট, ডেট ইজ এ ন্যাচারাল সুইট ইত্যাদি।


এভাবে যদি খাবারের নাম দিয়ে বর্ণমালাগুলো সাজানো যায় তাহলে দেখা যাবে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে জানবে এবং এগুলো খেতে উৎসাহিত হবে যা পরবর্তীতে তাদের সঠিক খাদ্য নির্বাচনে এবং এই অভ্যাস ধরে রাখতে সহায়তা করবে।


একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সুস্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে ইদানিংকালে আমাদের লাইফস্পান অর্থাৎ গড় আয়ু (৭২, যা কিনা পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ভারত পাকিস্তান থেকে বেশি) বাড়লেও পক্ষান্তরে হেলথস্পান অর্থাৎ সুস্থ থাকার সময়কাল কিন্তু কমে যাচ্ছে। যার অন্যতম কারণ লাইফস্টাইল এবং খারাপ খাদ্যাভাস। সেজন্য দেহ গাড়ি সচল, সক্রিয় রাখতে হলে ভিত্তি শক্তিশালী, সবল করার কোনো বিকল্প নেই।


অন্যদিকে, শিশুদের ভিত্তি মজবুত ও অর্থপূর্ণ করতে ছড়া বা রাইমস গুলো অর্থপূর্ণ, উপদেশমূলক ‘ভালো অভ্যাস, সঠিক খাদ্যাভাস’, ইত্যাদি বিষয় দিয়ে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি অনুরোধ থাকবে যেন উনি আমাদের কোমলমতি শিশুদের জন্য প্রি-প্রাইমারি ও প্রাইমারি স্তরের বইগুলো নতুনভাবে পরিমার্জন করেন। অ তে অজগর যেন প্রথমেই আমাদের সন্তানদের দিকে তেড়ে না আসে! অ তে অলসতা ভালো নয়/অসৎ সঙ্গ ভালো নয়- এমন গঠনমূলক বর্ণমালা ভিত্তি নিয়েই যেন আমাদের সন্তানেরা গড়ে ওঠে।


পুষ্টি সপ্তাহের সফলতা মাসব্যাপী, বছরব্যাপী চলমান রাখতে হলে এগুলো বাদেও আমাদের জরুরিভাবে অন্য একটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অতিরঞ্জিত খাদ্যের বিজ্ঞাপন পুষ্টিসমৃদ্ধ সুস্থ জাতি গঠনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।


আমরা ছেলেমেয়েদেরকে খাদ্যের ব্যাপারে যেমনভাবে বলছি, যেমনভাবে ভালো খাবারের দিক উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি টিভি বিজ্ঞাপন কিন্তু সেভাবে বলছে না। এতে করে শিশুরা দ্বিধান্বিত হয়ে যাচ্ছে। তারা মা-বাবার কথা শুনবে নাকি টিভিতে যেটা বলছে সেটা শুনবে। কারণ এই আলফা (আলফাবেট জেড ইজ ওভার সো গ্রিক আলফাবেট আলফা হ্যাজ স্টার্টেড)/আই (ইন্সট্রাগ্রাম, আইপ্যাড) জেনারেশনের (২০১০- ২০২৫) শিশুরা মিডিয়া দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।


অনেক সময় তারা ভাবে, টিভি নিশ্চয়ই ঠিক বলছে ! মা-বাবা মনে হয় খাওয়ানোর জন্য বাড়িয়ে বলছে, ভুল বলছে। তারা আসলেই দ্বিধান্বিত হয়ে যায়! তাই মিলেনিয়াল শিশুদের সঠিকভাবে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে।


উপরোক্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো আরো কঠোর, শক্তিশালী করতে হবে। যেমন ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট অ্যাক্ট আরো কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে।


অন্যদিকে, শিশু খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি যেন বেশি ইন্সেন্টিভ দিয়ে মিডিয়াগুলোকে কিনে না নেয় এদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নাটক, সিনেমা যেমন সেন্সর বোর্ড পাস হয় তারপর প্রচার বা প্রদর্শিত হয় তেমনি বিজ্ঞাপনগুলোও সেন্সর বোর্ড পাস হবে তারপর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় যাবে এমন নিয়ম করা প্রয়োজন।


মোদ্দা কথা হচ্ছে, এইসব আইন কানুন কার্যকরী হবে না যদি আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজেরা দায়িত্বশীল না হই, সচেতন না হই, সৎ না হই!


সম্প্রতি দ্যা ইকোনমিস্টের একটা রিপোর্ট দেখে খারাপ লাগলো। কিছু ফুড ইন্ডাস্ট্রিকতিপয় গবেষকদের মোটা অংকের ইন্সেন্টিভ দিয়ে রিসার্চ ফলাফল তাদের খাদ্য পণ্যের পক্ষে নিয়ে যায়। যেটা কিনা সাংঘর্ষিক। এগুলো কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাদ্য গবেষক, খাদ্য শিল্প মালিক, খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনকারী, সবার যদি নীতি-নৈতিকতায় দুর্যোগ নেমে আসে, ধ্স নেমে যায় তাহলে আসলে আমাদের সন্তানদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।


পাশাপাশি মিডিয়ারও সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে অতিরঞ্জিত, ভুলভাল তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচার করা উচিত হবে না। এটা আসলে একটা সামাজিক আন্দোলনের মতো বিষয়। চেইন অব পজেটিভ অ্যাকশন যদি না থাকে তাহলে একটা পুষ্টিসমৃদ্ধ, শিক্ষিত জাতি গঠন কঠিন
হবে।


মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্ত আগাছা, আবর্জনা দূরীভূত হবে। উন্মোচিত হবে এক নতুন সম্ভাবনাময় দিগন্তের।


শাম্মী আক্তার,
সহকারী অধ্যাপক ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট
ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ইমেইল: [email protected]


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com