জাকির তালুকদারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরতের চিঠি ও বিবিধ প্রসঙ্গ
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:২৩
জাকির তালুকদারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরতের চিঠি ও বিবিধ প্রসঙ্গ
হাবিবুর রহমান রোমেল
প্রিন্ট অ-অ+

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত পাঠিয়েছেন। ২০১৪ সালে কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ওই পুরস্কারের অর্থ ও সম্মাননা স্মারক কুরিয়ার মারফত বাংলা একাডেমি বরাবর পোস্ট করে এ বিষয়ে তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।


পুরস্কার বাংলা একাডেমি বরাবর ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে জাকির তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমি তার মান ধরে রাখতে পারেনি। একাডেমির গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, ২৫ বছর ধরে কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য বাংলা একাডেমি সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কমে গেলে পুরস্কারের গুরুত্ব থাকে না। এ জন্য এই পুরস্কার এখন আমার কাছে অর্থহীন বোঝা বলে মনে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি নিজের মান ধরে রাখতে পারেনি, এটা দুঃখজনক।’


ধরা যাক, বাংলা একাডেমি সম্পর্কে জাকির তালুকদারের সব কথা সত্যি। ২০১৪ সালেও বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণার পর এদেশের লেখককুলে আলোচনা, সমালোচনার যে হয়নি- বিষয়টি তেমন না। তারপর তিনি নিজেই বলেছেন গত ২৫ বছর ধরেই একধরণের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে বাংলা একাডেমিতে। এতসব জেনেও তাহলে কেন তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়েছিলেন?


বাংলা একাডেমি ২০১৪ সালে পুরস্কারের অর্থ হিসেবে ১,০০,০০০/- টাকা প্রদান করতো। বর্তমানে তা ৩,০০,০০০/- টাকা। কারণ এই দশ বছরে আলু-পটলের দাম বেড়েছে ঢের! কথাগুলো এইজন্য বলা, কেবলমাত্র একটা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বাংলা একাডেমির মতো পুরস্কারকে শুধুমাত্র অর্থ দিয়ে পরিমাপ করেছেন জাকির তালুকদার- তা তার ফেসবুক পোস্টের ছবি দেখে সহজেই অনুমেয়।


২০১৪ সালে আপনি জাতির পিতার কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছেন। গত দশ বছর সেই পুরস্কারের সম্মান এবং প্রাপ্ত অর্থের আর্থিক সুবিধা ভোগ করেছেন। ২৮ জানুয়ারি, রবিবার দশ বছর পর পুরস্কার ফেরত পাঠিয়ে জাকির তালুকদার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একচ্ছত্র আলোচনার জায়গায় ছিলেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও এমন বিজ্ঞাপণ পাওয়া সম্ভব! যদিও জাকির তালুকদারের মধ্যে একধরনের প্রবণতা আছে- আলোচনায় থাকা। তিনি পুরস্কার প্রাপ্তির পর যতটা না আলোচনায় ছিলেন তারও অধিক আলোচনায় থাকলেন পুরস্কার ফেরত পাঠানোর চিঠি লিখেই। এবং মজাটা হলো চিঠিটা পাঠিয়েই তিনি তা ফেসবুকে পোস্ট করেন।


বাংলা একাডেমি বরাবর লিখিত চিঠির সংযুক্তি অংশে জাকির তালুকদার লিখেছেন- ‘গত কয়েক বছর ধরে পুরস্কারের একটি প্যাটার্ন লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন কয়জন আমলা পাবেন পুরস্কার, বাংলা একাডেমির অন্তত একজন কর্মকর্তা পাবেন পুরস্কার, আর মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ পাবেন পুরস্কার। নিশ্চয়ই যে কোনো পেশার লেখক পুরস্কার পেতে পারেন। কিন্তু যখন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের চাইতে অধিকতর যোগ্য লেখককে বাদ দিয়ে পুরস্কারটা তাকে দেওয়া হয়, তখন তার সমালোচনা হবেই। অথচ একাডেমি কোনো সমালোচনায় কান দেয় না। আত্মসমালোচনা করে না। সেইসাথে দেখা যাচ্ছে কোনো কবি বা লেখকের কাজের ক্ষেত্র বাদ দিয়ে তাকে অন্য ক্যাটেগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এগুলো সবই ভব্যতার ব্যত্যয়।’


জাকির তালুকদারের উপরের কথাগুলোও সত্য বলে গণ্য করে যদি জানতে চাওয়া হয়- সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কীভাবে পুরস্কারযোগ্য সেরা লেখক বা তার বইটিকে মনোনীত করেন? ওইসব বিচারকদের বিচার পদ্ধতি কতোটা পক্ষপাতহীন ও নির্ভরযোগ্য? এসব বিচারক-নির্বাচক পুরস্কারদাতার স্বার্থ ও পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে কতোটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য মতামত দিতে পারেন? আপনার সময়েও কি কথাসাহিত্য শাখায় ‘মুসলমানমঙ্গল’ এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাহিত্যকর্ম ছিল কিনা?


১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তদের নামের তালিকায় বদরুদ্দীন উমর এর নাম প্রকাশিত হলে তিনি তা সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইতিহাস পরিষদ এর পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন। সম্ভবত ১৯৯৪ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের জন্য ফিলিপস পুরস্কারে তাঁর নাম ঘোষণা করেছিল। বহুজাতিক কোম্পানি ভাইয়ের রক্ত পানি করা পয়সায় পুরস্কার দিবে বিধায় তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু জাকির তালুকদার ১০ বছর ভোগ-দখল করে আরো বেশি স্পেসের জন্য, অধিকতর আলোচনায় থাকার জন্য তা ফেরত দেওয়ার জন্য মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন!


জাকির তালুকদারের পুরস্কার ফেরত দেওয়া প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার কাছে এখনো (পুরস্কারের অর্থ ও সম্মাননা স্মারক) এসে পৌঁছায়নি। এত দিন পর পুরস্কার ফেরত দেওয়া যায় কি না, আমি ঠিক জানি না।’


তাহলে এখানে নতুন এক প্রশ্ন দাঁড়ালো- পুরস্কার ফেরতের আবেদন গ্রহণের আগেই কেন তিনি তা রাষ্ট্র করলেন?


কথা হচ্ছে, বাংলা একাডেমির পুরস্কার ফেরত নেওয়া বিষয়ে কোনো নীতিমালা আছে কিনা? পুরস্কার ফেরতের বিষয়ে একাডেমির যদি কোনো নীতিমালা না থাকে এবং সেজন্য যদি পুরস্কার ফেরত নেওয়া না যায় তাহলে করণীয় কী? সেক্ষেত্রে পুরস্কারের স্মারক ও অর্থের কী গতি হবে?


একজন লেখক জাকির তালুকদার যদি মনে করেন এভাবে ১০ বছর পর পুরস্কার ফেরত দিয়ে বাংলা একাডেমির অন্যায়, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তিনি সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন- তাহলে প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষার্থে হলেও বাংলা একাডেমির উচিত এতদসংক্রান্ত শঙ্কট মোকাবেলায় নতুন নীতিমালা তৈরি করা এবং লেখকের পুরস্কার ফেরতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।


লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]


বিবার্তা/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com