আমার পোষাক আমার গর্ব
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৭
আমার পোষাক আমার গর্ব
প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

যেটা ধরি, সেটাই ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ! বাহ! চমৎকার অনুভূতি না! গার্মেন্টস জগতে আমরা এখন বিশ্বে বেশ ভালো পজিশনে আছি। এটা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু পশ্চিমারা আমাদেরকে যে হারে ঠকাচ্ছে তার কোনো প্রতিকার কি আমরা করতে পেরেছি? বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২ ইউএস ডলারে পোশাক তৈরি করে নিয়ে নিজেরা কমপক্ষে ২০ ডলারে বিক্রি করে। আজব হলো, আমরাই আবার সেসব জিনিস দেশে কম দামে না কিনে বিদেশে এসে এমএন্ডএস, এইচএন্ডএম, হ্যালো কিট্টি, নেক্সট, প্রাইমার্ক, ম্যাক্স, ইউনিক্লো এর মত বড় বড় শো রুম থেকে চড়া দামে কিনি।


ব্যাপারটা খুলে বলছি। অনেক দিন ধরে নিজের জন্য কাপড় চোপড় কেনা হয় না। মাঝে মধ্যে এক-আধটা গিফট- টিফট পাই, তাই দিয়ে চলে যায়। কিন্তু এবার আমেরিকায় প্রচণ্ড শীত পড়াতে কিছু গরম কাপড় কিনার তাগিদ ছিল। ছেলের উসিলায় ঢাকার অভিজাত ও নিম্ন জাতের (!) বাজার ঘুরে আমার একটা দারুণ আইডিয়া হলো।


স্নোটেক্স গ্রুপের কথা দিয়েই শুরু করি। এটি আমাদের দেশীয় একটি কোম্পানি। নানান ধরনের পোষাক বানায়। সবই এক্সপোর্ট কোয়ালিটির। এর মধ্যে ওয়ার্ক অয়্যার, সেইফটি অয়্যার, ফ্যাশন অয়্যার, বটম অয়্যার বিখ্যাত। ঘটনাচক্রে স্নোটেক্সের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার বন্ধু। তাই ছেলে ছুটিতে এলে ওর শো রুম থেকে ২/৩ টি ভালো মানের জ্যাকেট পছন্দ করে আমেরিকায় নিয়ে যায়। এগুলো গিফট আইটেম। তাই দাম জানতে পারি না। তবে কোয়ালিটি এক্সিলেন্ট!


এর এক একটি জ্যাকেট ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত শপিং মলে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। একই জিনিস আমাদের গরিবের মার্কেট নুরজাহান শপিং সেন্টারের দোতলায় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দাম হাঁকায়। দর কষাকষির এক পর্যায়ে হাঁকানো দামের চেয়ে কিছুটা কমেও বিক্রি হয়। সন্দেহ জাগতে পারে, কপি মাল কিংবা প্রোডাক্টে ডিস্পিউট আছে কিনা? কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়।


সেই একই প্রোডাক্ট সিঙ্গাপুরে এসে দেখি ১৩০ সিংডলার অর্থাৎ ১১ হাজার সাত শত টাকা। আরেকটু সুবিধায় কিনতে মালেশিয়ায় গিয়ে দেখি ঐ জ্যাকেটের মূল্য ধরা হয়েছে ৩০০ রিঙ্গিত অর্থাৎ সাত হাজার পাঁচ শত টাকা। যন্ত্রণার শেষ নেই। ঐ একই জ্যাকেট ছেলে যখন আমেরিকায় পরিধান করে ক্লাস করে তখন তার আমেরিকান ক্লাসমেটদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়! ওমা! কলম্বিয়া, ভিআরএল, নর্থ ফেইস, নাইক! এতসব চমৎকার জ্যাকেটের কালেকশন দেখে তারা যেমনি অবাক হয় তেমনি দারুণ আকৃষ্টও হয়। ওখানে কেউ কেউ শোরুমে ১৫০ ইউএস ডলারে (১৮ হাজার টাকা) কিনেছে এমন নজিরও আছে। জানতে পারলাম আমার ছেলের কাছে। সব মিলিয়ে মাথা নষ্ট।


তবে নিজে কিনতে পারি কিংবা না পারি তাতে আফসোস নেই। গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে, ইউরোপ, আমেরিকার মত সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বড় বড় শপিং মলে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্টস। বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে এসব দেশে।


আমার ছেলে এখান থেকে যে কটি জ্যাকেট, প্যান্ট, ট্রাউজার, শার্ট, টি-শার্ট, পছন্দ করলো তার অধিকাংশই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। সত্যি আমাদের সঙ্গে কারো পেরে উঠার কথা নয়। এটি পরীক্ষিত। এত স্বল্প মূল্যে পৃথিবীতে আর কে পারবে এমন চমৎকার প্রোডাকশন দিতে? এটা ওদের ভাগ্য ও ব্যবসা দুটোর পথই প্রশস্ত করছে। অথচ ওরাই কিনা আবার নানান হামটি-ডামটি দিয়ে অনেকরকম কমপ্লায়েন্স জুড়ে দেয়। ধমক দেয়। বলে এটা ব্যবসা। কোনো চ্যারিটি নয়। টিকে থাকতে চাইলে এটা করুন, ওটা করুন!!


এমনকি আমাদের সহজ সরল পোশাক শ্রমিকদের যাপিত জীবন নিয়ে নানান স্টিগমা ছড়াচ্ছে পশ্চিমারা। বলে কিনা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে নারী পোশাক শ্রমিকেরা সন্তান ও নিজের জীবন বাঁচাতে যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এসব গল্প বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এত কিছুর পরেও আমাদের শ্রমিকেরা নীরবে নিভৃতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নামমাত্র শ্রমের মূল্যে এসব আকর্ষণীয় পোষাক বানিয়েই চলছে।


সে কারণেই তৈরি পোষাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের শেয়ার বেড়েছে। বিশ্বে আমাদের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যা ভিয়েতনামের থেকেও ১০ বিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থাৎ এই মুহূর্তে পোষাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।


শুধু খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশে শ্রমিকরা যেন শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের ন্যায্য অধিকারটুকুন পায়। ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়ে অযথা যেন কেউ হেনস্থার শিকার না হয়। যখন তখন শ্রমিক ছাঁটাই করা না হয়। ন্যায্য পাওনা দাবি করলে যেন তাদেরকে ভয় ভীতি ও হয়রানি করা না হয়। এ সব ক’টি বিষয়ে এদেশের মালিক পক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। শ্রমিকরা ভালো থাকলেই তা আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের জন্য মঙ্গলজনক হবে। হায়রে পশ্চিমা বেনিয়ার গোষ্ঠী। শুধুমাত্র মাইন্ডসেটের কারণে আমাদেরকে আর কত ছোট করবি? এত সস্তায় সব কিছু পেয়েও বাঙ্গালিকে আর কত তুচ্ছ -তাচ্ছিল্য করবি?


লেখক: ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/সউদ


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com