মানদণ্ডের গণতন্ত্র ও নির্বাচনি গণতন্ত্র
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:১৫
মানদণ্ডের গণতন্ত্র ও নির্বাচনি গণতন্ত্র
জুয়েল রাজ
প্রিন্ট অ-অ+

অবশেষে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন। কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। দেশ-বিদেশের সবারই দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে এবং এক ধরনের আতঙ্কও ছিল। বিশেষ করে বড় কোনো সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা নিয়ে এক ধরনের সংশয় ছিল। আদৌ কতটুকু শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনকে কীভাবে নিবে, গ্রহণযোগ্য হবে কি না। সাধারণ মানুষের মনেও সেই দোলাচল ছিল। কিন্তু সব ধরনের দোলাচলকে পেছনে ফেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে সম্পন্ন হয়েছে।


নির্বাচন কমিশনের এবং সরকার ও প্রশাসনের ভাষ্যমতে অবাধ নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশে। যদিও নানা মুনির নানা মতের বিষয় এখনো আলোচিত হচ্ছে এবং সেটি হতে থাকবে। বড় যে প্রশ্নটি রয়ে গেছে, তা হচ্ছে ভোটারের অংশগ্রহণ। নির্বাচন কমিশন জোর গলায় বলেছে, মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট পরেছে এবারের নির্বাচনে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন  বলেছেন কারো সন্দেহ থাকলে সেই ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করতে।যদিও বিদেশি পর্যবেক্ষক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবরটা একটু ভিন্ন ধরনের। তাদের মতে, ২৭-২৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।


কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, কমনওয়েলথ, ওআইসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও অভিনন্দন জানিয়েছে। তার মানে এই নির্বাচনকে তারা মেনে নিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যে ভয় ছিল সেটিও অনেকাংশেই কেটে গেছে। মার্কিন বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য আমাদের ভাগ করা ভিশনকে এগিয়ে নিতে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও সুশীল সমাজকে সমর্থন করার জন্য এবং আমাদের জনগণের সাথে জনগণের, অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করতে তারা বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার মানে এই নির্বাচিত সরকারের সাথে তারা কাজ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কার্যালয় থেকে ইস্যু করা বিবৃতির শিরোনাম ছিল 'পার্লামেন্টারি ইলেকশনস ইন বাংলাদেশ'। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে।


ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করেছে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন নিয়ে জয়ী হয়েছে। তবে, হাজারো বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর গ্রেফতার এবং নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। সেই সাথে, বাংলাদেশের এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে অন্য পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র একমত বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। এছাড়া নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা প্রকাশ করা হয়।


বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নির্বাচনের সময় এবং এর আগের মাসগুলোতে বাংলাদেশে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সাথে সব দলের প্রতি সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন।


তবে, সামনের দিনে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন, মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যহত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা জানানো হয়।


আবার যুক্তরাজ্য তাদের বিবৃতিতে মোটা দাগে যে কথাটি বলেছে  বা যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি। বড় একটি বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকাটাকে তারা গণতন্ত্রের মানদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করছে। তাঁদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের বিবৃতিতে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর। মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি। ভোটের আগে বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’


নির্বাচন সামনে রেখে এবং নির্বাচনের প্রচার চলাকালে সহিংসতা ও ভয়ভীতি দেখানোর কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাজনীতিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই।’


নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সে কারণে বাংলাদেশের মানুষের ভোট দেওয়ার যথেষ্ট বিকল্প ছিল না।’ যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।


বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি মতভিন্নতা দূর করে জনগণের স্বার্থে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অভিন্ন পথ বের করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই প্রক্রিয়ায় সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। তার মানে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই আসলে নির্বাচনকে খারিজ করে দেয়নি।


মূলত বিএনপি বা তাদের শরিকরা প্রথম বলতেন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কখনোই সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন না। যখন কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের দাবি ছিল এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিবে না। নতুন নির্বাচিত সরকার একদিনও টিকবে না। কিন্তু তার কিছুই আসলে হয়নি, বিগত সরকার সুন্দরভাবেই সব আয়োজন সম্পন্ন করে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছে এবং সেই সরকার আগামী ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। বিএনপি বরং রাজনীতির মাঠ থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পরীক্ষায় শেখ হাসিনা এবার উৎরে গেছেন। বাকি রয়েছে গণতন্ত্রের মানদণ্ড।


সেই পরীক্ষায় স্বতন্ত্র যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা যদি জোরালো  ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন, তাহলে সেই মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ও কমে যাবে। কারণ যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন , তারা সাধারণ ভোটারের রায়ের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।


বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে অদ্যাবদি কোনো নির্বাচনেই শতভাগ ভোটের ইতিহাস নেই। সেই নির্বাচনেই ভোট পড়েছিল মাত্র ৫৫ শতাংশ। এরপরে জিয়াউর রহমান এর নাটকীয়  হ্যাঁ-না ভোট ছাড়া কোনো নির্বাচনে সেই রেকর্ড ভাঙা সম্ভব হয়নি।


তাই ৪০ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতান্ত্রিক পরীক্ষায় পাশ মার্ক পেয়ে পাশ করে গেছে। একাডেমিক দিক থেকে, কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের প্রার্থীদের বিজয়ের পর কোনোভাবেই আসলে প্রশ্নবিদ্ধ করার আর সুযোগ থাকে না। শুধুমাত্র  একটা জায়গা থেকে যায় , সেটি হচ্ছে নৈতিকভাবে,  বিএনপির মতো বড় একটি দলের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ে আত্মতৃপ্তির জায়গাটায়  ঘাটতি থেকে যাবে । মানদণ্ডের নির্বাচনের চেয়ে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনটাই জরুরি ছিল। মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এককভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিএনপিসহ দেশের প্রতিটা রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজকেও সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ , বিএনপির উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে শতভাগ গণতন্ত্র আশা করার সুযোগ নেই।


তবে, ইংরেজ কবি, নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেছেন, ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে তার সুগন্ধ বিতরণ করবেই’। তাই এই নির্বাচনকে যে নামেই ডাকা হউক না কেন। নির্বাচন নির্বাচনই।


লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com