লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ বিএনপি, কী করবে এখন?
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫৮
লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ বিএনপি, কী করবে এখন?
মাইদুর রহমান রুবেল
প্রিন্ট অ-অ+

সরকার পতনের লক্ষে একদফা ঘোষণার পর প্রায় সাতমাস রাজপথে আন্দোলন করেছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। যদিও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক জোটগুলো। আন্দোলনের ফল ঘরে তুলতে না পেরে বেশ হতাশ তৃণমূলের কর্মীরা।


বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। গঠন করেছে নতুন মন্ত্রী পরিষদও। এমন পরিস্থিতিতে কী করবে বিএনপি? তাহলে কি আবারও পাঁচ বছর আন্দোলন চালিয়ে যাবে দলটি? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে।


তবে, এই নির্বাচনকে একতরফা ও ডামি নির্বাচন হিসেবে দেখছে বিএনপি। আর এই ‘একতরফা’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ‘ভোট বর্জনকে’ আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হিসেবেই দেখছে দলটি। আন্দোলনরত বিরোধী নেতাদের দাবি, বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যায়নি। নির্বাচনে ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাই দেশবাসীকে এবার নতুন সরকারকে বর্জনের আহ্বান জানাবে দলটি।


‘একতরফা’ নির্বাচনের প্রতিবাদে আপাতত হরতাল-অবরোধের মতো হার্ডলাইনের কর্মসূচিতে না যাওয়ার ইঙ্গিত বিএনপির। তবে এর মধ্যে সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, গণসংযোগের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। একইসঙ্গে মামলা ও কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে।


৭৪ দিন পর গত বৃহস্পতিবার খুলেছে নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। প্রায় ৫ মাস হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন দলের প্রধান খালেদা জিয়া।


দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে প্রত্যাশার কাছাকাছিও ভোটার না থাকা এবং বিএনপিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়ার নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে জাতিসংঘ, আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই বিষয়টিকেও জয়ের অংশ হিসেবে দেখছে বিএনপি।


বিএনপি নেতারা মনে করেন, সারাদিন কেন্দ্রগুলো খালি ছিল। সেখানে ‘৪১ দশমিক ৮ শতাংশ’ ভোট দেশ-বিদেশে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। আবার নির্বাচনের শেষ এক ঘণ্টায় ১৪ শতাংশ ভোটগ্রহণ হয়েছে। এক ঘণ্টায় এত ভোট পড়ায় কী ধরনের কারচুপি হয়েছে তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে মনে করে দলটি। ফলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেও মনে করেন তারা।


বিএনপি নেতারা আরো মনে করছেন, নির্বাচনে কারচুপির কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নানামুখী চাপ প্রয়োগ করতে পারে। পশ্চিমারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেই পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে দলটি।


এদিকে, আন্দোলন এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতারা সমমনা রাজনৈতিক জোটগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক শরিক নেতা জানান, সভায় চলমান একদফা আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া আগামীতে রাজপথে থাকা সব দলকে একমঞ্চে ওঠার প্রস্তাব দেয় শরিক দলগুলো।


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ৭ জানুয়ারি রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ভোটের দিনের পরিস্থিতি, দলের পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভোট বর্জনের আহ্বানে দেশবাসী অভূতপূর্ব সাড়া দেওয়ায় খুশি দলটির হাইকমান্ড।


বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব এবং ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বিবার্তাকে বলেন, বিএনপির সাথে আমাদের শুধু নয় সমমনা অনেক রাজনৈতিক দলের সাথেই দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো তো সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, দেখি তারা কি করে। একটু অপেক্ষা করি, তাদের অবস্থানটাও দেখি।


তিনি আরো বলেন, নির্বাচন যেটি করলো আওয়ামী লীগ এটি তো কোন নির্বাচন নয়। তারা ক্ষমতা গ্রহন করুক, শপথ নিক তাতে কি- আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আর আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের পুরনো মিত্রদের সাথেও সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছে। নিজেদের মধ্যে এখন মারামারি চলছে। নির্বাচন নিয়ে তারাই প্রশ্ন তুলছে। কি অনিয়ম হয়েছে তা আর আমাদের বলতে হচ্ছে না, তারাই প্রকাশ করে দিচ্ছে।


বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মাদ রহমত উল্লাহ বলেন, বিএনপির আন্দোলন সফল। বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট কেন্দ্রে যায়নি দেশের মানুষ। সরকার বা নির্বাচন কমিশন যাই বলুক ভোটার তো কেন্দ্রে যায়নি। তবে এটা ঠিক আন্দোলন সফল হলেও তার ফল হয়তো ঘরে তুলতে পারিনি আমরা।


তার দাবি বিএনপির তৃণমূল যে আন্দোলন করেছে বিগত দিনগুলোতে তা যাতে ম্লান না হয়ে যায়- সেই ব্যবস্থা নিশ্চই নেবে কেন্দ্র। কর্মীরা যাতে হতাশ না হয় সেই ব্যবস্থা হয়তো নেবে দল।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘এই ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে বর্জনের জন্য আমরা জনগণকে আহ্বান জানাব। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। অনেক সিনিয়র নেতাদের নামে রয়েছে মামলা। অনেককে দেওয়া হয়েছে সাজা। এসব বিষয় মাথায় রেখে সামনে আমাদের কর্মসূচি দেব।’


বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বিবার্তাকে বলেন, বিএনপি আন্দোলনে আছে আন্দোলনে থাকবে। দেশে যে ধরনের সরকার আছে- সেখানে নিজেদের রক্ষা করতে হলে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে আন্দোলন কঠোর হবে বলে মনে করেন তিনি।


উপদেষ্টা আরো বলেন, স্বৈরচার সরকার নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখে ঠিকই কিন্তু তারপরও টিকতে পারে না।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বিবার্তাকে বলেন, আন্দোলন নিয়ে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বে নেই বিএনপি। আমরা আন্দোলনেই আছি। প্রতিদিন কোন না কোন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। শীঘ্রই নতুন কর্মসূচি বিএনপি দেবে বলেও জানান তিনি। তবে কি কর্মসূচি আসছে তা এখনই বলতে চান না সেলিমা রহমান।


আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে ৫ বছর অপেক্ষা করতে বলেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিমা রহমান বলেন, কার কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, কেউ বলতে পারে না। সময়ই বলে দেবে কার অপেক্ষা আর কার প্রতীক্ষা কত সময়ের।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বিবার্তাকে বলেন, এই আন্দোলন চলমান, বন্ধ করে দেবার কোন সুযোগ বিএনপির হাতে নেই। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, জনগণ বিএনপির উপর আস্থা স্থাপন করেছে। বিএনপি দেশের জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ফলে বিএনপির যেমন পিছু হঠার কোন সুযোগ নেই, তার বিপরীতে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশের জনগণও বিএনপির ওপর আস্থা রেখেছেন। এই পারস্পরিক বিশ্বস্ততার ফলশ্রুতিতে বিএনপির পক্ষে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ আমাদের সামনে খোলা নেই।


সেই বাস্তবতায় বিএনপি মনে করে, জনগণের সার্বিক ভোট বর্জনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় জনগণের ভোটের অধিকার তথা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনকে তারা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবেন বলেও মনে করেন বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামের এই নেতা।


বিবার্তা/রুবেল/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com