ঢাকা-১৯ আসনে নৌকার গতির সমানতালে উড়ছে মুরাদ জংয়ের ঈগল
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪৩
ঢাকা-১৯ আসনে নৌকার গতির সমানতালে উড়ছে মুরাদ জংয়ের ঈগল
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে ঢাকা-১৯ আসনে। দশ বছর পর স্বতন্ত্র হয়ে ভোটে ফিরেছেন সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ। গত দুবারের মতো এবারের নির্বাচন এতোটা সহজ হবে না ধরে নিয়ে নৌকা নিয়ে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন ডা. মো. এনামুর রহমান। এদিকে ভোটের মাঠে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছেন আরেক স্বতন্ত্রপ্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম।


মাঠের রাজনীতিতে আগে দেখা না গেলেও ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর ব্যাপক পরিচিতি পান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এক রানা প্লাজা ট্রাজেডি রাতারাতি যেন হিরো বানিয়ে দিয়েছিল ডা. এনামকে। তার মালিকানাধীন এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স-কর্মীরা রানা প্লাজায় হতাহতদের নিরলস সেবা দেন। তখনই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে পড়েন ডা. এনামুর। পরের গল্পে তার কেবলই এগিয়ে যাওয়া। পরপর দুবার অনেকটা বিনা বাধায় সাংসদ সদস্য হন তিনি। দ্বিতীয় দফায় হয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। তবে এবার নৌকা নিয়েও স্বস্তিতে নেই এনামুর রহমান।


দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন ডা. এনামুর। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার এমপি হয়ে পান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়নে নৌকার প্রার্থী। তবে এবার তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন সেই মুরাদ জং। নৌকার গতির সঙ্গে সমানতালে সাভার-আশুলিয়ার আকাশে-বাতাসে উড়ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ জংয়ের ঈগল।


স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ মুরাদ জংয়ের সঙ্গে থাকায় ঈগলের ডানায় শক্তি যেন বেড়েছে। ডা. এনামুরের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছেন আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। তিনিও ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকায়।


তেঁতুলঝোড়া, ভাকুর্তা, কাউন্দিয়া ও আমিনবাজার ইউনিয়ন বাদ দিয়ে সাভার থানার বাকি অংশ ও আশুলিয়া থানার পুরোটা নিয়ে ঢাকা-১৯ আসন। এ আসনে এবার মোট ভোটার ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৬। ভোটকেন্দ্র ২৯২টি। কাগজকলমে প্রার্থী আছেন ১০ জন।



গত ১০ বছর এমপি-প্রতিমন্ত্রী থাকলেও ডা. এনাম এলাকায় ও স্থানীয় রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরি করতে পারেননি, নেই কোন দৃশ্যমান উন্নয়ন। সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবই স্থানীয় রাজনীতির হর্তাকর্তা। রাজীবের বিরুদ্ধে কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তবে ডা. এনামুর রহমানের সঙ্গে তিনি রয়েছেন জোরেশোরে।


স্থানীয়রা জানান, রাজীবের কারণে সাভার-আশুলিয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কোণঠাসা। ফলেই সেই অংশটি এখন মুরাদ জংয়ের সঙ্গে। সাভার উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ফিরোজ কবির, আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন, সাভার সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা, আশুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন মাদবরসহ সাবেক আরো কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুরাদ জংয়ের প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রকাশ্যেই। রাজীবের বিরুদ্ধে নারি কেলেঙ্কারি, নেতাকর্মীদের নির্যাতন সহ বিভিন্ন অভিযোগ করছেন অনেকে। রাজীব বিরোধী আরও অনেকে আড়ালে-আবডালে মুরাদ জংয়ের গুণ গাইছেন। সব মিলিয়ে মাঠের প্রচারে মুরাদ জং কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।


অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম দুই দফায় আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়ে চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়ে এবার লড়ছেন এমপি পদে। তার সঙ্গে ইয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ ভূঁইয়া, পাথালিয়া ইউপির চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ানও আছেন। তারা একজন বাদে সবাই গত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগে তাদের পদপদবিও রয়েছে। আশুলিয়া থানায় ৪ লাখেরও বেশি ভোটার। সাইফুল ইসলাম তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন এমপি নির্বাচিত হলে এলাকার উন্নয়ন হবে।


ভোটের হিসাবনিকাশ


২০০৮ সালে এই আসনে এমপি হন তৌহিদ জং মুরাদ। ভোট পান ২ লাখ ৮২ হাজার ১০৯। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বাবু পান ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৩৬ ভোট। কাজেই আসনটিতে বিএনপির বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। ওই ভোটব্যাংকের ভোটাররা কেন্দ্রে গেলে নৌকার দিকে ভিড়বেন না। এইসব ভোটার টার্গেট করছেন মুরাদ জং। তাছাড়া মুরাদ জংয়ের বাবা আনোয়ার জং স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হন। ‘এলাকার মানুষ’ হিসেবে মুরাদ জংয়ের প্রতি নমনীয় মনোভাব রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। অপরদিকে ডা. এনামুর রহমানের আদি বাড়ি নরসিংদী। চাকরির সুবাদে সাভারে এসে থিতু হন তিনি। সরকারি চাকরি ছেড়ে স্থাপন করেন এনাম হাসপাতাল। সেই থেকে সাভারে তাঁর পথচলা।


২০১৪ সালের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে রেকর্ড ৪ লাখ ৯০ হাজার ৫২৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী দেওয়ান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন আহমেদ বাবু ভোট পান ৬৯ হাজার ৮৭৬। কাজেই বিএনপির একটি বড় ঘাঁটি এখানে রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানাভিত্তিক এলাকা হওয়ায় এখানে শ্রমিক ভোটার আছেন প্রায় ৪ লাখ। তারা কোন দিকে ঝুঁকবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এলাকায় ডা. এনামুরের বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা নেই। এলাকাবাসী তাঁকে সজ্জন হিসেবে জানেন। এটা তাঁর বড় ইতিবাচক দিক। তার পরও ভোটাররা বলছেন, মাঠের বর্তমান পরিবেশ বজায় থাকলে ও কেন্দ্রে গিয়ে সবাই ভোট দিতে পারলে ডা. এনামুর রহমানের হিসাবে গড়বড় হতে পারে।


যা বলছেন প্রার্থীরা


আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘একসময় সাভার-আশুলিয়ায় চাঁদাবাজি, জমি দখল, ঝুট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। গত ১০ বছরে এলাকায় এ ধরনের অপরাধ হয়নি। শিল্প মালিকদের কোনো সমস্যা হয়নি। ঝুট ব্যবসা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যবসায়ীরা শান্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। স্বাধীনতার পর এ আসন থেকে কেউ মন্ত্রী হননি। এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী আমাকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। গত ১০ বছরে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। মানুষ ভালোবেসেই নৌকায় ভোট দিয়ে আমাকে বিজয়ী করবেন বলে আমার বিশ্বাস।’


আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৌহিদ জং মুরাদ বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছর চুপ থাকতে বলেছিলেন, এ জন্য চুপ ছিলাম। এবার তিনিই আমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বলেছেন। এ জন্য প্রার্থী হয়েছি। আর যারা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে আমার সমালোচনা করেন, তাদের বলতে চাই- রানা প্লাজার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। মানুষও সেটা বুঝতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। তারা পরীক্ষিত ব্যক্তিকেই এবার এমপি বানাবেন।


ডা. এনামুর রহমান বলেন, মূলধারার লোকজন নৌকার জন্যই কাজ করছেন। ব্যক্তি সম্পর্কের কারণে অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে গেছেন। যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন সবাই শক্তিশালী। মানুষের ভালোবাসা আমাকে সাহস যুগিয়েছে এবং আশাবাদী করেছে।


নানা আলোচনা সমালোচনা পাশ কাটিয়ে দশ বছর পর আবারো ভোটের মাঠে প্রত্যাবর্তন সাবেক সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদের। ঈগল নিয়ে যেন উড়ে বেড়াচ্ছেন অলিগলি। নিজেকে এই আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন। মুরাদ বলছেন সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
মুরাদ বলেন, ১০ বছর মানুষ অপেক্ষা করেছে। তাদের সন্তানকে ফিরে পেয়ে তারা আনন্দিত। এলাকাবাসী তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করবেন। হাজার হাজার মানুষ আমার পেছনে আছেন, এটা সবচেয়ে আমার অযোগ্যতা তাদের আমি জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। তারা দলমত বোঝে না, আমার ভেতরই খোঁজে সবকিছু। আমার জয় মানে তো শেখ হাসিনার জয়।


তবে সব সমীকরণ পাল্টে দিতে পারেন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা ও অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সাইফুল ইসলাম। নিজের এলাকায় ভোটার বেশি এই হিসাবেই নিজেকে এগিয়ে রাখছেন তিনি। যদিও অভিযোগ করছেন হয়রানির। বলছেন প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় প্রভাব খাটাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান।


সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি আশুলিয়া এলাকার ছেলে। এই আসনের ভোটার আশুলিয়ায় বেশি। আশুলিয়াবাসী সব সময় ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা-১৯ আসনের রাজনীতিতে আশুলিয়া তাই বড় ফ্যাক্টর। আশুলিয়ার মানুষের চাপেই প্রার্থী হয়েছি। দুই প্রার্থীর চেয়ে আমি অনেক বেশি এগিয়ে। তবে তারা নানা রকম ষড়যন্ত্র করে আমার মাঠকে নষ্ট করতে চাইছেন। নৌকার লোকজন আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ক্যাম্প ভাঙছে। প্রচারে বাধা দিচ্ছে। নৌকার প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী হওয়ার প্রভাব বিস্তার করে আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছেন। তারা ভয় পেয়ে এমন কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমিই জিতব।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com