সাজা ও গ্রেফতার আতঙ্কে বিএনপি
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩৭
সাজা ও গ্রেফতার আতঙ্কে বিএনপি
মোহাম্মদ ইলিয়াস
প্রিন্ট অ-অ+

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ‘নতুন, 'নতুন’ মামলা এবং পুরোনো মামলায় সাজা ও গ্রেফতার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে।


বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, নির্বাচন আসলেই ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বিরোধী দলকে বাইরে রেখে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে করতে চায়। যতই ষড়যন্ত্র করা হোক এতে কোন লাভ হবে না। কারণ জনগণ অনেক সহ্য করেছে, এখন ধৈর্যের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ এই সরকারের পদত্যাগ চায়।

গত শনিবার (১৯ আগস্ট) সন্ধ্যার পর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পথে ১৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের অভিযোগ করে বিএনপি। এর পর রবিবার ২০ আগস্ট দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ও ডিবি-উত্তর) খোন্দকার নুরুন্নবী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনসহ ১২ জনকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।


এদিকে শনিবার (১৯ আগস্ট) সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ছাত্রদলের ৬ নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ঢাকার লালবাগে নাশকতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভিযোগে ছাত্রদলের ছয় নেতাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তাদের কাছ থেকে বিদেশি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের দাবিও করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।


আহত ছাত্রদল নেতা আবু তৈয়বকে মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাজধানীর নিউ লাইফ হাসপাতালে দেখতে যান কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আবুল হাসান চৌধুরী। এসময় হাসপাতালের সামনে থেকে আবুল হাসান চৌধুরীকে ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করছে বিএনপি।


বিএনপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন সোনারগাঁও থানার জামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইব্রাহিম মেম্বার, মোগরাপাড়া ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মো. সুরুজ মিয়া; ৫ নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম সর্দার, রূপগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা- সুমন, নাদিম, আয়লান, পিন্টু, স্বপন, বিষু, পারভেজ ও সাজ্জাতকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া একই দিনে হবিগঞ্জ জেলার আলী সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন ফয়সাল, আজমিরিগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক ফখরুল ইসলাম ও ৫ নং দৌলতপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি শেখ মো. ওমর ফরুকসহ ১৪ জনের অধিক নেতাকমীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।


এছাড়া সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আওতাধীন ৪৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির প্রচার সম্পাদক মো. সোহাগ, ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম স্বপন, ৪৩নং ওয়ার্ড বিএনপি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- মো. মনির হোসেন, যাত্রাবাড়ী থানার ৬৪ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।


ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দফতর সম্পাদক সাইদুর রহমান মিন্টু বিবার্তাকে বলেন, ২৮ জুলাই মহাসমাবেশ থেকে এই পর্যন্ত অন্তত ৩ শতাধিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।


গত ১৯ আগস্ট খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলাধীন পাগলা থানা বিএনপি নেতা- ফরিদ খান, যুবদল নেতা ফারুক খান ও ছাত্রদল নেতা আব্দুল্লাহ খানকে বিনা ওয়ারেন্টে গভীর রাতে তাদের বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ।


এছাড়াও ভালুকা উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বয়ক মো. সাখাওয়াত হোসেন পাঠান, যুবদল নেতা মো. দুলাল ও শ্রমিকদল নেতা মো. উজ্জ্বল মিয়া এবং মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়ন বিএনপি’র সদস্য মো. উজজল মিয়া, মো. ইদ্রিস আলী, যুবদল নেতা মো. রফিকুল ইসলাম, উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা বিপ্লব হোসেন রবি, জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ন কবির, গৌরিপুর উপজেলা বিএনপি নেতা মনির খান, ৫ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আ. মালেক মেম্বার, ঈশ্বরদী উপজেলা যুবদল নেতা খায়রুল আলম সোহাগ, ৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আবুল কালাম ও বিএনপি নেতা তারেকুল ইসলাম তারেককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, দাবি বিএনপির।


বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বিবার্তাকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে শুধু ময়মনসিংহ নয়, বিভাগের প্রতিটি জেলাতে গ্রেফতার চলছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।


২০১৩ সালের গাড়ি ভাঙচুর ও টাকা ছিনতাইয়ের মামলায় গত ৮ আগস্ট জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ বিএনপির ২১ জনের দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।


এছাড়া ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এক মামলায় গত ২ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তার স্ত্রী ড. জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা মামলায় সম্প্রতি বিচারিক আদালতে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নয় বছরের সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। পৃথক আরেকটি মামলায় দলটির আরেক নেতা আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া আমান উল্লাহ আমানের স্ত্রী সাবেরা আমানেরও তিন বছরের সাজা উচ্চ আদালত বহাল রেখে রায় দিয়েছেন।



বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতাদের নামে করা দুর্নীতির অনেক মামলা বাতিলে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন তারা। উচ্চ আদালত অনেক মামলাই বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। দীর্ঘদিন এসব মামলার বিচারকাজ বন্ধ ছিল। সেই মামলাগুলো পুনরায় সচল হচ্ছে। এসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে দ্রুত রায় দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা দলটির নেতা ও আইনজীবীদের।



বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির বিরুদ্ধে করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় ৪৯ লাখ ৪১ হাজার ৭২২। আর অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মোট মামলার মধ্যে দুই হাজার ৮৩০টির বেশি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এরমধ্যে কয়েকশ গায়েবি মামলাও রয়েছে।


বিএনপি দফতর সূত্র জানায়, ১৮ ও ১৯ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি গণমিছিল ও পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৪টি নতুন মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২১১৫ জনকে। এসময় সারাদেশে বিএনপির ৯৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


এছাড়া গত ২৮ ও ২৯ জুলাই হতে ২২ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৩২৪টি নতুন মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলায় আসামি ১৩ হাজার ১১৫ জন। এ সময় সারা দেশে বিএনপির ১৫২১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বিবার্তাকে বলেন, আমরা দমন পীড়নের মধ্য দিয়েই কাজ করছি। মাঝে মাঝে দমন-পীড়নটা একটু বেশি চোখে পড়ে। যখন তারা (আওয়ামী লীগ) মনে করে তাদের পতন বোধ হয় খুব কাছাকাছি, তখন তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি তৈরি করার জন্য দমন পীড়ন বৃদ্ধি করে। সরকার নিজেদের মুখ থেকে তাদের পতনের কথা বলছে। সরকার মনে করে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে পারলে তার শেষ রক্ষা হবে এজন্য আমাদের নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতার করছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা যাতে আগামী দিনে নির্বাচন করতে না পারে সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে সাজা দেওয়া হচ্ছে।


মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, মামলা এবং সাজা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের দমন করা সম্ভব নয়। মামলা, হামলা, গ্রেফতার এবং সাজা দেওয়ার পরও নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মনোবল দেখা যাচ্ছে, এতে আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই; চলমান আন্দোলন আরো বেগবান হবে। যেখানে একজন নেতা গ্রেফতার হবে সেখানে আরো ১০ জন নেতা তৈরি হবে। মানুষ এই সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এদের অধীনে যদি কোন নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন কোনদিন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।


বিএনপি'র যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বিবার্তাকে বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, নির্বাচন আসলেই ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করতে চায়। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী দল। তারা যেকোনো নির্বাচন আসলেই ষড়যন্ত্র করে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা একতরফা নির্বাচন করতে চায়। যতই ষড়যন্ত্র করুক কোনো লাভ হবে না। কারণ জনগণ বুঝে গেছে তারা অনেক সহ্য করেছে, এখন ধৈর্যের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ সরকারের পদত্যাগ চায়।


নেতা-কর্মীদের সাজা এবং গ্রেফতারের চলমান আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটেই নয়। সাজা এবং মামলা দেওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে আরও উত্তেজনা বাড়ছে। নেতাকর্মীরা মনে করছে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য অনেক লোক মারবে। সরকারের এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য নেতাকর্মীরা আরো সংগঠিত হচ্ছে।


বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বিবার্তাকে বলেন, বিএনপির চলমান একদফা আন্দোলনে সরকার ভীত সন্ত্রস্ত গেছে, তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পূর্বে গায়েবী মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল হাতে নিয়েছিল। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারও বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে মাঠ খালি রাখতে চায়, কিন্তু এতে কোন লাভ হবে না। এবার জনগণ জেগে উঠেছে। জনগণ একদফার এই আন্দোলন সফল করবে এবং সরকারের পতন ঘটাবে। দমন পীড়ন চালিয়ে মিথ্যে মামলা দিয়ে, গায়েবী মামলা দিয়ে, সাজা দিয়ে, গ্রেপ্তার করে এই আন্দোলনকে বন্ধ করা যাবে না। তারেক রহমানের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে সেই আন্দোলন বিজয় অর্জন হবে ইনশাআল্লাহ।


বিবার্তা/এমই/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com