রাজস্ব এলেও, পর্যটনের বিকাশ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর বাড়াচ্ছে চাপ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৩, ১০:২২
রাজস্ব এলেও, পর্যটনের বিকাশ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর বাড়াচ্ছে চাপ
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬৬%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৪%) রয়েছে ভারতের মধ্যে।


সুন্দরবন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে 'সুন্দরবন' ও 'সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান' নামে। এই সুরক্ষা সত্ত্বেও, আইইউসিএন রেড লিস্ট অফ ইকোসিস্টেম ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে ২০২০ সালের মূল্যায়নে ভারতীয় সুন্দরবনকে বিপন্ন বলে মনে করা হয়েছিল।


সুন্দরবনকে জালের মতো  জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।


সুন্দরবনের বিভিন্ন খাত থেকে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পর্যটকদের যাতায়াত। এরই মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বনে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর চাপ বাড়ছে।


সুন্দরবনের ভেতরে বর্তমানে আটটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে বছরে প্রায় দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। ওই পর্যটনকেন্দ্রগুলো হলো পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী ও দুবলার চর। আর পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল), কলাগাছী ও কাগা দোবেকী। এসব স্থানে ভ্রমণ করা পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।


বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশ্চিম বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ভ্রমণে গেছেন ৫৯ হাজার ৯১৫ জন। এ থেকে রাজস্ব এসেছে ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেছেন ৭৩ হাজার ৬১৩ জন। রাজস্ব উঠেছে ৭৬ লাখ ১৯ হাজার ৪৭০ টাকা।


অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ পর্যটন থেকে রাজস্ব পেয়েছে ৬৭ লাখ ৬ হাজার ৫৭৬ টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব পেয়েছে ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।


এই পর্যটনকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি নতুন করে তিনটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরি করছে বন বিভাগ। এগুলো হচ্ছে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী এলাকায় এবং শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিকে। এসব পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে আশপাশের বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা পড়েছে। বনের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে কংক্রিটের স্থাপনা। এতে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।


বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঠ, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধুসহ ১২ ধরনের খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করা হতো। ১৯৮৯ সালে আইন করে গেওয়া, গরান ছাড়া সব ধরনের গাছ কাটা বন্ধ করা হয়। ২০০৭ সালে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর গেওয়া ও গরান আহরণও বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। বর্তমানে শুধু মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধু ও পর্যটন থেকে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে।


বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগ থেকে রাজস্ব আহরণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করেছে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।


খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, সরকার চায় রাজস্ব বৃদ্ধি পাক। সেই হিসেবে বৃহৎ এই সুন্দরবনের গুটিকয়েক কয়েক খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। তবে পুরো সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা রয়েছে সংরক্ষিত। ওই এলাকাগুলো রয়েছে রাজস্ব আহরণের বাইরে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ করতে গিয়ে বনের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না।


শুধু রাজস্ব আহরণের ব্যাপারটি মুখ্য নয় উল্লেখ করে মিহির কুমার দো বলেন, এর সঙ্গে সুন্দরবনসংলগ্ন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা জড়িত।


সুন্দরবন সাধারণত পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান) আওতায়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওই পরিকল্পনা হয় ১০ বছর মেয়াদি। সবশেষ ২০২০ সালে ওই পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর দুই বছর কেটে গেলেও নতুন করে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি।


বন কর্মকর্তারা বলছেন, ওই পরিকল্পনার আওতায় সুন্দরবনে কখন, কোথায় কী কাজ করা হবে, তার বর্ণনা থাকে। কিন্তু বর্তমানে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় ভবিষ্যতে সুন্দরবন নিয়ে কী ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজন, তা তাঁরা জানতে পারছেন না।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com