পাথর নয়; পাথুরে-জলে পাথারিয়া
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:১৪
পাথর নয়; পাথুরে-জলে পাথারিয়া
পর্যটন ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল অবস্থিত। এই পাহাড়েই রয়েছে মনোমুগ্ধকর মাধবকুন্ড জলপ্রপাত। প্রায় ২০০ ফুট ওপর থেকে আছড়ে পড়া জলের স্রোত। এছাড়া এই পাহাড়ের বুক জুড়ে রয়েছে আরও অসংখ্য ছোট ছোট ঝরনা। যেগুলোর মধ্যে সন্ধ্যানী, মায়াবন, মায়াকানন অন্যতম। যেই দুর্গম ঝর্ণাগুলোতে বর্ষার মৌসুমে যাওয়াটা বেশ দুষ্কর। এই শীতই জায়গাটি ঘুরে দেখার উত্তম সময়। বড় বড় পাথর, ক্ষীণ জলস্রোত আর প্রশান্তিদায়ক সবুজে ঘেরা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে প্রায় সারাবছরই থাকে পর্যটকদের আনাগোনা।


এই পাহাড়টি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ৮ নম্বর দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের অধীন গৌরনগর মৌজার অন্তর্গত। এই পাহাড়, সিলেট সদর থেকে ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।


মৌলভীবাজার জেলার উত্তর প্রান্তিক জনপদ বড়লেখা উপজেলা। অনিন্দ্যসুন্দর নিসর্গের এক মায়াবী এ উপজেলা। পূর্বে ভারতের প্রায় ২০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত। দক্ষিণে জুড়ী ও কুলাউড়া। পশ্চিমে রয়েছে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা। শুধু নামে নয়, বড়লেখা গুণেও বড়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত ও এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি এ উপজেলায়।


এখানে পূর্বে প্রচুর প্রাকৃতিক কমলা লেবুর গাছ থাকলেও বর্তমানে তার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এই বনাঞ্চলটি আগর-আতর কাঠ গাছের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে এখানে যেসব প্রাকৃতিক উদ্ভিদ দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছেঃ নাগকেশর, পালান, বাঁশ, বেত, কালাকস্তুরী বা মুশকদানা ও বনঢ্যাড়শ।


পাথারিয়া পরিপূর্ণ এক জঙ্গল। সুন্দরবনে যেমন কাদা, শ্বাসমূল, লতা, কাঁটা, পচা শামুক আর ঘন গাছের জন্য খুব বেশি ভেতরে যাওয়া যায় না, এখানেও ঠিক এমন—নুড়ি-পাথর, ঝুরা মাটি, কাঁটাগাছ, মাকড়সার ক্যাতকেতে জাল, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, সাপের খোলস, শজারুর কাঁটা, ভালুকের মল আর ঠিক এক হাত দূরে ধুপ করে উদয় হওয়া নিরেট পাহাড়ের জন্য এই জঙ্গলও অনেকটা দুর্বোধ্য। এর সঙ্গে ডানে-বাঁয়ে তাকালেই দেখা যায় বড় বড় গাছ মাটির সঙ্গে লেপ্টে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখে মনে হয় এখনো এদের ঘুম ভাঙেনি! ঘটনা আসলে ভিন্ন, এদের ওপর দিয়ে বুনো হাতি চলে গেছে। এসব দেখেই পিলে চমকে যায়! আর তার ওপর যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।


হাজার হাজার বছর ধরে রহস্যে আগলে রাখা এই জঙ্গল বুকের মধ্যে চেনা-অচেনা নানা প্রজাতির প্রাণীকে যেমন আগলে রেখেছে, ঠিক তেমনি লোকচক্ষুর আড়াল থেকে লুকিয়ে রেখেছে অনেক বুনো ঝরনাকেও। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় লোকজনের আনাগোনাও কম এখানে। সবাই মাধবকুণ্ড ঝরনা দেখে চলে আসে, কিন্তু কেউ জানেই না যে ঠিক পাশের পাহাড়েই হুমহাম করে বয়ে চলছে পাথারিয়ার সবচেয়ে বড় ঝরনা পুছুম কিংবা তার থেকেও প্রায় দুই ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস বিপৎসংকুল ঝিরিপথ ডিঙালে দেখা মিলবে প্রায় ১২০ ফুট উচ্চতার অনিন্দ্যসুন্দর বান্দরডুবা ঝরনার। আর তার থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে পা বাড়ালেই সামনে পড়বে পাইথুং। বিশালত্ব না থাকলেও এই ঝরনা পাথারিয়া পাহাড়ের একমাত্র ‘ডাবল ফলস’, যার দুদিক দিয়েই পানি পড়ে। যদি কেউ আরও অ্যাডভেঞ্চার চায়, তাহলে সেখান থেকে হাঁটতে হবে আরও দেড় ঘণ্টা, পায়ের নিচে পানি থাকলে ‘কলিজা শুকিয়ে যাওয়া’ এই শ্বাপদসংকুল পথটা পাথারিয়ার সবচেয়ে কঠিন ঝিরিপথ—যদি ডিঙাতে পারেন এ পথ, তবেই দেখা মিলবে ‘রজনীকুণ্ড’ ঝরনার...


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বড়লেখার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২৫ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ের জন্ম অনেক আগে, অর্থাৎ বেশ অনেক আগেই তৈরি এ অঞ্চল। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ, যথা—দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা ইত্যাদি। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ২৪৪ মিটার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডের অবস্থান এর ঠিক পাশেই। অনেকে মাধবকুণ্ডের নাম শুনে থাকলেও ‘পাথারিয়া’ নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ দেখা যায় না।


পাথারিয়া পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, পাথারিয়া পাহাড়ে রয়েছে বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোঁপ। ফুলের মধ্যে আছে আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলি জুঁই, নাগবাল্লী, লুটকি, নীললতা, টালি, ল্যডিস আম্ব্রেলা, ডুলিচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া এবং আরো নানা জাতের ফুল। ফল-ফসলের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শাক, কচু, লতি, বাঁশের খোড়ল (করিল), লেবু, রামকলা, ডেউয়া, লুকলুকি, ক্ষুদিজাম, চালতা, জাম, বহেড়া, হরীতকী, বুনো আম, কাঁঠাল, আমলকী, গোলাপজাম, সাতকরা লেবু, তৈকর, আশফল, গুঙ্গাআলু এবং আরো নানা জাতের পাহাড়ি ফলমূল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিচিত্র রকমের বন্য প্রাণী, জংলি হাতি, বানর, হনুমান, বাগডাস, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোশ, অজগর সাপ প্রভৃতি। পাখপাখালির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ ও আরো বিভিন্ন জাতের পাখি।


যেভাবে যাবেন


ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে ট্রেনে এলে নেমে যেতে পারেন কুলাউড়া স্টেশনে। সেখান থেকে ৪০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে দক্ষিণভাগ। দক্ষিণভাগ থেকে সিএনজিতে সমনভাগ হাসপাতালের সামনে। তার পর গাইড নিয়ে হাঁটাপথে পাথারিয়া ভ্রমণ।


সরাসরি বড়লেখা বাজারে আসতে পারেন। সার্ভিস রয়েছে এনা ও শ্যামলী পরিবহনের। বড়লেখা থেকে ২০০ টাকার মতো ভাড়ায় সিএনজি রিজার্ভ করে যাওয়া যায় সমনভাগ হাসপাতালের সামনে। এরপর যথারীতি গাইড নিয়ে হাঁটা শুরু।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com