
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা সরকারের খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে কি না কিংবা এটি ‘মনুষ্যসৃষ্ট’ বা অন্য কোনো বিপর্যয় কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর তারাও খুঁজছেন।
এটি সবার নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর উত্তর পেতে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
২৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরছিলেন।
ব্রিফিংয়ে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সরকার কী ধারণা করছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার এভাবে ধারণা করতে পারে না। সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। কারণ এটা আমাদের সকলের নিরাপত্তার বিষয় এবং এখানে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো থাকে।
সচিবালয়ে নিরাপত্তার কোনো ব্যত্যয় ছিল কি না? এ প্রশ্নে রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ প্রশ্নটা আমাদেরও। সচিবালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি আদৌ ফেল করেছে? এটা কি কোন মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় না কি অন্য কোনো বিপর্যয়? এগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে হবে। সব সম্ভাবনা মাথায় রেখে সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা আলোচনা করাটা ঠিক হবে না।
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগা এবং দুই প্রান্তে আগুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনটা আরও আগে নেভানো যেত কি না, আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়েছে কি না-এগুলো কমিটির প্রতিবেদন না এলে আমরা উত্তর দিতে পারব না।
বিফ্রিংয়ে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিরাপত্তার বিষয়ে বলেন, সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য একজন করে এসপি ও এএসপি এবং প্রায় ৫৬০ জনের মত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছে। ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।
বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় ১০ ঘণ্টা পর সেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়।
দশ তলা ওই ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ওই ভবনের ৬, ৭, ৮, ৯-এ চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
রাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় ১০ তলা ওই ভবনের উপরের দিকের একটি ফ্লোর এমাথা-ওমাথা জ্বলতে দেখা যায়। এ অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিয়ে অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সন্দেহ প্রকাশ করেন।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার বিষয়ে তুলে ধরতে সন্ধ্যায় এ বিফ্রিংয়ে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ ও আগাম গোয়েন্দা তথ্য থাকা বিষয়ক প্রশ্নে রিজওয়ানা বলেন, গোয়েন্দা তথ্য থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিত। তথ্যের প্রবাহ ঠিক আছে কি না, তা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দেখতে হবে। কিন্তু তথ্য থাকলে আমরা বসে থাকতাম না।
আগুনের ঘটনাকে সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, যার জন্য তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। আপনারা প্রথম দিকে গিয়ে থাকলে, ভিডিও করে থাকলে তদন্ত কমিটিকে দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। অনেক প্রশ্ন অনেকের মনে আছে, সব প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা আমাদের মতো দিতে থাকি, তাহলে তো তদন্ত কমিটি করে কোনো লাভ হচ্ছে না। তদন্ত কমিটিকেই যার যা বক্তব্য আছে, কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে প্রয়োজন মনে করে জানিয়ে দিবেন।
এ ঘটনার সুষ্ঠু ও বিস্তারিত তদন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আজকের ঘটনার কারণটা যখন আমরা নির্ধারণ করতে পারব, সে অনুযায়ী আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেব। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে কখনো না ঘটে, সে ব্যবস্থাও আমাদের নিতে হবে। আজকে নথি পুড়ে গেছে। এখানে নিরাপত্তার ব্যত্যয় ছিল কি না, অন্য কোনো বিষয় ছিল কি না, কী কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে-এগুলো সবই তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা অনেক ডিজিটালাইজেশনের কথা শুনে দায়িত্বে এসেছিলাম। আগুনের ঘটনার পরে আমরা দেখলাম যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আমাদের কোন মন্ত্রণালয় পাচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে একজন কর্মকর্তা ও প্রযুক্তি। ডিজিটালাইজেশনের সুফল আমরা পাচ্ছি না।
আগুনে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য বিফ্রিংয়ে তুলে ধরেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
তিনি বলেন, ''প্রায় পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথি কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে আমরা উদ্ধার করতে পারব। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটাই অ্যানালগভাবে ফাইল হয়। তাই যে শাখাগুলোর নথিগুলো পুড়ে গেছে, সেগুলো কতটা রিকভার করা যাবে তা নিরূপণ করার জন্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজ করে প্রতিবেদন দিলে আমরা বুঝতে পারব, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কোনটা রিকভারেবল আর কোনটা রিকভারেবল না।
আগুনের পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা কিছু অর্থনৈতিক অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে পিরোজপুর জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে দেওয়া বরাদ্দে পিডিসহ কাটছাঁট করে অর্থ লোপাটের প্রাথমিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর সাথে সাবেক মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের প্রাথমিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেটার বিস্তারিত তদন্ত এখনো চলছে। আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম, তদন্তের যে ফাইলগুলো ছিল মন্ত্রণালয়ে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটি যেহেতু জেলা পর্যায়ে সংগঠিত হয়েছে, সেজন্য আমরা এগুলো উদ্ধার করতে পারব। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা পিরোজপুরে আছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য অন্যান্য সরকারি দপ্তর যেখানে জায়গা খালি আছে, সেই জায়গাগুলোতে রিলোকেট করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এরই মধ্যে কোথায় কোথায় খালি আছে, কোথায় কোথায় মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম আপাতত অস্থায়ীভাবে পরিচালনা করা যায়।
বেশির ভাগ তদন্তই আলোর মুখ দেখে না, এ তদন্ত কি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে? এমন প্রশ্নে রিজওয়ানা বলেন, তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন তারা দেবেন। আমরা সেখানে অফিস করি, এটা তো আমাদেরও নিরাপত্তার বিষয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথির বিষয়। প্রাথমিক প্রতিবেদনের পরে তারা যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবেন তা অবশ্যই আপনারা পাবেন। তদন্তের স্বার্থে হয়ত প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ সম্ভব নাও হতে পারে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুততার সঙ্গেই হবে। সেই প্রতিবেদন আপনারা পাবেন। 'আগুনের উৎসের‘ বিষয়ে তদন্ত কমিটিই সঠিক বলতে পারবে। প্রাথমিক তথ্যের বিষয়টি সকলেই জেনে গেছেন।
আওয়ামী লীগের সহযোগী ‘আমলা লীগ ও মিডিয়া লীগের‘ সদস্যদের সরকার ছাড় দেওয়ার অভিযোগ বিষযক প্রশ্নে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ''আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তদন্ত করতে হয়, সেই অনুযায়ী অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অনেককে চাকরি হতে সরানো হয়েছে, কাউকে কাউকে ওএসডি করা হয়েছে, কেউ কেউ কারাগারেও গেছেন। প্রশাসনের গতিটা রেখে ঢেলে সাজানোর কাজ আমরা করছি। এটা এমন না যে কোন দাগী আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে কিন্তু আমরা তদন্ত করি নাই। সরকার আইনানুগ প্রক্রিয়া ফলো করে এগুচ্ছে।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]