শিক্ষা উপবৃত্তির অর্থ আত্মসাৎ: গ্রেফতার প্রতারক চক্রের ৮ সদস্য
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৪১
শিক্ষা উপবৃত্তির অর্থ আত্মসাৎ: গ্রেফতার প্রতারক চক্রের ৮ সদস্য
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেয়ার নাম করে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রতারণা, অর্থআত্মসাতে জড়িত মূলহোতাসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।


সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করে র‍্যাব- ৪, ৫, ৮, ১০, ১১ ও ১৪ যৌথ দল।


গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭), অন্যতম মূলহোতা মো. বাপ্পি মোল্লা (২০), মো. উসমান গনি মোল্লা (৩৩), শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), কাজী সাদ্দাম হোসেন ওরফে আমির হামজা (২৬), মো. আহাদ গাজী (২৪), মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় (২৬)।


২২ এপ্রিল, সোমবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৫ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস।


র‍্যাব বলছে, সারাদেশে ২ হাজারের বেশি চক্রের সক্রিয় এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে। এক রকম শেয়ার বাজারের মতো দরকষাকষি করে তাদের হাজারে ৩০/৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার কাজ দেয়া হয়। এজেন্ট হতে হলে দিতে হয় অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা।


চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে সিম রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার এ মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।


বিভিন্ন সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে। প্রতারণার টাকা মূলচক্রের সদস্যের মধ্যে বন্ঠন করা হয়। কমিশন ও কাজের খরচা বাবদ এজেন্টদের দেয়া হয় নির্ধারিত টাকা।


র‌্যাব-৫ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড/ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।


একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ২৪ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শালবাগান রাজশাহীর বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাউন্টেট শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান বলে পরিচয় দিয়ে তার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে বলে জানায়।


ওই টাকা বাদীর একাউন্টে চলে যাবে মর্মে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ষোল ডিজিটের নাম্বার দিতে বললে তিনি তার ষোল ডিজিটের নাম্বার প্রদান করেন। এরপর ওটিপি যাবে বলে জানায়। পরবর্তীতে বাদী মোবাইল মেসেজ অপশনে দেখতে পায় বাদীর একাউন্ট থেকে চার বারে এক লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা হাওয়া।


ওই ঘটনায় তিনি বাদী অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা জড়িতদের গ্রেফতারে র‌্যাব-৫, অধিযাচনপত্র প্রদান করলে র‌্যাব-৫, রাজশাহী জড়িতদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।


এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৫ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেয়ার নাম করে ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রতারণার কাজে জড়িত শামীম হোসেনকে রাজশাহী জেলার রাজপাড়া থানা এলাকা হতে গ্রেফতার করে।


জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানায়, সে শুধুমাত্র মাঠ লেভেলে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট হতে টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টে প্রেরণ করতো। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে।


এরপর একে একে মূলহোতা জাকিরসহ বাকিদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের নিকট হতে ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ-৩ লাখ ১২৭০ টাকা ও ৯টি ব্যাংক লেনদেন স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংর এর একাউন্ট রয়েছে।


এলাকায় পরিচিতি ওয়েলকাম ও হ্যালো গ্রুপের সদস্য হিসেবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সরকারি অফিস থেকে শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা দেয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তারা ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের কলিং সেন্টারে শেয়ার করে। এরপর মূলহোতা জাকির হোসেনের দুই ছেলে মানিক ও হিরা ফোন দেয়। নাম্বার নেয়। কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে ওটিপি নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে।


এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-৫ অধিনায়ক বলেন, ওয়েলকাম/হ্যালো গ্রুপের রয়েছে সারাদেশে ২ হাজারের বেশি এজেন্ট। এজেন্ট হতে হলে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে এন্ট্রি করতে হয়। এরপর মোবাইলে তাদের নামে একটা একাউন্ট হয়। ইতোমধ্যে তদন্তে ১৮৬১ টি মোবাইল নাম্বার শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।


হাজারে ৩০ বা ৪০ টাকা কমিশন পাবার চুক্তিতে প্রতারণার কাজে এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। এজেন্টের এন্ট্রিকৃত মোবাইল একাউন্টে টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে মূল চক্রের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্র তারা তুলে নেয়।


তাছাড়া তারা এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। মূল শহর থেকে ১৫/১৬ কিমি দূরে অবস্থান করে। টাকা ঢাকা মাত্র নিকটস্থ কোনো এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করে। তারা নিজেরা অন্য কোন যানবাহনে চলাচল না করে মোটরসাইকেলে চলাচল করেন। বাড়িতেও থাকেন না নির্জনে থাকেন।


এই প্রতারণাকে তারা ব্যবসা হিসেবে দেখেন খারাপ কিছু ভাবেন না। তারা শুধু নিজেরা নন পারিবারিকভাবে ব্যবসায় তারা জড়িয়েছেন। প্রতারক চক্রে বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনরাও প্রভাবিত হয়ে অনেকে এই অভিনব প্রতারণা কাজে জড়িয়ে পড়েছেন তথ্য পেয়েছি।


লে. কর্নেল মুনীম বলেন, খোকন মোল্লা এই প্রতারণায় জড়িত। অভিযানের সংবাদে পলাতক খোকন মোল্লার ছেলে বাপ্পি মোল্লাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। আমরা জানতে পেরেছি খোকন মোল্লার মোবাইলে একদিনে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা এসেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।


অন্যদিকে মূলহোতা জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেফতারের পর তার মোবাইলে দেখা গেছে, দুই লক্ষাধিক টাকা আদানপ্রদান হয়েছে।


চক্রের যারা সদস্য রয়েছে তাদের মধ্যে দর কষাকষি হয়। এক রকম শেয়ার বাজারের লেনদেনের মত দর উঠানামা করে। কে কত টাকায় এই প্রতারণামূলক কাজটি করবে। কেউ হাজার টাকায় ৪০ টাকা কেউ হাজার টাকায় ৩০ টাকা কমিশন পেতে কাজটি নেয়। তাদের মধ্যে যারা পারদর্শী ও বিশ্বস্ত তাদেরকে কাজটি দেওয়া হয়। অর্থ আত্মসাৎ এর কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর সেই এজেন্ট নিজের প্রাপ্ত অংশ রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর প্রচার চক্রের মূলহোতা বাকি টাকা বণ্টন করে দেন।


চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে সিম রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার এ মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।


একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম বিক্রেতা গ্রেফতার আহাদ গাজী। কোম্পানি থেকে টার্গেট থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ সিম বিক্রি করতে হবে বিক্রি করতে না পারলে তাকে চাপে থাকতে হয়। এজন্য বিভিন্ন লোক আসলেই তারা ৫০ ১০০ টাকা সিম বিক্রি করে। যদিও এই সিম ফ্রিতে দেওয়ার কথা। বিভিন্ন সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সিম বিক্রি। কেউ ফেরত দিলে সেটি পুনরায় বিক্রি করে এই প্রতারক চক্রের কাছে। ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় এসব সিম সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে প্রতারক চক্রটি।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com