'মানব মুক্তির জয়গান প্রতিষ্ঠার সম্মিলিত শপথ হোক শোকাবহ আগস্টে'
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৬:০৮
'মানব মুক্তির জয়গান প্রতিষ্ঠার সম্মিলিত শপথ হোক শোকাবহ আগস্টে'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। একইসাথে বাঙালি জাতির জীবনে এক কলঙ্গজনক অধ্যায় এই দিনটি। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী এই দিনে।



১৯৭৫ সালের এই দিন ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।



সেই দিন ঘাতকের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে চিৎকার করেছিল ১০ বছরের শিশু রাসেল। বাবা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কর্মচারীর কোলে প্রাণের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পালাতে চেয়েছে সে। কিন্তু রক্তাক্ত করিডোর আর নরপশুদের থাবা তাকেও ছাড়েনি। ভীত ও কাতর কণ্ঠে শিশুটি বলেছে, ' আমি মায়ের কাছে যাব’। ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। ছোট্ট রাসেলের এই মিনতি টলাতে পারেনি নিষ্ঠুর পিশাচদের মন। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।


এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরপিশাচরূপী খুনিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু করে। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারি ইতিহাস রচিত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, নরপিশাচরূপী খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনীদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে। পরবর্তীতে জাতির পিতার সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে। তবে এখনো বেশ কয়েনকজন খুনি দেশের বাহিরে পলাতক থাকায় তাদের সাজা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তাদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার।


শোকাবহ আগস্ট নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়। এই দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ তিতিক্ষা ও সংগ্রামের বিষয় ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। তবে আমাদের আক্ষেপের বিষয় বঙ্গবন্ধু এই দেশকে স্বাধীন করলেও দেশকে তিনি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় বঙ্গবন্ধুুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস আমাদের জন্য বেদনাবিধুুর হলেও এই দিন থেকে আমাদের শিক্ষা দিতে হবে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষা, ত্যাগের শিক্ষা, সংগ্রামের শিক্ষা। আর এসব শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা কাজ করি তাহলে এই দেশ শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হবে।


শোকাবহ আগস্ট নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘাতকদের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় বঙ্গবন্ধু তা করে যেতে পারেননি। তাঁকে ১৫ আগস্টে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সপরিবার হত্যা করা হয়। এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্যও এক কলঙ্কজনক ঘটনা। আমরা হতভাগা আমরা আমাদের জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারেনি। এই দায় আজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী প্রেতাত্মরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দেশের স্বাধীনতাকে মানতে না পেরে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।


তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মানবিক, উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণা করে সেই মোতাবেক কাজ করেছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকের দিনে আমরা এই শপথ নিতে চাই, এই দেশকে অসাম্প্রদায়িক ও সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা কাজ করবো।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য ( শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বিবার্তাকে বলেন, ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি তাঁর জীবনের ২৩ টি বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। এই দেশের মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসিকতাকে পাকিস্তানি শাসক-শোসকরাও ভয় করতো, এমনকি তারা তাঁকে মারার সাহস করেনি। কিন্তু এই দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী কুলাঙ্গার বিদেশি শক্তির মদদে জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।


তিনি বলেন, ঘাতকরা ভেবেছে- বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার মারলে সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না! তারা বঙ্গবন্ধুকে মারতে পারলেও তার আদর্শকে মারতে পারেনি। বরং গণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে গেছে।


অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মানতে পারেনি, এই দেশকে মানতে পারেনি! তারাই এই দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফেরাতে পিশাচিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাহিরে থাকায় এই হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পায়। আজকে তারাই এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। সমস্ত জাতি তাদের সাথে কাজ করছে। তবে এখনো একাত্তরের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। শুধু তাই নয়, যারা একাত্তরে এই দেশের বিরোধিতা করেছে সেই সব মার্কিন সম্রাজ্যবাদও আজও তৎপর। তারা যে কোনো মূল্যে সুযোগ পেলে এই দেশকে অস্থিতিশীল করে পাকিস্তানি ধারায় ফেরাতে চাইবে। এক্ষেত্রে আমাদের ১৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নিতে হবে- দেশদ্রোহী-অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবো এবং একইসাথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করবো।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ঘাতকেরা পঁচাত্তরের পনের আগস্ট আমাদের অস্তিত্ব, সত্ত্বা, স্বকীয়তা, আইডেনটিটি এবং সকল দুঃখ মোচনের প্রধান আশ্রয় প্রবাদ পুরুষ পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তাদের সংকীর্ণ ও লোলুপ দৃষ্টি সেদিন শুধু এইটুকুন বুঝতে পারেনি, বাংলাদেশের বুক জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নাম যেভাবে লিপিবদ্ধ করা আছে, বুলেটে তা মোছা যায় না। বরং গোটা বাংলাদেশ চিরকাল পিতা হত্যাকারীকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেই চলবে। আর বঙ্গবন্ধু চেতনায় চিরভাস্বর হয়ে রইবেন বাংলাদেশ ও বিশ্ববুকে।


ড. মশিউর রহমান বলেন, এই শোকাবহ আগস্টে আমাদের অঙ্গীকার হোক- মুজিবকে ভালোবেসে, তাঁর চেতনাকে ধারণ করে উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়া। মানব মুক্তির সকল সোপানে উন্নীত হওয়া আর সমতা, মমতা ও ভালোবাসার একটি অপূর্ব বাংলাদেশ সৃষ্টি করা।


উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অগণতান্ত্রিক চর্চা, সামরিক শাসনের আস্ফালন আর সকল প্রকার ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে মানব মুক্তির জয়গান প্রতিষ্ঠা হোক শোকাবহ আগস্টে আমাদের শক্তি সৃষ্টির সম্মিলিত শপথ।


বঙ্গবন্ধু কন্যার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীত হবার স্বপ্ন শপথে আসুন সকলে সম্মিলিত হই, আসুন সংঘবদ্ধ হই। অশুভকে প্রতিহত করি, গড়ে তুলি দুর্বার ঐক্যে অপূর্ব সৃজনশীল স্রোতধারা। যেন ধুয়ে মুছে নির্বংশ হয় বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তি।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য আরো বলেন, পিতা মুজিবের লড়াই ছিল বিশ্ব মানবতা ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়। সে দর্শনে তিনি বিশ্বনেতা ও রাজনৈতিক দর্শনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক মহামানব। বঙ্গবন্ধু আমাদের ভালবাসার নাম; আমাদের চেতনার আঁধার, আর বাঙালির সর্বকালের আশ্রয়। বাংলাদেশের আগামীর পথ চলার অনুপ্রেরণা, অনুসরণ আর ক্যারিশমার অনুসন্ধানের একমাত্র আশ্রয়- মুজিব আদর্শ। আমরা যতই আধুনিক, অগ্রসর এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ধাবিত হবো বঙ্গবন্ধু ততবেশি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও অত্যাবশ্যক হয়ে রইবেন।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com