৩ গুণ বেশি আম রপ্তানির সম্ভাবনা
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৩, ১০:০৯
৩ গুণ বেশি আম রপ্তানির সম্ভাবনা
মোফাজ্জল বিদ্যুৎ
প্রিন্ট অ-অ+

মধুমাস জ্যৈষ্ঠ আসতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আম নামানোর জন্য ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছে। আম পাড়াও শুরু হয়েছে উত্তরের জেলাগুলোতে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে সঠিক প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে নিরাপদ ও বালাইমুক্ত ৫ থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানির প্রত্যাশা করছে কৃষি বিভাগ, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ গুণের বেশি।



তবে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা আম রপ্তানি ১০ হাজার মেট্রিক টন ছাড়াবে। তারা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগের বছরের তুলনায় ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি আম বিদেশে পাঠানো যাবে। এটা সম্ভব হলে রপ্তানি আয় আসবে হাজার কোটি টাকার বেশি। আর তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।



কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছর দেশে ২ লাখ ২ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন। বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন।


গত বছরে উৎপাদিত আমের পরিমাণকে চলতি মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন।


আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি বছর আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা এখনও নির্ধারণ করা না হলেও তিনগুণের বেশি হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আরিফুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ‘এখনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে আমরা ধারণা করছি, আগের বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রপ্তানি করা যাবে। কোনো দুর্যোগ না আসলে আমরা আশা করছি ৫ থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা যাবে।’


তবে কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি আম রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা। আমের ব্যবসায় সুপরিচিত মুখ রাজশাহী-চাঁপাই অ্যাগ্রো ফুড প্রোডিউসারের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ারুল হক বিবার্তাকে বলেন, ‘গত বছর ১৮’শ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। বেশির ভাগ আমই রাজশাহী-চাঁপাই থেকে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া সাতক্ষীরা থেকেও কিছু আম বিদেশে পাঠানো হয়। আবহাওয়া ঠিক থাকলে এ বছর দেশ থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি নিরাপদ ও বালাইমুক্ত আম রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।’


রাজশাহী অ্যাগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক আরও বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, সিঙ্গাপুর এবং ওমানে আম রপ্তানি করা হয়। এ বছর জেদ্দাতেও আম রপ্তানি করা হবে। ঢাকার সদরঘাটে আমের কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট দেয়া হয়। তারপর বিদেশে রপ্তানি করা হয়।’


তিনি বলেন, ‘রাজশাহী, চাঁপাই ও নওগাঁয় প্যাকেজিং হাউজ স্থাপন করতে পারলে আমের ক্ষতি কম হবে। ফলে খুব সহজেই ভালো মানের আম বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। রপ্তানিও বাড়বে।’


উল্লেখিত পরিমাণ আম রপ্তানি করা গেলে তা দেশের জন্য গৌরবের ও অর্থনীতির জন্য ভালো বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ‘আম যেহেতু গ্রামের বিস্তৃত এলাকা এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতে হয়, সেই ক্ষেত্রে বণ্টনের চেইনটা লক্ষ্য রাখতে। পাশাপাশি মান যাচাই করে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। আর রপ্তানির যে আয় তা দেশের অর্থনীতিতে বিস্তৃত প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে লোকাল প্রক্রিয়াজাতের দিকে নজর দিলে আম রপ্তানি আরো বেশি হবে।’ আম উৎপাদনে আরো বিনিয়োগ ও গবেষণা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।


ম্যাঙ্গোপঞ্জি অনুসারে রাজশাহী অঞ্চলে ৪ মে থেকে আম পাড়া শুরু হয়েছে। উন্নত জাতের আমগুলোর মধ্যে গোপালভোগ ১৫ মে, লক্ষ্মণভোগ বা লখনা ও রাণীপছন্দ ২০ মে এবং হিমসাগর বা খিরসাপাত ২৫ মে থেকে নামিয়ে হাটে তুলতে পারবেন বাগানমালিক ও চাষীরা।


এ ছাড়া ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া, ১৫ জুন থেকে ফজলি, ১০ জুন আম্রপালি এবং ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা ও বারি আম-৪ নামানো যাবে। ১০ জুলাই থেকে গৌড়মতি এবং ২০ আগস্ট ইলামতি আম নামানো যাবে। কাটিমন ও বারি আম-১১ সংগ্রহ করা যাবে সারা বছর।


রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘গত বছর রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আম বাগান ছিল। ১ হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে বেড়ে জেলায় এ বছর ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। চলতি বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ১৩ দশমিক ২০ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জেলায় এ বছর মোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে। চলতি বছর ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি, লক্ষ্মণভোগ, তোতাপুরি (স্থানীয় জাত) রপ্তানি করা হবে।’


চলতি বছর ভালো উৎপাদনের ব্যাপারে আশাবাদী আমচাষীরাও। তাদের মুখেও শোনা গেল রপ্তানি বৃদ্ধি সম্ভাবনার কথা। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আম চাষী শফিকুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, ‘এ বছর ২শ’ বিঘা জমিতে আমের বাগান করেছি। সব মিলিয়ে বাগানে ১০০টি আম গাছ রয়েছে। নিজের আম বাগানের পাশাপাশি কিছু বাগান লিজ নিয়েছি।’


চলতি বছর আমের ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে জানান, ইতোমধ্যে বাগান থেকে বায়াররা এসে গুটিজাতের আম ইংল্যান্ড ও ইতালি রপ্তানি করেছে। আশা করি এবার গতবারের তুলনায় রপ্তানি বেশিই হবে।’


রাজশাহীর বানেশ্বর হাটের আমের আড়ৎদার ও মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে আম কিনি। প্রক্রিয়াজাত করে রাজধানীর কারওয়ান বাজার আড়ৎসহ বিভিন্ন জেলায় আম পাঠানো হয়। বাজারে এখনো কোনো ভালো জাতের আম আসেনি। এক সপ্তাহ পর আম বেচাকেনা শুরু হবে।’


রাজধানীর কারওয়ান বাজার সোনার বাংলা বাণিজ্যালয়ের সত্ত্বাধিকারী মো. মাহবুবুল আলম বাবুল বিবার্তাকে বলেন, ‘আমরা মূলত আম ব্যবসাীয়দের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে কমিশনে বিক্রি করে থাকি। বাজারে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, রংপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আম আসে। প্রতিদিন শতাধিক ট্রাকে আম লোড করে ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোতে পাঠানো হয়।’


উত্তর কারওয়ান বাজার আদর্শ ফল ব্যবসায়ী আড়ৎদার ও মালিক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক মো. ফিরোজ হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ‘বাজারে গত বছর দিনে ২০ টনের বেশি আম বিক্রি হয়েছে। ভরা মৌসুমে ১৮’শ টনের বেশি আম বিক্রি করা হয়। এ বছরে দিনে ২৫ টনেরও বেশি আম বিক্রির সম্ভাবনা দেখছি।’


অপরিপক্ক আম নামানো ও অসুদাপায়ে বিক্রি, কৃষকের নায্যমূল্য পাওনা নিশ্চিতকরণ এবং কেমিক্যাল মেশানো হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। সেই সঙ্গে নিরাপদ আম বিপণন নিশ্চিত করতে মাঠে থাকবে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মনিটরিং সেল।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম সফিকুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, ‘ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এবছরও বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। বিশেষ করে আমের মৌসুম চলাকালে তা অব্যাহত থাকবে।’


বিবার্তা/বিদ্যুৎ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com