পহেলা বৈশাখ : সর্বজনীন উৎসব উদযাপনের একাল-সেকাল
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৩
পহেলা বৈশাখ : সর্বজনীন উৎসব উদযাপনের একাল-সেকাল
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা সনের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরের প্রথম দিনটি নানান আয়োজনে বরণ করা হয়। বছরের প্রথম দিনে গ্রামবাংলায় মেলা, ব্যবসা-বাণিজ্যে পূর্বের বছরের হিসাব চুকিয়ে নতুন বছরে নতুন খাতা খোলার 'হালথাতা'র আয়োজন দীর্ঘদিনের। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন এসব আয়োজন আর আগের মতো নেই।


সম্রাট আকবরের হাতে বাংলা ধরে সনের প্রবর্তন হয়। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায়
করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের হিসেবে গণনা হওয়ায় তা এ অঞ্চলের ঋতুবৈচিত্র ও কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। ফলে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।


বাংলা সনের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করত। ব্যবসায়ীরাও তাদের বাকির হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ক্রেতা বা গ্রাহককে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করাতেন, যা হালখাতা নামে পরিচিত। বিশেষকরে যে সব অঞ্চলের মানুষ এখনও কৃষিপণ্যের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এখনও প্রথাটি প্রচলিত আছে। আর স্বর্ণকাররা এখনো হালখাতার দিয়ে নতুন বছরের ব্যবসা শুরু করে।



এভাবেই পহেলা বৈশাখ বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। শ্বাশত বাংলার উৎসব পহেলা বৈশাখ নিয়ে সর্বজনীন উৎসাহ-উদ্দীপনা সবসময়ই রয়েছে বাঙালির। সময়ের আবর্তে এটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।সরকারও বাঙালির এই উৎসবে বিশেষ ভাতা দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেই থাকেউৎসবের আমেজ।রঙ-বেরঙের নতুন পোশাক পরে, নানান রকম দেশীয় খাবারের আয়োজন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পহেলা
বৈশাখকে বরণ করে নেয় বাঙালি মাত্রই।


পহেলা বৈশাখের উদযাপন আগে কেমন ছিল?বর্তমানে যেভাবে উদযাপন হয় তার সাথে পূর্বের পার্থক্য কতটুকু জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিবার্তাকে বলেন, উৎসব মানুষের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী পালিত হয়।কাজেই সময়ের সাথে সাথে এই উৎসবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। উপকরণের পরিবর্তন এসেছে।আগে একসময় গ্রামে-গঞ্জে রাস্তা-ঘাট ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না- তারপরও খালি মাঠে, ধান ক্ষেতে বা গাছের নিচে বৈশাখী মেলা বসত। এখন উপজেলা পর্যায়েও আলোর বাতি অর্থাৎ বিদ্যুতের আলোতে বৈশাখী মেলা হয় আগে হারিকেন এবং হেজাক লাইট দিয়ে অনুষ্ঠান হতো।


তিনি বলেন, এখন আলোর সম্ভারে অনুষ্ঠান হয়। আগে বৈশাখী মেলা হত মাঠে-ঘাঠে। এখন বৈশাখী মেলা একটা নির্দিষ্ট প্রাঙ্গণে হয়,যেমন ঢাকাতে চারুকলা, বাংলা একাডেমিতেও ছোট আকারে হয়। উপজেলা ও গ্রামে-গঞ্জেও এ মেলা হয়। তবে তার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, আয়োজনগত পরিবর্তন। আগে যেমন গ্রামে-গঞ্জে, আমাদের ছোটবেলায় একটা সিদ্ধ আলু বা একটা ডিম খেয়েই খুশি হতাম। আর এখন তো খাদ্যভ্যাসেরও পরিবর্তন হয়েছে।



গোলাম কুদ্দুছ বলেন, বৈশাখী মেলায় আগে বায়েস্কোপ দেখনো হতো।সেখানে দেশের নানা ঐতিহ্য তুলে ধরা হতো। মেলায় বাঙা‌লি সংস্কৃ‌তি ফু‌টিয়ে তোলা হত। এছাড়াও মেলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলরনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি আয়োজন থাকতো। এখন মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। ধীরে ধীরে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে।


রাজধানী ঢাকায় রমনা পার্কের বটমূলে বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানানো হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।


সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের অনুষ্ঠান সমন্বয় সহকারী উজ্জ্বল কুমার মালাকার বিবার্তাকে বলেন, ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানানো হবে। সকাল ৬টা বেজে ১৫ মিনিটে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হবে। উপস্থিত থাকবেন সনজীদা খাতুন। ১০টি দলীয় ও ১১টি একক গান এবং ২টি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেওয়া হবে।



পহেলা বৈশাখের একটি আবশ্যিক অংশ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে নিদৃষ্ট পথ প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় নানা শিল্পকর্মের মাধ্যমে আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলাসহ এবং বিশ্বশান্তির জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সে মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণির প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে ইউনেস্কো।


তবে সাম্প্রতিক সময়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, দেশের ভেতরে ও বাইরে মৌলবাদী শক্তি যারা আছে, তারা এর বিপক্ষে কথা বলছে। আমার ধারণা এগুলো আগেও ছিল। তখন হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার এত প্রচার ছিল না বলে আমরা জানতে পারিনি। এরকম কিছু আপত্তি সবসময় ছিল। এবারও আইনি নোটিশের মাধ্যমে এটাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শন পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা অবশ্যই হবে।


তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমরা দেখেছি একটা অংশ আপত্তি করেছে।ভাষা আন্দোলনের সময়ও বলা হলো, বাংলা হিন্দুদের ভাষা, উর্দুতে কথা বলব বলে স্লোগান দেওয়া হলো। কারণ হিসেবে বলা হলো, উর্দুর সাথে আরবি ও ফারসি বর্ণমালার সাথে মিল আছে। কাজেই উর্দু হচ্ছে আমাদের পবিত্র ভাষা। ওই শ্রেণিটাই এখনো এ দেশের বিপক্ষে কাজ করছে। তারা শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সব জায়গায় বিরোধিতা করে আসছে। শুধু ইসলাম ধর্মের নয়, যেকোনো ধর্মের গোড়া লোকদের মূল টার্গেট হচ্ছে বিভাজন। অন্য ধর্মের
লোকদের বিভাজিত করে শত্রু বানানোই তাদের লক্ষ্য। তারপরেও আমি দেখছি, প্রতিবছরই আমাদের এই আয়োজনে অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই বছর তো সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, স্কুল-কলেজগুলোতে এটা করতে হবে। এটা তো একটা বিরাট অগ্রগতি।



বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বিবার্তাকে বলেন, আমাদের আবহমান সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখ। বৈশাখের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন। কেউ ঋণগ্রস্ত হলে বা কারও বাকি থেকে থাকলে হালখাতার সময় সেটা ফেরত দিতে হতো। এটা বাঙালির একটা অন্যতম উৎসব।


ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন পহেলা বৈশাখে বিশাল মাঠে বৈশাখী মেলা হতো। সেই মেলায় নানা রকম খাওয়ার আয়োজন করা হতো। এ ছাড়াও বায়োস্কোপের মাধ্যমে বাঙালির নানা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরা হতো। এখন এগুলো আমাদের জীবনে অতিথিয়ানা মনে হলেও এসব আমাদের চালু করা উচিত- বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরা দরকার। বাঙালি জাতির ইতিহাসে পহেলা বৈশাখ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করেন ড. কায়কোবাদ। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির আবহমান সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এনএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com