বঙ্গবাজারে আগুন: চৌকিতে নতুন স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসায়ীরা
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৪৮
বঙ্গবাজারে আগুন: চৌকিতে নতুন স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসায়ীরা
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

তৈরি পোষাক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটে ৩৫ বর্গফুটের দু'টি দোকান ছিল তার। ৩ এপ্রিল রাতেও দুই দোকানে অন্তত ১০ লাখ টাকার কাপড় আর ক্যাশে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু পরদিন সকালে মার্কেটে এসে ছাই ছাড়া আর কিছুর দেখা পাননি।


বঙ্গবাজারে লাগা সর্বনাশা আগুন ১০ বছর ধরে ব্যবসা করা সাইফুলকে সর্বশান্ত করে পথে নামিয়ে দিয়েছে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটে বুধবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে জুনায়েদ গার্মেন্টস নামে ২০৯০ ও ২০৯১ নম্বর দোকান যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই ৫ ফুটের একটি চৌকি নিয়ে বসে আছেন তার ভাই তাজুল ইসলাম বাচ্চু। চৌকির ওপর কিছু কাপড় রাখা। বাচ্চু বিবার্তাকে বলেন, আগুনে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ঈদের সিজনে নতুন কাপড় তুলছিলাম। ক্যাশে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিল, পরদিন এসে পেমেন্ট দেয়ার কথা। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, এক আগুন সব শেষ করে দিছে।  


চৌকিতে কত টাকার মালামাল আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০ হাজার টাকার মালামাল নিয়া বইছি। আমাগো পাইকারি ব্যবসা। এহন কিছুই করার নাই। আল্লাহর উপর ভরসা কইরা খুচরা বিক্রিতে নামছি। ঢাকার আশেপাশের ব্যবসায়ীরা আছে, তাগো কাছে যদি কিছু বেচা যায়- এই আশায় আছি।


শুধু সাইফুল বা বাচ্চু নয়; বঙ্গবাজারে খোলা আকাশের নিচে এখন তাদের মতো হাজারো ব্যবসায়ী নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চৌকিতে ব্যবসা নিয়ে বসেছেন।


বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে চারটি ইউনিট। এর একটি গুলিস্তান হকার্স মার্কেট। এই মার্কেটে ৩০ বর্গফুটের দুটি দোকান ছিল মো. শাহজাহানের। শোভা গার্মেন্টস ও সাফা মারওয়া গার্মেন্টস। এছাড়া একটি গোডাউনও ছিল শাহজাহানের। তিনি বিবার্তাকে বলেন, দোকান-গোডাউন মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার কাপড় ছিল। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে চৌকি পেতে নিজের পজিশন ধরে রেখেছি। এখানে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মাল আছে। তবে এটাই সান্ত্বনা যে, নিজের জায়গায় বসতে পেরেছি।



গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের হাজারো দোকানপাট অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন টিন, কাঠ ও লোহার কাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে চারটি মার্কেট। আগুনে এই কমপ্লেক্সের বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্থান হকার্স মার্কেট, মহানগরী হকার্স মার্কেট এবং আদর্শ হকার্স মার্কেট সম্পূর্ণরূপে ভষ্মীভূত হয়। উত্তর দিকের মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের অধিকাংশ দোকান ভষ্মীভূত হয় ও বাকিগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া সাততলা বিশিষ্ট এনেক্সকো টাওয়ারের দোকানগুলোরও ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের রাস্তার পশ্চিম দিকের বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট-২ ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স সংলগ্ন কিছু দোকানও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।


বুধবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে সরেজমিন বঙ্গবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যাতে চৌকি বিছিয়ে ব্যবসা করতে পারেন সেজন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বালু ও ইট বিছিয়ে প্রস্তত করা হয়েছে বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্থান হকার্স মার্কেট। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ চৌকি বসিয়ে বেচাকেনা শুরু করেছেন। আগুনে পোড়ার আগে যে সিরিয়ালে দোকান ছিল সেই সিরিয়ালে কাঠের চৌকি বসিয়েছেন তারা।


তীব্র রোদের কারণে কেউ কেউ মাটিতে ছাতা পুঁতে নিয়েছেন। আপাতত চৌকি নিয়ে ব্যবসায় বসলেও তারা জানালেন, এখনো বেচাবিক্রি শুরু হয়নি। এছাড়া বাকি দু'টি ইউনিটে বালি ফেলা ও ইট বিছানোর কাজ করছেন করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা। মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের অংশ থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। এই অংশে এখনো কিছু কাপড় পুড়তে দেখা গেছে। আর ওই মার্কেটের অক্ষত অংশে ব্যবসায়ীরা আবারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর চেষ্ঠা করছেন। আবার কেউ কেউ ফুটপাতে চৌকি নিয়ে বসেছেন।


বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা আর পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২২২ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।


ডিএসসিসি ৮ সদস্যের কমিটি মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী, ব্যবসায়ী, দোকান মালিক-কর্মচারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।


তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। মহানগর কমপ্লেক্সের সুমি গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মোশারফ হোসেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আগুনে আমার ২৮ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। সবমিলিয়ে হাজার কোটি টাকা পুড়েছে। আর কেউ বলছে ২-৫ লাখ টাকা নষ্ট হইছে।


তিনি বলেন, গত তিনদিন হলো দোকানে কিছু মাল নিয়ে বসেছি। বেচাবিক্রি একদম নাই। আজ (বুধবার) সারাদিনে একজন কাস্টমার এসেছে। ৬০০ টাকা বিক্রি করেছি।


মহানগর কমপ্লেক্সের পুড়ে যাওয়া পেছন অংশে দোকান ছিল মো. তুহিন হাওলাদারের। বুধবার সেই অংশে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া দোকানের একটি অংশের কিছুটা অক্ষত আছে। সেই অংশে কিছু মালামাল তুলেছেন তিনি। তুহিন বিবার্তাকে বলেন, আমার গোডাউনসহ দোকানের ৩৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। কোনো সাহায্যও পাইনি, কেউ নামও নেয়নি। দাঁড়াতে তো হবে, তাই দোকানে (বিসমিল্লাহ গার্মেন্টস) কিছু মাল তুলে বসেছি। দিনে বসি তাও অন্ধকার। এখানে কে আসবে?


চৌকিতে কাপড় নিয়ে ফুটপাতে বসেছেন মো. সোহেল। মহানগর কমপ্লেক্সের পেছনের অংশে সোহেল গার্মেন্টস, সি-১২২ নম্বর দোকান ছিল তার। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ২০ লাখ টাকার মাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পিস মালও বের করতে পারিনি। কারো কাছে কোনো সাহায্য পাইনি। দুই দিন হলো এখানে চৌকিতে কাপড় নিয়ে বসেছি।


বঙ্গবাজার এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী চৌকিতে কাপড় নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও অনেকে বসার জায়গা পাচ্ছেন না। এস এম টি স্পোর্টসের মো. নজরুল বিবার্তাকে বলেন, দোকান একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বসারও জায়গা নেই। কিভাবে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠব আল্লাই ভালো জানেন।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com