সরকারি-বেসরকারিসহ সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবি দীর্ঘ দিনের। এ দাবিতে চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। কিন্তু সেই দাবি আদায় হয়নি এখনো। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ চাকরির বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে এ বিষয়টি। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করা এই চাকরিপ্রার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে ফের মাঠে নামার কথাও জানিয়েছেন।

জানা যায়, আগামী ১৮ ই মার্চ (শনিবার) রাজধানীর শাহবাগে ৩৫ বয়সসীমা দাবিতে আন্দোলন করবে চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা। 'চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির' ব্যানারে হবে এই আন্দোলন। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তারা প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে। চলছে তাদের গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও। সারাদেশ থেকে এরই মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে।

এরআগে শনিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুর ২ টায় একই দাবিতে শাহবাগে শিক্ষার্থী সমাবেশ করেছে তারা। তার আগে রবিবার (২২ জানুয়ারি) একই দাবিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি।

সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যনিবাহী সংসদের আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ এবং সদস্য সচিব মোহাম্মদ রাসেল স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত চাকরি প্রার্থীরা বিগত প্রায় ১০ বছর যাবৎ সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ বছরে উন্নীতকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এর পাতা ৩২ এ- শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অনুচ্ছেদে বলা আছে, "সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরীখে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।" অথচ এই দাবি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।

তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়,
২০১১ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসরের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করে ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। এদিকে চাকরি শেষে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে অনেক সময়, যা স্বাভাবিক চাকরি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশনে (বিসিএস) আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর হলেও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে (বিজেএস) আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর, সরকারি নার্সিং এ ৩৫ বছর এবং বেসরকারি স্কুল/কলেজে ৩৫ বছর। ফলে দুঃখজনক হলেও সত্যি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংস্থাগুলো তাদের চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা সরকারি মানদন্ড অনুযায়ী ৩০ বছরকেই অনুসরণ করে। বাংলাদেশের জাতীয় যুব নীতিতে ১৮-৩৫ বছর বয়সীদের যুবক বলা হলেও ৩০ বছর হলেই তাদেরকে চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।

তথ্য পর্যালোচনা করে আরও জানা যায়,
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আজ থেকে ৩২ বছর আগে ১৯৯১ সালে ২৭ বছর থেকে ৩০ বছরে উন্নীতকরণ করা হয়, যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৭ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর হলেও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। বিশ্বের ১৬২টি দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর, কোনো কোনো দেশে তা উন্মুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোর মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিভিন্ন রাজ্য ভেদে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫-৪৫ বছর, মালদ্বীপে ৪৫ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৩৫ বছর,নেপালে ৩৫ বছর, আফগানিস্তানে ৩৫ বছর। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র বাংলােদেশ এবং পাকিস্তানেই চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর।

৩৫ বয়সসীমা দাবিতে আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন,কোভিড-১৯ মহামারির সময় প্রায় সকল প্রকার চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি/পরীক্ষা বন্ধ ছিল। পৃথিবীর অনেক দেশ চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর বা তার বেশি থাকার সত্ত্বেও করোনা মহামারির কারণে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আরো ২-৩ বছর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ৭১ বার বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিটি উত্থাপিত হয়েছে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি লিখিত ভাবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য সুপারিশ করলেও কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই লক্ষ লক্ষ চাকরি প্রার্থীদের প্রাণের দাবি অনতিবিলম্বে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হোক।

চাকরিতে আবেদনের ফি কমানোর দাবি জানিয়ে তারা বলেন, চাকরির আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে (১ম শ্রেণীতে ২০০ টাকা, ২য় শ্রেণীতে ১৫০ টাকা, ৩য় শ্রেণীতে ১০০ টাকা, ৪র্থ শ্রেণীতে ৫০ টাকা)। প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকির উদ্যোগ নিতে হবে। একই তারিখে একই সময়ে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না।

'চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি' প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাবি জানিয়ে বলেন,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্মৃতি বিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদে বঙ্গবন্ধুর নামে বঙ্গবন্ধু ল’ কমপ্লেক্স (বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং একটি ম্যুরাল) স্থাপনের দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৩৫ বছর বয়সসীমা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদের আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ বিবার্তাকে বলেন, চাকরিতে আবেদনের সময় ন্যূনতম ৩৫ বছর করা এখন অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি, সময়ের দাবি। পূর্বের সেশনজট, অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং করোনা মহামারির কারণে নষ্ট হওয়া বছরগুলোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ন্যূনতম ৩৫ করা দরকার।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বয়সসীমা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বয়সসীমা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যা গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচারও হয়েছে। অথচ এরপরেও চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের এই দাবি কেন পূরণ হচ্ছে না, সেটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।

স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়ে শরিফুল হাসান শুভ বলেন, আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি আমাদের দাবির বিষয়গুলো খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরবেন বলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এখন পর্যন্ত দাবি পূরণে কোন আশ্বাস পাইনি। যা আমাদের হতাশ করেছে।

সামনের কর্মসূচি জানিয়ে তিনি বলেন, এখনো আমাদের দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর কর্মসূচি চলছে। এছাড়া আগামী ১৮ মার্চ শাহবাগে আমরা শিক্ষার্থী সমাবেশ করবো। মোটকথা,আমাদের দাবি একটাই, তা হলো চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করতে হবে। এটা আমাদের যৌক্তিক দাবি এবং সময়ের দাবি। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।

সংগঠনটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রাসেল বিবার্তাকে বলেন,করোনাকালীন সময় ৩ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ২-২.৫বছর হারিয়ে গেছে।দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের যেসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা শেষ করতে ২৬-২৭ বছর লাগে, সেসব শিক্ষার্থীর জীবনে যখন ভয়াবহ মহামারী হানা দেয় তখন তারা চাকরিতে আবেদনের বয়স পেয়েছে মাত্র ১-২ বছর। আর যাদের বয়স ২৮ ছিল তারা কিন্তু চাকরির বয়স হারিয়েছে । ফলে ৩০এর শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার কারণে এই সকল ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জীবন, জীবিকা, সামাজিক মর্যাদা আজ হুমকির সম্মুখীন। তারা আজ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে।

৩৫ বয়সসীমা করার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ মস আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে তার যৌক্তিকতা আছে। আশা করি, এই বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বিবেচনা করা হবে। একজন সাধারণ নাগরিক ও একজন অভিভাবক হিসেবে আমি মনে করি, ২০২০ সালে কোভিডের কারণে যেসকল সার্কুলার হয়নি বা এখন পদশূন্য রয়েছে সে সার্কুলারগুলো অতিদ্রুত দিয়ে দেয়া উচিত। আর এই বিজ্ঞপ্তিগুলো সময়মতো দেয়া হলে, আগে যারা আবেদন করতে পারতো তাদেরকে এই সময়েও সুযোগ দেয়া উচিত। এখন বিজ্ঞপ্তি গুলো দিয়ে দেয়া হলে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পরে নেয়া হলেও যারা ৩০ বছরের বেশি বয়স অবস্থায় আবেদন করেছে আর যারা ৩০ এর নিচে আবেদন করেছে উভয়কে যোগ্যতার মাপকাঠির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা উচিত।

তিনি বলেন, এটা ঠিক যে চাকরির পদ এর তুলনায় পরীক্ষার্থী অনেক অনেক গুণ বেশি। এরপরেও বিভিন্ন সংকটের কারণে যারা বয়সের কারণে আটকে যাচ্ছে, তাদের উদ্ধার করা প্রয়োজন।
চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে চাকরিপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছেন, এ বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করছে কি-না জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মো: রেজাউল আলম বিবার্তাকে বলেন, দেখুন- এ বিষয়ে আমি জানি না।

৩৫ বয়সসীমা দাবিতে চাকরিপ্রার্থীদের ফের মাঠে নামার বিষয়ে অবগত করে এই বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভাবনা জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, আমার জানা মতে এখনো পর্যন্ত এই ধরণের কোন বিষয় নেই, যেটা নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারি।

বিবার্তা/রাসেল/এসবি