মহেশখালী প্যারাবনে ১০ হাজার বৃক্ষ নিধন, বেদখল ২৫০ একর জমি
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:১৭
মহেশখালী প্যারাবনে ১০ হাজার বৃক্ষ নিধন, বেদখল ২৫০ একর জমি
তাফহীমুল আনাম, কক্সবাজার
প্রিন্ট অ-অ+

কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবৈধ চিংড়িঘের করতে কাটা হয়েছে বন বিভাগের প্যারাবনের প্রায় ১০ হাজার বাইন গাছ। দখল হয়েছে ২৫০ একর বনভূমি। বন বিভাগ, পুলিশের অভিযানেও থামানো যাচ্ছে না ম্যানগ্রোভ ধ্বংসকারী ভূমি দস্যুুদের। গত ১০/১৫ দিনে প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধও নির্মাণ করেছে তারা। ফলে বন ছাড়া প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধিত হয়েছে ব্যাপক।


মহেশখালী হোয়ানক ইউনিয়নের কলাগাজির পাড়া বগাচতর এলাকায় প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের তৈরি অব্যাহত থাকায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বন বিভাগ কয়েক দফায় অভিযান চালানোর পরও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস থামানো যাচ্ছে না। গত দুই সপ্তাহে প্যারাবনের প্রায় ২৫০ একর জায়গা দখল করে চিংড়িঘেরের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কাটা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার বাইন গাছ।


বন বিভাগ দিনের বেলায় পাহারা দেয়। কিন্তু গাছ কাটা হয় রাতে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বিবার্তাকে বলেন, এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় রাতে পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। এই সময়টাতে প্যারাবনের গাছ কাটা হচ্ছে।


এলাকাবাসী ও বন বিভাগ সূত্র জানায়, মো. এরশাদ নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে প্যারাবন দখল করা হচ্ছে। তিনি পার্শ্ববর্তী কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা। প্যারাবন উজাড়ে তাকে সহায়তা করছেন মো. নাজিম উদ্দিন, আবদুল মতিন ও শাহাদাত হোসেন নামের স্থানীয় তিন ব্যক্তি। শতাধিক শ্রমিক নিয়ে দিনদুপুরে তারা প্যারাবন কেটে খননযন্ত্রের (এক্সকাভেটর) মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। তবে বন বিভাগের অভিযানের মুখে এখন রাতের অন্ধকারে চিংড়িঘের নির্মাণের কাজ করছেন।


এব্যাপারে জানতে চাইলে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, প্যারাবন নিধনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশ চেষ্টা করছে। 


বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্যারাবন উজাড়ের খবর পেয়ে চলতি মাসে অন্তত তিন দফায় অভিযান চালানো হয়েছে। ১০, ১২ ও ১৪ জানুয়ারি পরিচালিত অভিযানে তিন দফায় চিংড়িঘেরের জন্য নির্মাণ করা বাঁধ কেটে দেওয়া হলেও দখলকারীরা আবার বনকর্মীদের অগোচরে বাঁধ নির্মাণ করেছে। শুরুতে দুই হাজার গাছ কাটা হলেও অভিযানের পর কাটা হয়েছে আরও প্রায় আট হাজার গাছ। 


চিংড়িঘেরের জন্য প্যারাবন দখলের ঘটনায় এরই মধ্যে আদালতে দুটি এবং মহেশখালী থানায় একটি মামলা করা হয়েছে বলেও জানান বন কর্মকর্তারা। মামলায় এরশাদসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।


উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের পক্ষ থেকে হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজির পাড়ার বগাচতর চিংড়িঘেরের পশ্চিমে অন্তত ৩০০ একর জমিতে প্যারাবন সৃজন করা হয়। পরে আশপাশের এলাকায় চর জেগে উঠলে সেখানেও পর্যায়ক্রমে বাগান করা হয়েছে।


বন বিভাগের স্থানীয় ঝাপুয়ার বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুল হক বিবার্তাকে বলেন, মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চিংড়িঘেরের জন্য বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। প্যারাবন দখল ও গাছ কাটার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়েছে। কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে চিংড়িঘেরের বাঁধও কেটে দেওয়া হয়েছে। 


বন বিভাগের মহেশখালীর গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা এস এম আনিসুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, চিংড়িঘেরের বাঁধ করতে গিয়ে প্যারাবনের ছোট-বড় প্রায় দশ হাজার বাইন গাছ কাটা পড়ায় বন বিভাগের প্রায় কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ভূমিদস্যুরা প্রথমে শ্রমিক দিয়ে প্যারাবন নিধন করে। পরে খননযন্ত্র দিয়ে সরকারি বনভূমি দখল করে অবৈধভাবে চিংড়িঘেরের বাঁধ তৈরি করেছে। একাধিকবার বাঁধ কাটার পর পুনরায় বাঁধ নির্মাণ করায় বন বিভাগের পাঁচ সদস্যের একটি টহল দল সেখানে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ প্রনব চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম গতকাল ২১ জানুয়ারি, শনিবার ম্যানগ্রোভের ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন কালে বনকাটার ধ্বংসস্তূপ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেন তারা। শুধু যে বন কেটেছে তা নয়, সাথে সাথে বাঁধও নির্মাণ করেছে ভূমিদস্যুরা। বন ধ্বংস ছাড়াও প্রাণ প্রকৃতি জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। তিনি এ প্রতিবেদককে আরো বলেন, যারা এ কাজের সাথে জড়িত তাদের ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।


চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবদুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যেখানে বন কাটা হচ্ছে, জায়গাটি অত্যান্ত দূর্গম, তাই সার্বক্ষণিক বনকর্মীরা উপস্থিত থাকতে পারছে না। কারণ দিনেরবেলায় পাহারা বসানো হলে রাতে এসে তারা বন কাটে এবং বাঁধ নির্মাণ করে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া প্রভাবশালী বনখেকোদের দমন করা অসম্ভব। তারপরও আমরা মাত্র ৬/৭ জনের একটি বনকর্মী টিম সেখানে দিবারাত্রি পাহারা বসিয়েছি- বন ধ্বংসকারীদের থাবা থেকে বন রক্ষার জন্য। ইতিমধ্যে আধা কিলোমিটার বাঁধও কাটা হয়েছে। তারপরও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংসকারীরা খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।


কক্সবাজার পরিবেশ আন্দোলন বাপার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, এভাবে একের পর এক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ অব্যাহত থাকলে উপকূলের বা মহেশখালী দ্বীপের রক্ষাকবচ বলতে কিছুই থাকবে না। কারণ, মহেশখালীতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়নের বহু মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংসের ফলে দ্বীপের অস্তিত্বই যদি বিলীন হয়ে যায়, তাহলে এসব উন্নয়ন মানুষের কি কল্যাণে আসবে? তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবল থেকে জানমাল রক্ষা করার জন্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট অক্ষত রাখতে হবে। প্রয়োজনে দেশের আইন পরিবর্তন করে হলেও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংসকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। এব্যাপারে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পরিবেশবাদী এই নেতা।


বিবার্তা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com