সড়ক বিভাজক সংস্কার; জনজীবনে হন্তারকের ভূমিকায়
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৫৫
সড়ক বিভাজক সংস্কার; জনজীবনে হন্তারকের ভূমিকায়
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

দুই তিন জন শ্রমিক মাঝ সড়কে দা-কুড়াল নিয়ে কাজে ব্যস্ত। কেউ দা দিয়ে গাছের ডাল কাটছেন, কেউ কুড়াল দিয়ে গাছের গোড়া কাটছেন, যে যেভাবে পারছেন গাছ কাটছেন। যেন সড়কের মাঝখানে গাছ কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। রাজধানীর সাত মসজিদ রোডের চিত্র এটি। সড়ক বিভাজক সংস্কারের জন্য এসব গাছ কাটা হচ্ছে। এতে ইট-পাথরের শহরে সবুজ যেমন কমে আসছে তেমনি পরিবেশও হুমকির মুখে পড়ছে। অথচ চাইলেই গাছগুলোকে রক্ষা করে সড়ক বিভাজক সংস্কার করা যেত।


পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সারা দেশের তুলনায় রাজধানীতে গাছের পরিমাণ অনেক কম। যে পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছে, সে পরিমাণ রোপন করা হচ্ছে না। একটি উপযুক্ত গাছ যথোপযুক্ত গঠন হলে তখন ওটাকে সংরক্ষণ করে কিভাবে সড়কের পুনর্বিন্যাস করা যায়, সেটি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু হচ্ছে ঠিক উল্টোটি।



সিটি করপোরেশন বলছে, উন্নয়ন কাজ করতেই কাটা হচ্ছে এসব গাছ। যেমন কাছ কাটা হচ্ছে তেমন রোপনও করা হচ্ছে। কাজ সম্পন্ন হলে নতুন ডিভাইডারের মধ্যে যতটুকু সম্ভব হয় সবুজায়ন করা হবে।



তথ্য বলছে, কোনো এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ২৫ শতাংশ গাছ থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় আছে ৭ শতাংশেরও কম। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় নগরে বায়ুদূষণের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া মানুষের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার, তাও পাওয়া যাচ্ছে না গাছের অভাবে।


রাজধানীর সাত মসজিদ রোডে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অংশে সড়ক বিভাজকের সংস্কার কাজ চলছে। আগের বিভাজক ভেঙে নতুন বিভাজকের জন্য ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। আর এতে বিভাজকে থাকা সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। 



সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামন থেকে ধানমন্ডি-১৫ নম্বর পর্যন্ত বিভাজকের শত শত গাছ এরই মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটতে কাটতে জিগাতলার দিকে এগুচ্ছে শ্রমিকরা। রবিবার ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে গিয়ে দেখা যায়, গাছ কাটা হচ্ছে। ডালপালা ও গাছের কাটা অংশ বিভাজকের দু’পাশের সড়কে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও স্তুপাকারে জমা করে রাখা হয়েছে। 



দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাকে কিছু গাছ ও বস্তা তুলতে দেখা যায়। ছবি তুলতে গেলে গাড়িটি জিগাতলার দিকে চলে যায়। কেটে ফেলা গাছের ডাল রিকশায় তুলছিলেন মো.আব্দুল জলিল। পেশায় রিকশাচালক জলিল বিবার্তাকে বলেন, দেখলাম রাস্তাত মেলা ডাল পড়ি আছে। তাই ভাবলাম কিছু বাড়িত নিয়ে যাই। এসব ডালপালা দিয়ে চুলার খড়ি বানামু। খড়ির যে দাম কিনাই কষ্ট। তাই নিতাছি। 


শুধু ধানমন্ডি এলাকা নয়, রাজধানীর বাংলামোটর-মালিবাগ সড়কেও বিভাজকের সংস্কার চলছে। সংস্কার কাজ করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে সব গাছ। এসব গাছ কেটে সড়কের পাশে রাখা হয়েছে। সেখানে বিভাজক তৈরির জন্য কাজ করছেন আট-নয় জন শ্রমিক।


এসব গাছ কাটায় সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বাংলামোটরের বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা শহরে গাছের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এখন আবার উন্নয়নের নামে গাছ কাটা হচ্ছে। এসব গাছ না কেটে কাজ করা দরকার ছিল। একটা গাছ বড় হতে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। এসব গাছ কাটছে আবার কবে নতুন করে লাগাবে কে জানে?


ধানমন্ডি এলাকায় চাকরি করেন তানজিল আহমেদ। তিনি বিবার্তাকে বলেন, শহরে এমনিতেই গাছের যথেষ্ট অভাব। রোড ডিভাইডারে থাকা গাছগুলো কি দোষ করেছে? এগুলো না কেটেও তো ডিভাইডার সংস্কার করা যেত। এই যে গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে, আমাদের ক্ষতি করা হচ্ছে, এর দায় কার? যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে, নতুন করে চারা রোপণ করলে আগের অবস্থায় ফিরতে কয়েক বছর লাগবে।


ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) সহকারী অধ্যাপক ড. মো. মফিদুল আলম খান বিবার্তাকে বলেন, গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজন ছাড়ে। যা মানুষ গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। গাছ ছাড়া মানুষের এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা সম্ভব না। অথচ সড়কের ডিভাইডার সংস্কার করতে গিয়ে এসব গাছ কাটা হচ্ছে । যা আমাদের সবার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল গাছ না কেটে কিভাবে ডিভাইডার সংস্কার করা যায় তা ভাবা। তাই কাজ শুরুর আগেই পরিকল্পনা করা দরকার। সবার মতামত নিয়ে কাজ করলে কোনো সমস্যা হবে না।


এ নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) মেরীনা নাজনীন বিবার্তাকে বলেন, কাজের জন্য কাটা হচ্ছে গাছ। অন্য জায়গায় আমরা গাছ লাগাচ্ছি, কোথাও কাটতেছি। ডিভাইডার নতুন করে করলে তো গাছ রাখা সম্ভব না। কাজ শেষ হলে আবার গাছ লাগানো হবে। আপনি আমাদের স্যারের সাথে কথা বলেন। উনি আপনাকে ব্যাখ্যা করবে।


দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ বিবার্তাকে বলেন, ডিভাইডার করতে গিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু কিছু করতে হলে কিছু তো বিসর্জন দিতেই হয়। আমরা এই ডিভাইডার এখন বড় করছি। নতুন ডিভাইডারের মধ্যে সুন্দর করে যতটুকু সম্ভব হয় আমরা সবুজায়ন করে দিব।


সালেহ আহম্মেদ বলেন, ট্রাফিক ও সামগ্রিক বিষয় অ্যানালাইসিস করে আমরা মেয়র মহোদয়সহ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, সাত মসজিদ সড়কে এত ক্রসিং রাখা হবে না। যেখানে প্রয়োজন সেখানে শুধু  ক্রসিং থাকবে। এখন প্রত্যেকটা মোড়ে মোড়ে ক্রসিং, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।


এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে একাধিকবার কল করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।


নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বিবার্তাকে বলেন, পুরো বিষয়টাকে সংবেদনশীল হিসেবে দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ গাছ লাগানোর সময় যেমন সংবেদনশীল হওয়া দরকার। আবার সড়ক সম্প্রসারণ বা সংস্কারের সময় যদি একটি উপযুক্ত গাছ যথোপযুক্ত গঠন হয়ে যায়, তখন ওটা সংরক্ষণ করে কিভাবে সড়কের পুনর্বিন্যাস করা যায়, সেটি বিবেচনা করা প্রয়োজন।


ইকবাল হাবিব আরোও বলেন, মুশকিল হচ্ছে আমাদের হন্তারক মানসিকতা। এই হন্তারক মানসিকতার জন্য গাছের প্রতি অবিচার ঠেকানো যাচ্ছে না। আমরা ২৭ নম্বরেও একইভাবে সড়কের মাঝের গাছ কাটার মহোৎসব দেখেছিলাম। পরবর্তীতে আমরা ইন্টারমেনশন করার পর দেখা গেল যে, এই গাছগুলোকে রেখেও সংস্কার কাজ করা সম্ভব। পরে ২৭ নম্বরে অনেক গাছ বাঁচানো গিয়েছিল। কিন্তু এখন সাত মসজিদ রোডে এ কাজ কেনো করছে বা অন্যান্য জায়গায় কেনো করছে, এর উত্তর কর্তৃপক্ষই দিতে পারবে।


এসব কাজে সিটি করপোরেশনের অগ্রণী ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন নগরবিদ ইকবাল হাবিব। পাশাপাশি সড়কের মাঝখানে গাছ লাগাতেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, সড়কের মাঝে এমন গাছ লাগানো উচিত নয়, যে গাছ বাসযাত্রী অথবা গাড়ির জানালায় বেরিয়ে থাকা মানুষের হাত বা অঙ্গপ্রতঙ্গে আঘাত করতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমরা যখন গাছ লাগাই, তখন সবদিক বিবেচনা করি না। আবার যখন গাছ লাগিয়ে ফেলি সড়কে বা যেকোন স্থানে, তার পূর্ণবিন্যাসের জন্য সেগুলিকে হত্যা করতে এতটুকু হাত কাঁপে না।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com