নতুন বছরে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই, কিন্তু বইয়ের এই হাল কেন?
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৪৯
নতুন বছরে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই, কিন্তু বইয়ের এই হাল কেন?
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

পহেলা জানুয়ারি সরকার ঘোষিত বই উৎসব পালিত হয়েছে। তবে এই দিনে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যের সব বই হাতে পাননি, অন্যদিকে যারা নতুন বই পেয়েছেন তাদেরও অধিকাংশের বই নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানোর অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, এসব বইয়ে অস্পষ্ট ছবি, নরমাল সেলাই জানিয়ে বইয়ের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থী- অভিভাবকরা। এদিকে বিনামূল্যের সবগুলো বই সব শিক্ষার্থীরা কখন হাতে পাবেন, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মাসের মধ্যে সব শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে নতুন বই পেয়ে যাবেন।


শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) সকাল ১০টার পর নতুন বছরের পাঠ্যবই বিতরণের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে বিনামূল্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। পরে রবিবার (১ জানুয়ারি) দেশব্যাপী পালিত হয় বই উৎসব। এদিন মাধ্যমিকে বই উৎসব হয় গাজীপুরের কাপাসিয়া সদর উপজেলার কাপাসিয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। এদিকে প্রাথমিকের বই উৎসব হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।



জানা যায়, এবারের বই উৎসবে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৩ কোটি ৯১ লাখ ১২ হাজার ৩০০ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে ২ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রাক প্রাথমিক স্তরে ৬৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৪টি আমার বই এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক এবং ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির সর্বমোট ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৭টি পুস্তক বিতরণ করা হয়েছে।



তবে এই বিতরণে সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছায়নি বিনামূল্যের সব বই। কেউ কিছু বই পেয়েছেন, আবার কেউ কোন বই পাননি। তবে সব শিক্ষার্থীরা সব বই পাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। বই উৎসবের দিন তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবার প্রথম দিনে সব বই হাতে পাননি খুদে শিক্ষার্থীরা।আমাদের সব বই কাগজের অভাবে প্রেস থেকে দিতে পারিনি। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা সব বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারবো বলে আশা করি।


এদিকে বই উৎসবের দিন যারা নতুন বই পেয়েছেন তাদেরও অধিকাংশের বই মানহীন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের কাগজে ছাপানো, অস্পষ্ট ছবি, নরমাল সেলাইসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব বই। ফলে এসব বইয়ের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।


রাজধানীর উইলস লিটল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান রহমান সামি বিবার্তাকে বলে, বই উৎসবের দিন সব বই হাতে পাইনি। আমাদের বলা হলো বাকী বইগুলো পরে দেয়া হবে।এদিকে যে বইগুলো হাতে পেয়েছি সেগুলোও কেমন যেন! অন্যান্য বারের বইয়ের সাথে এবারের বইগুলোর অনেক পার্থক্য রয়েছে। মনে হয় একেবারে নরমাল কাগজে প্রিন্ট করা হয়েছে। বইয়ের ভিতরের ছবিগুলো ঝাপসা! এই বই বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। অথচ এসব বই আমাদের একবছর পড়তে হবে, ভাবা যায়?


মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা সুলতানা আঁখির অভিভাবক কামরুন নাহার বিবার্তাকে বলে, এই বছর কাগজের সংকট চলছে সেটা মানলাম। তাই বইগুলো আগের মতো হবে না সেটা আগে থেকে জানা ছিল। কিন্তু যেখানে ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকার কথা সেখানে নিউজপ্রিন্টেরনিম্নমানের কালো কাগজে বইগুলো করা হয়েছে। এতোটা নিম্নমানের বই এবার হয়েছে, তা বলে বোঝাতে পারবো না। কেন এমন হলো সেই বিষয়ে তদন্ত করা দরকার।


শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের এসব অভিযোগের সাথে সহমত শিক্ষকরাও। তারা বলছেন, এমনিতে এবার বই উৎসবের দিন সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে আমরা দিতে পারিনি। তার উপর বইও মানহীন হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এসব বইকে শিক্ষার্থীরা কতদিন টেকসই করাতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।


এ বিষয়ে রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা বই থেকে শিখে। কাজেই বই যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা ছাপানোর সময় কর্তৃপক্ষের কি মনে ছিল না? জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এরআগে অনেক প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপরেও নিম্নমানের বই দেয়া হয়েছে। যারা এসব করেছে, তাদেরকে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।



রাজধানীর সূত্রাপুরের দক্ষিণ মুহসেন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান বিবার্তাকে বলেন, এটা সত্য যে, এই বছর নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই তৈরি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা এসব বই নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাছাড়া বছরের মাঝামাঝি বই নষ্ট হলে নতুন করে দেয়াও কঠিন। ফলে বিনামূল্যের বোর্ড বইগুলো ভালো হলে সবার জন্য মঙ্গলজনক হয়।


সূত্র জানায়, এবার বই উৎসবে সব শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে এনসিটিবি কাগজের মানে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ৮৫ শতাংশের জায়গায় ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা দিতে বললেও প্রেসগুলো সেই কথা রাখেনি। ফলে মানহীন হয়ে গেছে বইগুলো। প্রথমদিকে কিছু প্রেস মানের দিকে নজর দিলেও শেষের দিকে এসে তারাও দায়সারা হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে বইগুলোতে।


খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, তৃপ্তি প্রেস, কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, টাইমস মিডিয়া লিমিটেড, সাগরিকা প্রিন্টিং প্রেস, হাওলাদার অফসেট প্রেস, ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, লেটার অ্যান্ড কালার, গাজীপুরের বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডসহ বেশ কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির নির্দেশনা অমান্য করে নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছেন।


নিম্নমানের বই দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী কাওসার উজ-জামান রুবেল বিবার্তাকে বলেন, নিম্নমানের বই অনেকে দিয়েছে। আর কাজ শুধু আমি একা পাইনি। এরবেশি কিছু বলতে চাই না। এনসিটিবির সঙ্গে কথা বলতে পারেন।


চলতি বছর মানহীন বইয়ের বিষয়ে অবগত করে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুৎফুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, টেন্ডারে প্রেসের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেয়া যায়, তার স্পষ্ট বর্ণনা আছে। কাজেই যেসব প্রতিষ্ঠান কারচুপি করে মানহীন বই করেছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।


তিনি বলেন, অনিয়মের দায়ে গত বছর ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি, এবারও হবে। তবে এবার হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের একটু মানবিক হতে হবে। এবার কতটুকু কালো তালিকাভুক্ত করতে পারব জানি না। তবে, জরিমানা করা হবেই।


নতুন বইয়ের মান নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বিবার্তাকে বলেন, টেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত মানের বই সরবরাহ করতে হবে। কোথাও নিম্নমানের বই পাওয়া গেলে পরিদর্শন টিম এনসিটিবি, মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে জানাবে। ফলে এর বাইরে বই সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই।


নতুন বইয়ের মান নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ৪ জানুয়ারি বলেন,এ বছর সেকেন্ডারি পাল্প ছাড়া কোনো পাল্প দেশে ছিল না। বিদেশ থেকেও কাগজ আনার সুযোগ ছিল না। আমাদের কাছে সেকেন্ডারি পাল্প ছিল তা দিয়েই বই ছাপাতে হয়েছে। আর সেটাতে বইয়ের মান একেবারেই খুব খারাপ হওয়ার কথা নয়। এ কাগজে উজ্জ্বলতা কিছুটা কম হবে।


তিনি বলেন, যেকোনো কিছু হলে আমাদের গেল গেল করে একটি রব উঠে যায়। কিন্তু সেটা কেন হল তা বিচার-বিশ্লেষণ করে কেন করতে হল বা কোথায় সমস্যা হল সেগুলো নিয়ে কেউ কোন মাথা ঘামায় না।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com