পাতাললোক
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ১৪:৫৭
পাতাললোক
ডাবলু লস্কার
প্রিন্ট অ-অ+

- কথা কইবি না। কাছে ফোন মোবাইল মানিব্যাগ যেডি আছে তাড়াতাড়ি বাইর কর নাহলি প্যাডের মইধ্যে ছুরিডি হান্দাই যাইবে।


দুইপাশ থেকে দুজন দুইহাত শক্ত করে ধরে আছে আর সামনে থেকে লম্বা মতো একজন পেটের উপর চাকু রেখে ধমক দিয়ে যাচ্ছে।


ব্যাপারটা ভালোই লাগে মনোজের। অনেক দিন হলো কেউ এত শক্ত করে তার হাত ধরে না। বিয়ের সময় মনিকা অনেক শক্ত করে হাত ধরে রেখেছিল। মনোজ মনিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল,


- ব্যাথা লাগে এত জোরে ধরলে।
- আরও জোরে ধরবো। সারাজীবন ছাড়বো না এই হাত, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল মনিকা।


কিন্তু অভাবের কাছে হার মেনেছে বাস্তবতা। মনিকা অনেক আগেই ছেড়েছে মনোজের হাত। অথচ কত স্বপ্ন ছিল দুজনের।
কুঁড়েঘর
মোটা কাপড়
মোটা ভাত এসব হলেও মনিকা সুখী হবে।


মনোজ বুয়েটে সিভিলে পড়ত।
এলাকায় সবাই জানত মনোজ বুলেট ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল ব্যাপার!


মনোজের মা আর বাবা বিশাল একটা গর্ব অনুভব করতো সব সময়।
ছেলে বুলেট ইঞ্জিনিয়ার!


অনেক স্বপ্ন ছিল মা-বাবার মনোজকে নিয়ে। ছেলে বুলেট ইঞ্জিনিয়ার। হয়তো লাখ লাখ টাকা ইনকাম করবে। একতলা দালান বাড়িতে হয়তো একদিন প্রাসাদ হবে।


কিন্তু সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ।
৩য় বর্ষের ২য় টার্ম পরীক্ষা আর পাশ করা হয় না মনোজের।


অনেক চেষ্টা করে। এর মধ্যে কয়েকবার পরীক্ষা দেওয়ার পর ডিসকোয়ালিফাই হয়ে ছাত্রত্ব বাতিল।


এলাকার সব থেকে ভালো ছাত্র ছিল সে। এডমিশন কোচিংয়ে ভালো ক্লাস নিতো।
কিন্তু সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অবস্থা খারাপ তার।


এর কয়েক বছর আগে থেকেই মনিকার সাথে পরিচয়। মনিকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী। মনিকার কাছে মনোজ ছিল স্বপ্নের মতো। মনিকা স্বপ্ন দেখতো একদিন মনোজ অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে তাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না।


কিন্তু মনোজ প্রচণ্ড হতাশায় পড়ে। দিন দিন সে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে বিয়ে দিয়ে দেয় মনিকার সাথে।
এক সময় মনোজের বাবা মা জানতে পারে সে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারেনি। মনিকাও বুঝতে পারে মনোজের দিয়ে কিছু হবে না। সেই শুরু। শুরু হয় এক নতুন অভিজ্ঞতা যেখানে শুধু ছিল হতাশা আর না পাওয়ার যন্ত্রণা।


গত তিনবছর যাবত সে সূত্রাপুরের রজনীকান্ত লেনের পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনের চিলেকোঠার একটা রুমে ভাড়া আছে। বাবা মা গত হয়েছে দুবছর আগে। এরপর মনিকা তাকে ছেড়ে গেছে একবছর আগে। আপন বলতে পাশে দাঁড়ানো মত আর কেউ নাই তার। ছাত্র অবস্থা থেকেই ক্লাস নিতো সে বিভিন্ন কোচিংয়ে। এখন নাকি তার ক্লাসে আনন্দ পায় না স্টুডেন্টরা তাই অধিকাংশ কোচিং তাকে আর ডাকে না।


কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন সেক্টরে সাইট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ নিয়েছিল।বেতন তেমন নেই বললেই চলে। কারন চাকরি টা তার ইন্টারমিডিয়েট পাশের সার্টিফিকেটে হয়েছিল। বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারা যখন তাকে ঝাড়ি মারতো তখন বুক ফেটে যায়। মনে হয় আবার যদি সুযোগ থাকতো বুয়েটে গিয়ে যেভাবেই হোক রাত দিন পড়ে বিএসসি টা পাশ করে ব্যাটাদের এই ঝাড়ির জবাব দিত। কিন্তু কপাল যে খারাপ হতে শুরু করেছে কিছুই আর করার নাই।


সূত্রাপুরের রজনীকান্ত লেনের এই চিলেকোঠার এক চিলতে মুরগির খোপের মতো ঘরটায় ওঠার পর প্রথম কয়েকদিন মনিকা কিছু বলেনি। কিন্তু ওর তো স্বপ্ন ছিল গুলশান বনানী না হোক কমপক্ষে মালিবাগের মতো জায়গায় থাকবে।
বারান্দায় বাগান করবে।
টিভি ফ্রিজ ওভেন।
আর বিকেলে এলোমেলো চুলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা।


বুয়েটে পড়ুয়া ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারের বউয়ের এমন স্বপ্ন থাকতেই পারে! কিন্তু মনোজের ক্ষেত্রে যে এমন হবে তা কি মনিকা জানতো? নাকি আবেগে?


চিলেকোঠার এই ঘরে পড়ে মরার মতো মেয়ে মনিকা না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের। নিজের মত বাঁচতে চাই সে। পাল্টে যায় মনিকার আচরণ। আসলে অভাবের সঙ্গী কেউ হতে চাই না। চলে যায় মনিকা।


মনিকাকে হারিয়ে অনেক ভেঙে পড়ে মনোজ। বাবা মাকে হারানোর পর পাশে থাকা মত শুধুই মনিকাই ছিল। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে অনেক হাতে পায়ে ধরেছে মনিকার। কিন্তু গলেনি মন একবিন্দু। মনোজ আশা করেছিল সর্ম্পকের বিয়ে তাদের হয়তো একদিন মনিকা ফিরে আসবে। কিন্তু হতাশার আর নিরাশার শেষ পেরেক বিধেছে সেদিন। মনিকা আবার বিয়ে করেছে অন্য ছেলেকে।


রজনীকান্ত লেনের এই চিলেকোঠার বাসাটাকে পাতালপুরী মনে হয় মনোজের। চারপাশে এত মানুষ অথচ তার সাথে কথা বলার জন্য একজনও নেই। এলোমেলো ঘরটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরাতন জামাকাপড়। ভাতের হাড়িতে পান্তাভাত পচে কেমন যেন একটা মাদকীয় গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিছু দিন আগে একটা ইদুর আসতো খাবারের খোজে। ইদানীং তাকেও আর পাওয়া যায় না। ইদুরটা বুঝতে পেরেছে এখানে যে বসবাস করে সে হয়তো জীবিত না।


অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে মনোজকে। কাজে মনোযোগী না। আসলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চক্রান্ত। সাদাসিধা মানুষ সে। ইট পাথরের আর সিমেন্ট এর মারপ্যাঁচ সে বুঝতে চাইত না তাই তো সে থাকলে বিল্ডিংয়ের গাঁথুনিতে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না সে কারণে হয়তো তাকে সরানো।


ঘর ছাড়তে বলা হয়েছে মনোজকে। কোথায় যাবে সে? রাতে কারেন্ট আসে না। অন্ধকারে আর কান্না করে না মনোজ। রাতে ঘুম না। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখে বুয়েটের সিভিল ভবনে পরীক্ষা দিচ্ছে। অনেক ভালো ছাত্র। অনেক স্বপ্ন তার। বড় বড় ভবন বানাবে। কিন্তু নিজেই দাড়াতে পারেনি ঠিক করে ভবন দাড়াবে কি করে।


বুয়েটে পড়ার সময় বুকটা ছাতার মত ফুলে থাকতো গর্বে। কিন্তু এখন বুকের মাঝখানে একটা বিশাল হতাশার গর্ত। মনে হয় সেই গর্তে একদিন সে বিলীন হয়ে যাবে।


মনোজ এখন আর কিছু আশা করে না। রঙচটা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবে মৃত্যু হলে হয়তো মুক্তি হবে তার। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে তিন ধরনের লোকের বসবাস। যারা অনেক সুখী সব কিছু আছে তারা স্বর্গলোকের বাসিন্দা যাদের কিছুটা অভাব আছে তারা মর্ত্যলোকের বাসিন্দা আর তার মতো যাদের কেউ নেই কিছু নেই তারা পাতাললোকের বাসিন্দা। এই পাতাললোকের বাসিন্দাদের দৈহিক মৃত্যু হয় না কিন্তু মানসিকভাবে এরা অনেক আগেই মারা যায়।


সেদিন সন্ধ্যায় ক্ষুধার কষ্টে আর থাকতে পারে না মনোজ। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বেরিয়ে পড়ে সে কোনো এক দোকান থেকে একটা কিছু বাকি করে খাওয়ার জন্য।
অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করে কিন্তু লজ্জায় আত্মসম্মানবোধে বাকি চাইতে পারে না কোন দোকানে।


অবশেষে রাতের দিকে বাসায় ফেরার পথে অন্ধকার ঘুপছির এই গলির মধ্যে তিনজন ছিনতাইকারী পথ অবরোধ করে দাঁড়ায় সামনে।


- দেন ভাই চাকুটা ভিতরে ঢুকায় দেন। এ পেটে অনেক ক্ষিধে। কিছু একটা পেটে গেলেই ক্ষিধে মিটবে।"
বলেই সামনের চাকু ধরে রাখা ছিনতাইকারীর হাত থেকে চাকুটা নিজের পেটের দিকে চাপ দিতে যায়।


- ধ্যাৎ, শালা পাগল।
বলতে বলতেই জনৈক ছিনতাইকারী দ্রুত চাকু সরিয়ে নেয় মনোজের পেটের সামনে থেকে ।
- ছাড় শালারে।
বলেই তিনজন মনোজকে ছেড়ে দিয়ে গলির দিকে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com