(১)
জবানবন্দি
এইযে বিভ্রমে কেটে যাচ্ছে অগ্নি-দুপুর
দিন হচ্ছে, হাওয়া দিচ্ছে--জলের পরমায়ু কমছে ক্রমশ...
অথচ কী নির্বিকারভাবে একটা নাতিদীর্ঘ জীবন
শিমুল তুলোর মতো উড়িয়ে দিলাম।
না বসলাম দুূদণ্ড পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, না জলের ভেতর কোনো ডুবসাঁতার!
কীর্তনখোলার জল কতইনা তীব্রভাবে টেনেছিলো
সেই মন হারানোর বিকেলবেলায়! কী এমন ক্ষতি হতো
যদি সেই বিকেলটা এক অর্থহীন ডুবসাঁতারে কাটতো!
কেটেই যেতো...
বুকের ভেতর ছলাৎনদীর ঢেউ ; কাটে না দিন
কাটে না সময়--
পৃথিবী নিশ্চুপ হলে তেজি বাতাসের মতো
ধাবমান অশ্বের মতো বুকের ভেতর হাওয়া ছোটে...আহ!
রাত্রির বুননে আঁধার ছেনে রুশী নারীর মতো রচনা করি মাতাল গন্ধের হাস্নাহেনা। শুনেছি, হাস্নাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে। গতকাল রাতে স্বপ্নে একটা সবুজ সাপ শোবার ঘরের বিছানায় এসে বসেছিলো। অ-নেক সময় নিয়ে দেখছিলো আমায়। পাশ থেকে বেমক্কা কে একজন (কে, অন্ধকারে ঠিক ঠাহর পাইনি) এককোপে তিনটুকরো করলো সাপটিকে। সময়ের তিনটে কালকে দ্বিধা বিভক্ত করে ওর সবুজ চোখের মায়ায় আটকে আছি গত শতাব্দী থেকে...সে বুঝি তুমি ? সে বুঝি নিয়তি?
এভাবেই নিয়তি নামে সময়গুলো রূপক হয়ে বেঁচে থাকে মানুষের মুখে মুখে।
যেমন স্মৃতিগুলো পড়ে থাকে আলপথের করুণ বাতাসে --
খুব বেশি কতদিন আর মানুষ মনে রাখে ?
শোকের আয়ু বড়জোর সাড়ে তিনদিন
এ সত্য জেনে মৃত্যুতেও আমার ভয়হীন চোখ;
মিছেই মানুষ খুঁজে ফিরবে ভয়, স্বপ্ন!
ওখানে কে আছে, কেন আছে--
কেউ কি জানে? জানবে কখনো?
(২)
মন ভালো নেই
মেঘ ছুঁয়েছে ; মেঘের ডানায় লেগে আছে কার অভিমান? কালো চোখে কাব্যগাথা--
কে লিখেছে অশ্রুবয়ান?
আকাশ খালি ; জল ঝরছে
আজ আকাশের মন ভালো নেই।
পথে পথে শূন্যতারই খই ফুটছে মন ভালো নেই।
সারাবেলা ডেকে ডেকে ক্লান্ত যে কাক দাঁড়ে একা;
তারও যে আজ মন ভালো নেই।
উঠোনপাড়ে ঝোপেঝাড়ে বুলবুলিটা ভিজছে একা
কতকালের শ্যাওলা ধরা মরচে পড়া উঠোন বাঁকা
আজ উঠোনের মন ভালো নেই।
পথটাও যে ভারি একা ; অযুত-নিযুত বছর একা
আজ পথেরও মন ভালো নেই।
এই যে চরাচরজুড়ে আজ এত আশ্চর্য শূন্যতা!
শূন্য বারান্দা, শূন্য ঘরবাড়ি।
এত যে ডাকাডাকি, এত যে কড়া নাড়ি
কোথাও সাড়া নেই; নীরবতা বাড়াবাড়ি!
শোর নেই, সুখ নেই ; বুক জুড়ে কেবলই পাথর শূন্যতা
কারও আসার কথা ছিলো ; আসেনি।
বিষাদ ছুঁয়েছে বুক। লতানো বেদনার মতো দুঃখ ছুয়েছে চিবুক।
আজ সারাদিন জলের প্রপাত আজ সারাদিন বিষাদ ভারি
মনের ভেতর নাড়ছে কড়া-- আঁকছে বিষাদ শূন্যতারই--
আজ সারাদিন অশ্রুপ্রপাত! আজ মেঘেদের মন ভালো নেই। মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।
(৩)
বাঁচো
কেউ আর এখন কারও খোঁজ রাখে না
দিনগুলো ঝরে যায় শিউলিফুলের মতো
ভোরের শিশিরও উবে যায় অনিকেত রোদের তাপে
যে যার মতো চলে যায় মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী নদীর মতো ভুলে যায়।
জলের আখরে আঁকা হয় না কোনো প্রিয় মুখ
অনুভূতিগুলো বরফের মতো জমতে থাকে...
কুমার নদ, কৃষ্ণাদিয়া ডাকে-- চলনবিলের ডানকিনে মাছও...
বড়ফুপুর পোষা জিনের গল্পের ঝুলিতে জীবন এখন আর থেমে নেই, থাকে না-- মৌবনের ব্যস্ত রেসিপির মতো জীবনগুলো উড়ে যায়
নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের মতো কোথায় যে হারিয়ে যায়
কেউ তার হদিশটুকুও রাখে না--
আহা কোথায়? কোথায় হারালো বুকের ভেতর রাখা রুমাল? কে কেড়ে নিলো সজল নয়ন, কে মুছে দিলো মাথার দিব্যি? কেন আর কেউ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে না ফেরার অপেক্ষায়?
দিবসটিবস শেষ হলে নর্দমায় ফেলে দেওয়া ফুলের মতো
বহুমূল্য জীবনও ভেসে যায়; আশ্চর্য অবহেলায়
কেউ কেউ ফেরে না... শিমুল তুলোর মতো উড়ে যায়
শীত রাত ঘন হয় আর্দ্র অন্ধকারে ; কেউ ডেকে বলে না--
বাঁচো হে সুজন! একটাই নীলমণি একআনা জীবন
আহা! সবেধন নীলমণি একটা জীবন!
কখনো কখনো নিজেকেই ফেরাতে হয়; বাঁচাতে হয়
(৪)
শৃঙ্খল
আপনাকে ভুলতে চাইনি।
ঘৃণা করতে গিয়েই ভালোবেসে ফেলেছি আরো
আরও বেশি। আপনাকে কবে বলেছিলাম, কী বলেছিলাম, মনে নেই।
মনে করতে গিয়ে যা ভুলে গিয়েছিলাম ; তা-ই মনে আসে বেশি।
মনে নেই, আপনাকে বলেছি কী বলিনি কোনোদিন-- 'ভালোবাসি!'
মাঝে মাঝেই ভাবি, ঘুমিয়ে যাওয়া অগ্নিগিরির মতো আপনাকে ওড়াবো তাচ্ছিল্যের ছাই!
অথচ প্রচণ্ড জেগে আছেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে কী তীব্র!
গতকালও ভেবেছি, আজই শেষ ; আর ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাবো না।
অথচ ঘুমগুলো হাওয়ায় উড়ে যায় মেঘের মতো। আপনার মুখ ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া নদী, মধুমতী...
এভাবেই আপনি আরও বেশি আমার ভেতর প্রবিষ্ট হন।
আমি জড়বস্তুর মতো ডুবে যাই। জড়িয়ে যাই।
ফিরতে চাইলেও তাই ফেরা হয় না।
আপনার চোরাবালি চোখে গেঁথে গিয়ে আবিস্কার করি--
আপনি আকাশের চেয়েও আকাশ
মাটির চেয়েও মাটি
সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
পাহাড়ের চেয়েও নগ্নকঠোর;
আর ওই কঠোরতার চৌকাঠে বিছিয়ে দিয়েছি আমার স্নানের কৌলিন্য
আমার শরীরী লাবণ্য!
আপনাকে মনে রাখতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি নিজেকে
আপনাকে ঘৃণা করতে গিয়ে আরও বেশি ভালোবেসেছি।
(৫)
দ্রৌপদী এক অগ্নি-নারী
: মধ্যরাতের নীরব দিঘির শান্ত জলে ঢিল ছুঁড়ে
উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মতো সর্বাঙ্গে জাগালি যে! বউ বুঝি তোর মুখে ঝামা ঘষে, বাপের বাড়ি গ্যাছে? খুব বুঝি বোতল বোতল মদ গিলে দুঃখের ভেতর সেঁধিয়ে আছিস, না? রুদ্রের নেলী খালার মতো তোর ওই পাতানো চৈতি চাচির সুডৌল কোমরে কবিতার বাঁক আর শাদা কবুতরের মতো বুকের ওম বিবর্তনে শীতল এখন?
~~ না রে অগ্নি-নারী! আজ তোর জন্য কেবলই প্রেম পাচ্ছে। তোর অরণ্যদীপের মতো ভুরুর ইশারা-- জলপাই অরণ্যের গিরিখাত বেয়ে অতলে ডুবে যাওয়ার নেশা! কথা বলতে বলতে তোর চন্দনসুগন্ধী ঠোঁট! এলাচ ফুলের মতো খোসা ছাড়ানো সুগন্ধী নাভীমূল; আহ্!
: মর হারামি!
~তোর কাছে হেরে গিয়ে তোরই তো হয়েছি আমি। হা-রা-মি > চিরদিন হার মেনে, হার যোগ আমি। মরে যাই নিত্য রাতে তোর নদীতে ডুব।
: উফফ্! ব্যাকরণ শিখেছিস খুব...
: শরীরের বাঁকে তোর নদী আর পাহাড়! মন যেনো খঞ্জনা পাখি। তোকে হারিয়ে ফেলার পর তোর কাছেই যেনো নিজেকে গচ্ছিত রাখি। বউটি ঘুমায় পাশে অভ্যেসের পাশবালিশ। ফিরিয়ে দিবি জেনেও ফিরে আসি বার বার নিশ্চিন্ত নির্ভার;তোর কাছেই রাখি সকল নালিশ।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]