বেওয়ারিশ মঞ্জিল
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১০:১৮
বেওয়ারিশ মঞ্জিল
ডাবলু লস্কার
প্রিন্ট অ-অ+

অদিতি একা একা বসে আছে ট্রেন স্টেশনের একটা বেঞ্চে। অনেকক্ষণ যাবত চুপচাপ বসে আছে। আশেপাশে প্রচুর লোকের ভীড়। সে এখনো জানে না এটা কোন স্টেশন আর কিভাবেই বা সে এখানে এসেছে? তার মনে হচ্ছে সে মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। অদিতি ভাবলো দেখি একটু শরীরে চিমটি কেটে। না ঠিক আছে। স্বপ্ন নয় জেগে আছে সে। ক্ষুধাও লাগছে অনেক।
: না এভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। 
হঠাৎ অদিতির মনে হলো তার বাসাতো ঢাকার গোপীবাগে। একটু একটু করে তার সব মনে পড়তে লাগলো। অদিতি আর তার স্বামী  মোহন। তাদের দেড় বছরের ছেলে দীপ্ত। তারা ঢাকার গোপীবাগে একটা ভাড়া বাসায় থাকতো। মোহন একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ছোট খাট ছিমছাম সংসার তাদের। মোহনের মা বাবা মাঝে মাঝে এসে তাদের সাথে থাকে। আর অদিতির মা বাবা ফরিদপুরে থাকে। বাসার কথা মনে হতেই অদিতি অস্থির হয়ে ওঠে। 
: হায় হায়!  সকাল থেকে দীপ্ত হয়তো না খেয়েই ঘুমিয়ে আছে। এদিকে মোহনতো অফিসে। বাচ্ছাটা একা একা কি করছে?


এসব ভাবতে ভাবতেই অদিতি দ্রুত স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে বলে- প্লিজ আমাকে একটা কমলাপুরের টিকিট দিন। 


স্টেশনে বসে থাকা লোকটা অদিতির কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, " আপনার গাইড কি এসেছে? "


অদিতি কিছু বুঝতে পারে না - কে গাইড কিসের গাইড আর লোকটা কি বলছে?


টিকিট কাউন্টারে বসে থাকা লোকটি হয়তো বুঝতে পারে অদিতি নতুন। তাইতো পাশের একটা লোককে ডেকে বলে,  " নিমাই উনার গাইড আসেনি। উনাকে এক্সটেনশন ফাইলে নিয়ে যা। " 


এরপর অদিতিকে সঙ্গে নিয়ে নিমাই নামের লোকটা স্টেশনের পাশে একটা বিশাল ভবনে নিয়ে আসে। অদিতি সেখানে এসে অবাক হয়ে যায়। দেখে মোহন এক জনের সাথে বসে দাবা খেলছে। মোহনের ছোট থেকেই দাবার খেলার বিশাল নেশা। সময় পেলেই সঙ্গী না থাকলে একা একা বসে দাবা খেলে 
অদিতি মোহনকে দেখেই রেগে যায়, বলে," কি ব্যাপার তুমি না অফিসে গেলে? "
মোহন পিছন ফিরে অদিতিকে দেখেই চমকে ওঠে। এতক্ষণ সে হাসিমুখে দাবা খেলছিল। এবার অদিতিকে দেখে মুখ কালো হয়ে যায়। 


মোহন বলে, " তুমি কতক্ষণ আগে এসেছো? 
- এইতো মাত্র। কিন্তু কোথায় আমরা?  আর বাসায় যাবো কখন?


এবার মোহন অদিতিকে টেনে একপাশে নিয়ে যায়। বলে বসো। আমি তোমাকে সব বলছি। 
_ আমরা এখন যে জায়গায় আছি এটাকে বলে বেওয়ারিশ মঞ্জিল।এটা পৃথিবী এবং স্বর্গলোকের মাঝখানে একটা জায়গা। মৃত্যুর পর আমরা এই স্টেশনে প্রথমে আসি। তারমানে মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পরে মৃত ব্যক্তি প্রথম নিজেকে এই স্টেশনে আবিষ্কার করে। স্টেশন থেকে  নিয়ে যাওয়া হয় স্বর্গলোকে। গাইড মানে কোন ব্যক্তির মাকে বোঝায়। প্রতিটি মানুষকে পৃথিবীতে নিয়ে যান মা তাই মৃত্যুর পরেও আমাদেরকে পৃথিবী থেকে স্বর্গলোকে নিয়ে যান মা। আর যাদের মা জীবিত আছে তাদেরকে আর কে নিয়ে যাবে?  তাই যাদের গাইড না আসে তাদেরকে থাকতে হয় এই বেওয়ারিশ মঞ্জিলে।


অদিতি বলে আমাদের দুজনের মা বাবাই তো বেচে আছে। তার মানে আমরা কতদিন থাকবো এখানে? 


আমাদের মা বাবা যদি কেউ মারা যান তাহলে আমাদের  দিদিমারা এসে তাদের নিয়ে যাবে প্রথমে স্বর্গলোকে। আমাদেরকে নেওয়ার জন্য আমাদের মা দের পাঠানো হবে। যদি তোমার মা আগে আসে তুমি যাবে আর যদি আমার মা আগে আসে আমি যাব। ততদিন আমাদের এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু এই স্টেশন থেকে আমি চলে গেলে আর ফিরতে পারবো না কিন্তু তুমি গেলেও আবার তোমাকে আসতে হবে। আমাদের সন্তান দীপ্ত মারা গেলে তুমি আসবে গাইড হিসেবে নিতে। 


মোহন দীপ্তর কথা বলতেই অদিতি কাদতে থাকে। সে বলে,  " ও কি করছে একা একা। কে দেখছে ওকে? "


মোহন বলে, " আমরা ককক্সবাজার এসেছিলাম ঘুরতে। দীপ্তকে হোটেল রুমে মায়ের কাছে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমরা বেরিয়েছিলাম মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ এর দিকে লং ড্রাইভে। আমি বেশ দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিলাম। তুমি নিষেধ করছিলে। কিন্তু হঠাৎ করে একটা লরি সামনে এলো আর.... বাকিটা কিছুই মনে নেই। " 


এরপর বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। অদিতি আর মোহন সেই বেওয়ারিশ মঞ্জিলে সময় কাটায়। একটা সময় ব্যস্ততায় দুজনের এক সাথে বসে দুদণ্ড কথা বলা হতো না কিন্তু এখন অনেক সময়। পৃথিবীর কথা অনেক মনে পড়ে। ওরা দুজনে বসে বসে ভাবে আবার যদি একদিনের জন্য হলেও একটু পৃথিবীতে ঘুরতে যেতে পারতো। স্বর্গলোকে নাকি শুধু সুখ আর সুখ কিন্তু সেখানে একবারও যেতে ইচ্ছে করছে না। পৃথিবীর মায়া বড় অদ্ভুত মায়া। আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত। না খেয়ে থাকতাম তবুও ওটাই আমার স্বর্গ। 


সেদিন রাতের বেলা হঠাৎ মোহন অদিতিকে বলে ওঠে, " তুমি আগামীকাল ফিরে যাচ্ছো। তোমার নাকি সেন্স আসতে শুরু করেছে। শোন,  ছেলে টাকে আমার কথা বলো আর দ্রুত ফিরে এসো "


অদিতি ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে, ' কি বলছো এসব আবোল তাবোল। এখন ঘুমাওতো। আমাদের আর পৃথিবীতে যাওয়া হবে না কোনদিন। জানি না আমার দীপ্তকে কে দেখছে?


_ আমরা দেখছি মা। তোর দীপ্ত তোর জন্য কত কান্না করেছে এই তিনমাস। 


অদিতি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার সামনে তার মা দাঁড়িয়ে আছে তার সন্তান দীপ্তকে কোলে নিয়ে। হাসপাতালের কেবিনে লোকে ভর্তি। 


অদিতি আরও কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে যখন বাড়িতে যায় তখন শুনতে পারে। তিনমাস আগে তারা অফিস থেকে একটা ট্যুরে কক্সবাজার গিয়েছিল। দীপ্তকে হোটেলের রুমে শাশুড়ীর কাছে রেখে সে আর মোহন বেরিয়েছিল মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে লংড্রাইভে। হঠাৎ একটা এক্সিডেন্ট হয়। মোহন স্পট ডেড হয়। অদিতি হাসপাতালে তিন মাস কোমায় ছিল। কোন সেন্স ছিল না। তারপর একটু সেন্স আসার ভাব হলেই কেবিনে দিয়ে দেওয়া হয়।সেখানেই জ্ঞান ফেরে অদিতির। বেচে যায় এ যাত্রায়। কিন্তু সারাক্ষণ মনে হতে থাকে বেওয়ারিশ মঞ্জিল এর কথা। হয়তো মোহন তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে সবাইকে বলে বেওয়ারিশ মঞ্জিলের গল্প। কিন্তু সবাই বলে কোমায় থাকার সময় সে হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছে। 


কিন্তু অদিতির কাছে এটা স্বপ্ন মনে হয় না। সে বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরে হয়তো বেওয়ারিশ মঞ্জিলে গিয়ে আবার মোহনের সাথে দেখা হবে তার।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com