শিরোনাম
চাষের মাছ : কেনার আগে ভাবুন
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ২১:০১
চাষের মাছ : কেনার আগে ভাবুন
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশে মাছ চাষে রীতিমত বিপ্লব হয়েছে। বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। জনপ্রতি মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। পাশাপাশি এ প্রশ্নও উঠেছে যে, এসব মাছ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত।


ঢাকা মহানগরীর ফাতেমা আবেদীন এখনো বাজারে গিয়ে 'দেশি মাছ' খোঁজেন। দেশি মাছ মানে খাল, বিল, পুকুর বা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে যেসব মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো। তাঁর কথা, ‘‘দেশি মাছ আর চাষের মাছের মধ্যে পার্থক্য অনেক। দেশি মাছের স্বাদই আলাদা। তবে এখন রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস - যা-ই বাজারে পাওয়া যায় সবই চাষের। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে।''


বাংলাদেশে এখন বলতে গেলে সব ধরনের মাছই চাষ হয়। রুই, কাতলা থেকে শুরু করে টেংরা, পাবদা, কৈ, শিং, মাগুর – সবই। রাক্ষুসে প্রকৃতির কারণে আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ হলেও গোপনে তাও চাষের অভিযোগ রয়েছে। শুধু কি চাষ, আকারে ছোট থাকা অবস্থায় সেগুলোকে বাজারে 'দেশি মাগুর' বলে চালানোরও অভিযোগ আছে।


ফাতেমা আবেদীন বলেন, ‘‘এটাই এখন একটা বড় সমস্যা - কোনটা চাষের আর কোনটা দেশি মাছ, তা চেনা কষ্টকর। অনেক সময় বাজার থেকে কেনা মাছে রান্নার পর উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়।''


বাংলাদেশে চাষের মাছের দাম তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ক্রেতারা যেমন কম দামে পেয়ে এই মাছ কিনছেন, আবার খামারিরাও চাষের মাছে লাভ করে অনেক বেশি। আর লাভের নেশায় খামারিরা মাছের জন্য দেশে ও বিদেশে তৈরি নানা ধরনের ফিস ফিড, কেমিক্যাল, অ্যান্টিবায়োটিক, ইনজেকশন ব্যবহার করে। এ সব ব্যবহার করতে গিয়ে অপ্রশিক্ষিত খামারিদের অনেকেই নিয়মিত মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরামর্শও নেন না বা পান না।


খামারিরা সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবাবায়োটিক আর নানা প্রকার ওষুধ ব্যবহার করেন কোনো পরামর্শ ছাড়াই। কখনো কখনো ওষুধ বিক্রেতাদের কথাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।


খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রাশিদুজ্জামান চাষের মাছ নিয়ে সামাজিক সচেতনতার কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার মানুষ চাষের মাছ সহজে খেতে চান না। কারণ এমনসব খাদ্য দিয়ে এসব মাছ দ্রুত বড় করা হয়, যা ক্ষতিকর। ক্ষতিকর উপাদান অ্যাবজর্ব হওয়ার আগেই মাছ বিক্রি করা হয়।''


তিনি বলেন, ‘‘ডিলাররা প্যাকেটজাত মাছের খাবার বিক্রি করে। এসব খাবার উৎপাদন করা হয় পচা শামুক, ঝিনুক এবং কেমিক্যাল ব্যবহার করে, যা বিষাক্ত। মুরগি ও মাছ একই সঙ্গে চাষ করা হয়। জলাশয়ের ওপর মাচা বানিয়ে বা পাশে মুরগি আর পুকুরে বা জলাশয়ে মাছ। মুরগি বা হাসের বিষ্ঠা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়। মাছের খবার হিসেবে নানা ধরনের বর্জ্যও ব্যবহার করা হয়। বাজারে যেসব মুরগি কেটে বিক্রি করা হয় তার নাড়িভুড়ি, গরু ছাগল জবাই করার পর তার নাড়িভুড়িও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।''


তিনি আরো জানান, ‘‘তেলাপিয়াসহ আরো কিছু মাছ মনোসেক্স করা হয় ব্যবসার জন্য৷। এ কাজে বিশেষ ধরনের খাবার ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। ফলে তেলাপিয়া মাছ এক পর্যায়ে সব পুরুষ হয়ে যায়। বাজারে পুরুষ তেলাপিয়ার চাহিদা বেশি। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন কম্পানির পরামর্শেই বিভিন্ন রাসায়নিক এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও মাত্রা নির্ধারণ করেন তারা।''


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘যেমন ধরুন মনোসেক্স কালচারের মাধ্যমে কৈ মাছ সব নারীতে আর সব তেলাপিয়া মাছকে পুরুষে রূপান্তর করা হয়। এটা ব্যবসার জন্যই করেন খামারিরা। আর এ জন্য তারা হরমোন প্রয়োগ করেন। তা হতে পারে খাবারের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে। কিন্তু এর মাত্রা সঠিক না হলে বা ওই হরমোন দ্রবীভূত হওয়ার আগেই যদি খাবার জন্য মাছ বিক্রি করা হয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হবে। আবার মুরগির বিষ্ঠায় নানা ধরনের ক্ষতিকর মাইক্রোসেল থাকে৷ তা যদি মাছের খাবার হয় তাহলে মাছের মধ্য দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মুরগির খাবার তৈরির অভিযোগ আছে। আর সেই মুরগির বিষ্ঠা বা বর্জ্য যদি মাছের খাবার হয় তাহলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মাছের ভেতরেও যাবে।''


বরিশালের হিজলা উপজেলার মৎস্যচাষি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা মাছের প্যাকেটজাত খাবার ব্যবহার করি। আবার ভুট্টা, খৈল, হাড়ের গুড়া, ধানের কুড়া, শুটকিসহ বিভিন্ন উপাদানের মিশেলে তৈরি খাবারও ব্যবহার করি। আমাদের টার্গেট থাকে ছ'মাসের মধ্যে বাজারে মাছ বিক্রি করা। তবে এ সব খাবার কতটা নিরাপদ তা আমরা জানি না। এছাড়া আমরা নানা ধরনের ওষুধ, কেমিক্যাল, ইনজেকশন, হরমোন ব্যবহার করি। পরামর্শ নেয়ার জন্য মৎস্য কর্মকর্তাদের তেমন পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এগুলো ব্যবহার করি।''


ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘এখন মাছের খাবারে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। আবার ফিস ফিড যেসব উপাদানে তৈরি হয়, দেখা যায় সেসব খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এগুলো মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।''


মাছের রোগ বালাই সারাতে বা প্রতিরোধ করতে এখন খামারিরা নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহার করেন। জলাশয়ের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে ব্যবহার করেন চুন ও পটাশ। কিন্তু এসব কি মাত্রায় এবং কখন ব্যবহার করতে হবে তার জন্য নেই কোনো বিষেষজ্ঞ পরামর্শ। খামারিরা চান কম খরচে মাছ উৎপাদন করে ভালো ব্যবসা করতে। তাই তারা হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ওষুধ ব্যবহার করেন। এসব ওষুধ আসে বিদেশ থেকে। এর মান নির্ধারণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com